গল্প ফুরায় না?

কিছু গল্প শেষ হয় না,শুধু থেমে যায় মাঝপথে?

অসমাপ্ত থেকে যায় অনুভুতিগুলো?

 

 

ল্যাম্প পোস্টের নিচের বেঞ্চটাতে ডায়েরী হাতে নিয়ে বসে আছে মিনহাজ।তার মাথাটা সামান্য ঝুকে আছে নিচের দিকে।সম্পূর্ণ রাস্তা ফাঁকা।

অতো রাতে কারো থাকার কথাও নয়।হলুদ আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে সে।সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম অদ্ভুত একটা পরিবেশ।

খানিকটা ভৌতিকও।মিনহাজের দিকে তাকালেই এই ভৌতিক ভাব-টা যে কারো চলে আসতে পারে।কারন তার মুখ ভরতি দাড়ি-গোঁফ,

,,মাথার কোঁকড়ানো চুল ঝাঁকড়া হয়ে আছে খানিকটা জায়গা জুড়ে।এতো গরমের মধ্যেও তার গায়ে একটা চাদর জড়ানো।

প্রথম দেখাতে যে কেউ তাকে পাগল বলতে বাধ্য।কিন্তু তাকে কাছে থেকে দেখলে,জানলে বুঝা যায় আসলে সে পাগল নয়।কে জানে,সে পাগল-ও হয়তো।

তবে খানিকটা পাগলামি প্রতিটা স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেই থাকে।মিনহাজের ভেতরেও সে সহজাত পাগলামি টা ছিলো।কিন্তু পল্লবীর হঠাৎ চলে যাওয়ার পরেই তার পাগলামীটা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়।

আগে রাস্তার মানুষ জন তাকে দেখলে ভয় পেতো।কিন্তু আস্তে আস্তে পরিস্থিতি পালটে যায়।আত্মীয়-স্বজন দের মধ্যে কিভাবে যেনো তার পাগলামীর কথাটা ছড়িয়ে পড়ে,,,আস্তে আস্তে বন্ধু-বান্ধব কমতে থাকে তার।এখন বাসার মানুষ গুলোও তার কাছে আসে না।

তার বাবা-মা কেউ নেই।দূরসম্পর্কের এক খালার বাসায় থেকে বড় হয়েছে সে।সেখানে তার খালা আর তার মেয়ে নিলুই তার আত্মীয়স্বজন।

কিন্তু কেনো যেনো তার সামনে বসে থাকা কুকুরটা তাকে একদম-ই ভয় পায় না।তার আশেপাশে ঘোরাফেরা করে।প্রতিরাতে সে যখন তার ডায়েরী-টা নিয়ে ল্যাম্পপোস্টের নিচে এসে বসে থাকে তখন কুকুরটাও তার সামনে এসে বসে থাকে।মিনহাজ মাঝে মাঝে তার পকেট হাতিয়ে দু-একটা ভাঙ্গা,

বিস্কুট বের করে খেতে দেয় কুকুরটাকে।তাতেই সেটা মহা খুশি।তার চাল-চলনের কোথাও যেনো সে খুশিটা দেখতে পায় মিনহাজ।তার বেশ লাগে।এ কুকুরটাই তো এখন তার সবচেয়ে কাছের।তবে আরো একজন আছে যে মিনহাজ কে ভয় পায় না।সে হচ্ছে নিলু।

নিলু মেয়েটা মিনহাজের খুব কাছের।প্রচুর ভালোবাসে নিলু তাকে।সে জানে নিলু এখনো রাতে ঘুমায় না।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে সে।নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারো পাশে দেখলে সব মেয়ের-ই খারাপ লাগে।নিলুর ও খারাপ লাগতো।যদিও এখন পল্লবী নেই।

কিন্তু নিলু জানে সে কখনো মিনহাজকে নিজের করে পাবে না।পল্লবী পৃথিবী থেকে চলে গেলেও মিনহাজের সমস্ত কিছুতে মিশে আছে সে।নিলুর জন্য বড় মায়া হয় মিনহাজের।পল্লবী মাঝে মাঝে বলতো,

--মিনহাজ, আমাদের গল্পের শুরুটা কিন্তু খুব সুন্দর।

তখন তার উত্তরে মিনহাজ ছোট্ট করে কেবল হাসতো।কিছু বলতো না।তখন হঠাৎ করে পল্লবী হাসতে শুরু করতো।প্রচন্ড শব্দ করেই হাসতো।হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসতো।পল্লবী তখন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে পানি মুছে দিয়ে আবার হাসতো।

মিনহাজ তাকিয়ে দেখতো পল্লবীকে। তার হাসি যেমন হঠাৎ করে শুরু হতো ঠিক তেমনি হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যেতো।চারদিকে কেমন যেনো থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হতো।সেই নিস্তব্ধতা মিনহাজের খুব ভয় লাগতো।পল্লবীকে হারানোর ভয়।

মিনহাজ!

-হুম,,

আমি মরে গেলে কি তুমি আবার বিয়ে করবে?

সে পরিস্থিতি কখনো আসবেই না।কারন তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবে।

পল্লবী তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো।কারন সত্যিটা মিনহাজ নিজেও জানে।পল্লবী বেশীদিন বাঁচবে না।তবুও মিনহাজ তাকে মিথ্যা আশা দেয়।অবাক করার বিষয়-ই।পল্লবী বলে,

 

মিনহাজ,আমি মরে যাবার পর তুমি নিলুকে বিয়ে করবে।মেয়েটা খুব ভালোবাসে তোমাকে।আমার চেয়েও বেশি।

 

আর তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?

 

আমি তো আমার অসুখ টাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।দেখছো না,,,তাই তো এতো দ্রুত সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় আর কয়েকটা দিন থাকি তোমার পাশে।সবকিছু বড় বেমানান লাগে।

 

চুপ করো পল্লবী,,একটু ঘুমাও।আসো তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।

 

পল্লবী তখনো বিড়বিড় করতে থাকে,

 

আমাদের গল্পের শেষ পৃষ্ঠা-টা তুমি কখনো আমাকে নিয়ে লিখতে পারবে না।আমাদের গল্পের শেষ পৃষ্ঠা-টা হবে অনেক সুখের।সেখানে আমার কোনো জায়গা নেই।সেই জায়গা টা কেবল নিলুর।একান্ত নিলুর।

 

পল্লবীর মৃত্যুর ৬ বছর পেড়িয়ে গেছে।কিন্তু আজ অবধী মিনহাজ তাদের গল্পের শেষ পৃষ্ঠা-টা লিখতে পারে নি।নিলুর যে মেয়ে হয়েছে তার নাম রাখা হয়েছে অপ্সরী।

 

নিলু মাঝে মাঝে মিনহাজকে দেখিয়ে বলে,"জানো,

তোমার এই মামাটা খুব ভালো কবিতা লিখেন।তার মতো করে কেউ কবিতা লিখতে পারে না।কেউ না।" নিলুর গলা ভার হয়ে আসে।সে কষ্ট মিনহাজের সহ্য হয় না।

পাগলের মতো লাগে তার।ভেতরে কেমন যেনো একটা অস্থিরতা।সে উঠে আসে সেখান থেকে।কুকুরটার পাশে এসে বসে পড়ে সে।ডায়েরীর শেষ পৃষ্ঠা-টা খুলে হা করে তাকিয়ে থাকে মিনহাজ।

কেমন যেনো একটা শূন্যতা বুকের ভেতর।মিনহাজ চিৎকার করে কাঁদে।তখন কুকুরটা তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।মানব জীবন বড় অদ্ভুত,বড় কষ্টের।শেষ পৃষ্ঠা-টা ফাঁকা-ই রয়ে যায়।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments