কথা রাখা

কথা তো সবাই দেই।রাখে কইজন তা দেখা দরকার।

অর্ধেক রাতে ঘুম থেকে তুলে বিয়ে দিয়ে দিল আমার। তাও নাইটির উপর শাড়ি জড়িয়ে। আর নাকি সময় ছিল না। লগ্ন পার হয়ে যাচ্ছিল।

     সকাল বেলা বাবার জন্য রান্না করে কলেজে যাব ভেবে রাতে শুয়েছিলাম। দুটোর সময় আমারদের এক প্রতিবেশী ঠেলে তুলে হেসে বলল, "মানা, তাড়াতাড়ি ওঠ, আর ঘুমাতে হবে না। তোর বিয়ে।"

 সেই রাতেই আমার বিয়ে হল মালদার গাজলে। পাত্র বি সি এস। ডি গ্রেড অফিসার। যাকে সে আমাদের গ্রামে বিয়ে করতে এসেছিল, সে তার মনের মানুষের সঙ্গে শেষ বেলায় নাকি পালিয়েছে। 

   আড়ংঘাটা থেকে গাজোল ৭ ঘন্টার জার্নি। পথে সে আমার সঙ্গে একটিও কথা বলেনি। আমিও না। শুধু দু'বার থাকতে না পেরে বলেছি, ওয়াসরুম যাব।

   বরের নামটা পর্যন্ত জানিনা। জানার চেষ্টা করিনি। এখনো কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছি। যেন স্বপ্নের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না।

   লোকটা এতটাই সুন্দর, হ্যান্ডসাম বারে বারে মনে হচ্ছিল গালটা টিপে দি। ঠোট দুটো যেন ছাড়ানো কমলা লেবুর কোয়া। লাল টকটকে। 

   যাকে বিয়ে করবে বলে বেচারা সেজেগুজে এসেছিল, স্বপ্ন দেখেছিল, মোবাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছিল, তাকে না পেয়ে সদ্য বিবাহিত পুরুষটি কেমন যেন দিশেহারা। এমনটা হবারই কথা। যে কোন ছেলেরই হতো। কেন জানিনা মাঝে মাঝে আমার মায়া হতে লাগলো। আহারে! কাকে বিয়ে করতে গিয়ে কাকে বিয়ে করে মনমরা হয়ে ফিরছে।

   কদুবাড়ী মোড়ে এসে বর যেন আমার গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। সাদা রঙের ইনোভা গাড়িটি রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে, একটি ছেলেকে ডেকে রঙ্গ করে বলল, তুষার, বউটি কিন্তু ভারী সুন্দরী, ঘন্টাখানেক ওয়েট করছি, ওকে সঙ্গে নিয়ে যা। বিউটি পার্লার থেকে সাজিয়ে দিয়ে যাবি। পেছনের গাড়িতে বোন আছে ওকেও নিয়ে যা।

   ম্যাজিক এর মত কাজ হল দেখলাম। ৮-১০ জন লোক ঘিরে ধরে আমাকে নিয়ে গেল বিউটি পার্লারে।

   আমাদের ফিরতে আধঘন্টা লেট হলো। ননদটি আমার ভারী সুন্দরী এবং মিষ্টি। কি সুন্দর কথা বলে! কি অমায়িক ব্যবহার। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত দেখে শুনে তারপর পার্লার থেকে বের করল। 

   ফিরে দেখি বরটি সেভাবেই বসে আছে। বোনকে দেখে প্রায় চিৎকার করে বলল, কাকে আনলিরে তুবড়ি! এ তো স্বর্গের অপ্সরী!

   এই কমপ্লিমেন্ট যে আমার কি ভালো লাগলো বলে বোঝাতে পারবো না।

   তুবড়ি দাদার কথায় কান না দিয়ে শুধু বলল, তাড়াতাড়ি চ খিদে পেয়েছে।

   লুকিং গ্লাসে আমাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। সত্যি সত্যি এবার বউ বউ লাগছে। এক ঝটকায় যেন অনেকটা বড় হয়েছি আমি।

   এখান থেকে গাজল অনেকটা। পথে যেতে যেতে ড্রাইভার দাদা বলল, বৌদি, মা কিন্তু খুব অসুস্থ। ওনার একটু সেবা যত্ন কোরো।

   বুঝলাম ড্রাইভার পর্যন্ত বাড়ির মালকিনকে মা বলে ডাকে। তিনি যে অসুস্থ প্রথম শুনলাম। সবই আমাকে প্রথম শুনতে হবে, না হলে দেখতে হবে।

   যে বাড়ির সামনে এসে গাড়িটি দাঁড়ালো সেটি হোটেল না রাজপ্রাসাদ বোঝা মুশকিল। অনেকেই জানলা দিয়ে আমাকে দেখে বলল, জয়ন্তর বউ দারুন সুন্দরী। দেখ দেখ।

   এতক্ষণে বোঝা গেল লোকটির নাম জয়ন্ত। মনে মনে ঠিক করে নিলাম জয়ন্ত নয়, আমি অন্তু বলে ডাকবো।

 

    বধূবরণ করতে শাশুড়ি আসতে পারলেন না। আগেই শুনেছিলাম তিনি অসুস্থ। কতটা অসুস্থ জানিনা। একবার অন্তত আসতে পারতেন। কষ্ট করে হলেও আসা উচিৎ ছিল।

    আমি আর অন্তু শাশুড়ির ঘরে এলাম। পিছে পিছে এলো একগাদা আত্মীয়-স্বজন। এদের চালচলন, পোশাক-আশাক, হাফ-ভাব দেখলেই বোঝা যায় বেশ বড় ঘরের। 

    শাশুড়িকে দেখেই আমার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো। আশ্চর্য! ইনি কি জীবিত! না মৃত! মানুষ না কঙ্কাল! বেঁচে আছেন না মারা গেছেন! একদম বিছানার সঙ্গে মিশে আছেন কেন? 

    সাদা পোশাকের নার্স দূর থেকে নমস্কার করতে বললেন। অন্তুর দেখাদেখি আমিও দূর থেকে নমস্কার সেরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। 

     এমন মানুষ আগে কখনো দেখিনি। কি এমন রোগ যে জীবিত অবস্থাতেই নরকঙ্কাল! চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। দাঁত গুলো কেমন ভয়ংকর ভাবে উঁচু হয়ে ভয় দেখাচ্ছে! বীভৎস!

    জানিনা কতদূর জয়ন্তর পিছে পিছে হেঁটে যেতে পেরেছিলাম। কখন যেন ভয়ে আতঙ্কে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলাম। জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

    জ্ঞান ফিরলে দেখলাম তুবড়ির কোলে মাথা আমার। চেয়ারে একজন ডাক্তার বাবু। অন্তত জনা পনেরো বউ ঘিরে রেখেছে। খুব লজ্জা করতে লাগলো। নতুন বউকে নিয়ে এরা নিশ্চিত বিড়ম্বনায় পরেছে।

    কিন্তু জয়ন্ত কোথায়? ওকে তো দেখছি না! ও কি আমায় কোথাও ফেলে চলে গেল? আমার উপর রাগ করেছে! মাকে দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়েছি বলে অভিমান করেছে? ছি ছি। আমি ব্যস্ত হয়ে উঠে বসলাম।

    আমায় উঠে বসতে দেখে ডাক্তার বাবু কয়েকটি প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে বিদায় নিলেন। আমার চোখে মুখে যে জলের ঝাপটা দেয়া হয়েছিল তা তুবড়ি অত্যন্ত যত্ন করে মুছিয়ে দিল তারপর বলল, কিরে? মাকে দেখে ভয় পেয়েছিলি? ভয় পাস না। মা খুব ভালো। বিকেলের দিকে গিয়ে কথা বলে আসিস। দেখবি কি সুন্দর কথা বলে। বলেই চুড়িদারের ওড়না দিয়ে নিজের দুটো চোখ নিজেই মুছে নিল।

    বিকেলের দিকে আরেকবার যেতে হবে শুনে মনে হচ্ছিল আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো। কি করে তাকাবো ওনার দিকে। কি করে কথা বলবো! মাংস হীন জিরজিরে একটা লোকের সঙ্গে কি করে দিন কাটাবো! আমার আবার ভয় করতে লাগলো। তুবড়ির ডান হাত ধরে বললাম, তুমি কোথাও যেওনা।

    এই! আমায় তুমি বলিস না। আমি খবর নিয়ে জেনেছি তুই সেকেন্ড ইয়ারে পড়িস। আমিও সেকেন্ড ইয়ার। তুই আমার বান্ধবী। একটু থেমে অভয় দিয়ে তুবড়ি আবার বলল, নারে মানা। তুই যতদিন না সড়গড় হচ্ছিস, ততদিন আমি হোস্টেলে যাবো না। 

    আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম।

    বিকেলের দিকে আমাকে যে সুন্দর ঘরটা দেয়া হয়েছে তার দরজা ভেজিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ হুড়মুড় করে জয়ন্ত ঘরে ঢুকে আমাকে ঠেলে তুলে বলল, অনেক লুকিয়ে চুরিয়ে এসেছি। কেউ দেখেনি। একটা চুমু খাবো?

    ঘুম জড়ানো চোখে আমি কি সুন্দর দেখলাম ওকে। ও আবার একই কথা জিজ্ঞেস করল? একটা চুমু খাব? তাড়াতাড়ি। কেউ এসে পড়বে! কি?

    লজ্জায় মরে যাই। দিনে দুপুরে দরজা খোলা। লোকটার কি কান্ডজ্ঞান কম? হঠাৎ এলই বা কোথা থেকে!

    ঠিক আছে চলে যাচ্ছি। হঠাৎ জয়ন্ত কাঁচুমাচু হয়ে বলল।

    এবার আর কিছু না বললে হচ্ছে না দেখছি। ভয়ে ভয়ে বললাম, নিজের বউকে চুমু খাওয়ার জন্য পারমিশন নিতে হয়? দরজা খোলা রয়েছে যে!

    অতি দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার থেকেও দ্রুত প্রায় দৌড়ে এসে ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে ফিরে গেল দরজার কাছে। আবার ফিরে এসে আরেকটি চুমু খেয়ে আবার ফিরে গেল। তৃতীয়বার এসে কিস করে বলল, আশ্চর্য! মেয়েদের কিস করে এত আনন্দ! আগে জানতাম না তো। ঠিক আছে পরে কথা বলব। অনেক কথা বলব, বলেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।

    কোন পুরুষ আমায় প্রথম চুমু খেলো। কিন্তু বিষয়টা এত হুটোপাটি এবং আতঙ্কে হলো আমি কিছুই অনুভব করতে পারলাম না। ওই বা এত অস্বাভাবিক আচরণ করল কেন বুঝতে পারলাম না। অন্তত আরো কিছুক্ষণ আমার কাছে থাকতে পারতো। আমার কেমন এলোমেলো লাগলো।

    সন্ধ্যার আগে আগে তুবড়ি আরেকবার নিয়ে এলো শাশুড়িমার ঘরে। এবার তুবড়ির সঙ্গে ওর কয়েকজন বান্ধবীও আছে। তারাও আমার বয়সী।

    দরজা থেকেই হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করেছিল আমার। এবার গিয়ে কি দেখব কি জানি। ভয় করছিল অত্যাধিক।

    সেই নার্সটি এখন আর নেই। অন্য একজন এসেছে। মেয়েটি সুশ্রী। ছেলেদের মত চুলের স্টাইল।

    শাশুড়িমা আমায় দেখে অত্যন্ত মিষ্টি করে বললেন, আয় আয়। শুনলাম আমায় দেখে তখন ভয় পেয়েছিলি? ওরে তুই তো ছেলে মানুষ। তোর শ্বশুর মশাই-ই ভয় পায়। এ ঘরে আসে না।

    গলা শুনে চমকে উঠলাম। এত সুন্দর কন্ঠ মানুষের হয়! এত সুন্দর বাচনভঙ্গি মানুষের হয়! কথায় এত দরদ মানুষের মুখে থাকতে পারে! 

    ভেবেছিলাম কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব। শাশুড়িমা বুঝতে পেরে থামিয়ে দিয়ে হেসে বললেন, আমার পা নেই রে মা! গ্যাংগ্ৰিনে দুটোই কাটা পড়েছে। পচন ধরেছে। তোর দেখার দরকার নেই।

    একটু থেমে তারপর আবার হেসে বললেন, আমার একটি কথা রাখবি মা! তোকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। তোকে বলা যায়।

    ওনার কথায় অন্তরটা ভিজে গেছিল আমার। চোখে জল এসে গেছিল। কোন প্রকার ভনিতা না করেই বললাম, বলুন।

    মনে হয় শাশুড়িমার চোখেও জল এসে গেছিল, ধীরে ধীরে বললেন, তুই আর এ ঘরে আসিস না। আর এই ধর, এই কাগজে একটা কথা লেখা আছে। তোকে মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। পারলে মেনে চলিস। ঘরে গিয়ে একা পড়িস।

  তুবড়ি আমাকে আমার ঘরে দিয়ে গেছে 10 মিনিটও হয়নি। আগের মতোই হুড়মুড় করে আবার এলো জয়ন্ত। এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে।

   আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ পর বললাম, "এত আবেগ নিয়ে দীপঙ্কর কি তোমায় জড়িয়ে ধরে?"

  কথা শুনে ছিটকে সরে গেল জয়ন্ত। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে আবার ফিরে এসে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, "তুমি আমায় ছেড়ে চলে যেও না, আমি ওকে ভুলে যেতে চাই। তুমি একথা আর কাউকে বলো না। বলো বলবে না! প্লিজ!

  আমি আর একবার ওর বুকে মাথা রেখে বললাম, না বলবো না, শুধু তুমি তোমার কথা রেখো, ভালোবেসো, খুব ভালোবেসো।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments