গাড়িটা যখন দার্জিলিং–এর খাড়াই পথে এসে মলের কাছে দাঁড়ালো তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বেজে গ্যাছে। সারা রাস্তায় মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু যাত্রাশেষের আধঘণ্টায় জাঁকিয়ে বৃষ্টি এল। শিলিগুড়ির ছেলে সুরেশের এসব রাস্তায় চলে অভ্যাস। সে ভরসা দিয়েছিল যতই আবহাওয়া খারাপ হোক, পাঁচটার মধ্যেই সে হোটেলে পৌঁছে দেবে আমাদের। কাদা–মাখা রাস্তার একপাশে গাড়িটা পার্ক করে সে অভয় দিল ‘আপনারা হোটেলের ভিতরে গিয়ে ওদের লোককে এসে মালপত্রগুলো নিয়ে যেতে বলুন স্যার। আমি আছি।‘ আমরা, মানে আমি, রঞ্জনা, পার্থ আর জয়শ্রী, একসঙ্গে ঢাল বেয়ে উঠে এলাম হোটেল রজার্স স্টে’র রিসেপশনে। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভেতরের উষ্ণতায় শরীর জুড়িয়ে গেল।
ম্যানেজার মিস্টার ব্রেগাঞ্জা কলকাতার লোক। মাঝবয়সী। একমুখ হাসি নিয়ে নিজের ঘর থেকে
বেরিয়ে এসে খ্যানখ্যানে গলায় একটা ‘গুড ইভিনিং’ ছুড়ে দিলেন। পার্থ বলল ‘ইফ ইউ ক্যান প্লিজ টেল ইউর ম্যান টু কলেক্ট আওয়ার লাগেজ ফ্রম দ্য কার?”
— “ওহ ইয়েস, হি মাস্ট হ্যাব গন বাই দিস টাইম।‘
বলতে বলতেই দেখি দুজন নেপালি ছেলে আমাদের তিনটে সুটকেস আর দুটো হ্যাবার স্যাক নিয়ে উপস্থিত, পিছনে সুরেশ। সে এসেছে গাড়ির ভাড়া বুঝে নিতে। আমি পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বললাম, ভাই গুনে নাও একবার।
টাকা গুনতে গুনতেই সে আমায় চাপা গলায় বলল, স্যার এখানে কদিন থাকার প্লান আপনাদের?
আমি একটু বিরক্তই হলাম তার এই প্রশ্নে। বললাম, কেন বল তো? দিন তিনেক আছি আমরা।
“না স্যার, মানে যদি তার আগেও দরকার হয় জানাবেন। এই আমার ফোননম্বর।” এই বলে ঝটপট আমার হাতে একটা ছোট্ট কার্ড ধরিয়ে সে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল।
দার্জিলিং এসে পৌঁছতে পারার আনন্দে ক্রমশ ভুলেই গেলাম সুরেশের কথা। এই রজার্স স্টে হোটেলটা পাহাড়ের গায়ে চারটে ধাপ কেটে বানানো। প্রথম ধাপে বেশ বড় রিসেপশন আর লবি। তার ওপরের দুটো ধাপে সব মিলিয়ে খান দশেক কামরা। একদম ওপরে কী আছে বোঝা গেল না। আমাদের তেতলায় দুটো ঘর। সামনে একফালি কাচে মোড়া বারান্দা। সেখানে চেয়ার টেবিল পাতা— আড্ডা মারার জন্য অনবদ্য।
জয়শ্রীকে অনেকক্ষণ দেখছি না। খোঁজ করতে জানা গেল সে তাদের ঘরে বাথরুমে ঢুকেছে। আমরাও নিজেদের ঘরে এসে জিনিসপত্র বার করে গুছিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। বাথরুমে ঢুকে দেখি সেটা পেল্লায়, কিন্তু সেই অনুপাতে আলো কম। একটাই জানালা, সেটা বন্ধ। ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাবলাম রুম ফ্রেশনার দেওয়া হয়েছে বুঝি।
কিন্তু আমি নিশ্চিত এই গন্ধ কোনও বাজারচলতি রুম ফ্রেশনারের গন্ধ নয়। একধরনের পাহাড়ি লিলি ফুলের গন্ধ এটা। জানালা বন্ধ। অন্য কোনও ফাঁকফোকর চোখে পড়ল না। ঘরে ফিরে এলাম। সামনের বারান্দায় আলো জ্বলে উঠেছে। রঞ্জনা আমাদের জন্য মেনু কার্ড নিয়ে বসে। পার্থ ছবি তুলতে ব্যস্ত।
খানিক বাদেই গরম গরম চিকেন পকোড়া, মোমো আর ধূমায়িত কফিতে ডুবে গেলাম আমরা। বাইরে বৃষ্টি বেড়েছে। ছাতা নিয়ে লোকজন চলেছে। ডানদিকে একটু চড়াই উঠলেই মল। বাইরের চলমান দৃশ্য দেখে এই হোটেলের ভেতরের নিস্তব্ধতার আন্দাজ মিলবে না। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। রিসেপশনে লাগানো ছবি দেখে জানলাম রজার কেন্ট নামে চা বাগানের এক ম্যানেজার তৈরি করেছিলেন এই বাড়িটা, ১৯০৪ নাগাদ, অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের এক বছর আগে। কেন্টের সঙ্গে কোম্পানির বনিবনা না হওয়াতে তিনি চাকরি ছেড়ে এই হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। ইংল্যান্ড থেকে আসা মানুষজন এসে উঠত এখানে। সাহেব তাঁর সঞ্চয়ের টাকা লাগাতে কার্পণ্য করেননি। দিনের পর দিন একটু একটু করে সাজিয়ে তুলছিলেন হোটেলটা
‘বুজলে, সারা বাড়িটা কিন্তু আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে‘, পার্থ বলল।
জয়শ্রীর নেশা হেরিটেজ। বলল, ‘বাড়িটার ওপরে একটা attic আছে, খেয়াল করেছ, মানে বাংলায় যাকে বলে চিলেকোঠা। সাহেবি বাড়িতে এ ধরণের attic থাকে আর তাকে ঘিরে থাকে নানা কাহিনি।‘
জয়শ্রীর শেষ কথাটা আমার কানে লাগল।
— ‘কাহিনি বলতে?’
— ‘কাহিনি নানারকম, ওই যেমন হয় আর কী!’
রঞ্জনা কফির কাপ হাতে নিয়ে প্রায় নিঃশব্দে একটা চুমুক দিল।
মোবাইল ফোনে চার্জ থাকলেও সিগনালের নামগন্ধ নেই। পার্থ ফোন ছাড়া থাকতে পারে না। এই মুহূর্তে সে হতাশ।
‘যাবে নাকি? একবার বাড়িটা ঘুরে দেখে আসি?’ আমি বললাম পার্থকে। জয়শ্রীর যাবার ইচ্ছে থাকলেও সে রঞ্জনার সঙ্গে আড্ডা দেবে বলল। পার্থ আর আমি বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। ডান দিকে ঘুরলে রিসেপশন। আমরা বাঁদিকে গেলাম।
এটা বাড়ির পিছনের দিক। বেশ খানিক আলো–আঁধারি। আসলে রিসেপসনের ঝকমকে আলোর পাশে বলেই হয়ত অন্ধকারটা চোখে লাগছে। যেখান দিয়ে হেঁটে এগুচ্ছি সেটা একটা একফালি করিডোর। দুপাশের দেওয়ালে দামি কাঠের প্যানেলে বেশ কিছু হাতে আঁকা ছবি টাঙানো।
আগে পার্থ, তার মোবাইলের আলো একটা ছবির ওপর পড়তেই চিনতে অসুবিধে হল না, এটা হল পাহাড়ের গায়ে রজার্স স্টে’র ছবি, ওপরের চিলেকোঠা সহ।
এক ঝলক ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস লক্ষ করলাম। আধো অন্ধকারেও চিলেকোঠাটা যেন বেশ উদ্ভাসিত। আর্টিস্টকে বাহবা না দিয়ে পারলাম না তার এই অঙ্কন কুশলতার জন্য, কিন্তু মনের মধ্যে আরেকটা খটকাও লেগে রইল।
Edit Offer
Add tier
Delete your tier
Reviews
Pay By Wallet
Payment Alert
You are about to purchase the items, do you want to proceed?