হ্যালো! মিস বিশ্বাস?”
অচেনা স্বর, কিন্তু বাঙালি উচ্চারণ। “ইয়েস, ’অ্যাম ডক্টর বিসওয়াস। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
কোভিড-এর কড়া লকডাউন আলগা হবার পর, প্রায় রোজই দু’তিনটে নতুন ফোনকল পাই। যাদের সত্যিকারের প্রয়োজন, যারা গৃহবন্দি অবস্থায় কোনও সাহায্য পায়নি, তারা এখন তেড়েফুঁড়ে ফোন করে। আবার অনেকে দীর্ঘদিন ঘরে আটকা থেকে বিপর্যস্ত হয়ে করে। এই মহিলা কোন দলে?
“আপনি বাংলা বলেন?”
আমার ইতিবাচক উত্তর শোনার আগেই ওদিক থেকে তোড়ে কথা ছুটল।
“আমি দেবত্রীর মা, অনসূয়া দাম। আপনার সঙ্গে দেখা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এখনই আসতে চাই। খুব দরকার। কতগুলো বিশেষ কথা আছে।”
দেবত্রী সরকার আমার পেশেন্ট। কয়েক মাস হল আসছে। তার মা? কিন্তু ‘দরকার’ বললেই ছাড়পত্র দিতে হবে নাকি! দেবত্রী নিজের থেকে আমার কাছে আসেনি— বন্ধু মনোবিজ্ঞানী ডাঃ জুলিয়া প্রেন্টিসের সুপারিশে এসেছে। যবে থেকে প্র্যাকটিস আরম্ভ করেছি, জুলিয়া কিছু কিছু রোগী থেরাপির জন্যে পাঠায়। মানসিক রোগে সাইকায়াট্রিস্টরা ওষুধের প্রেসক্রিপশন লেখে ঠিকই, কিন্তু মনের জট খোলার কাজে লাগতে হয় আমাদের। আবার মানসিক ভারসাম্য মোটামুটি থিতু না হলে থেরাপির কাজ করা যায় না। তার জন্যে লাগে ওষুধ। অর্থাৎ আমরা দু’জনেই দু’জনের পরিপূরক। জানি না চিনি না, এক মহিলা ‘কথা আছে’ বললে তো চলবে না… ওঁর মেয়ে যে আমার পেশেন্ট তাও স্বীকার করতে পারি না। গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব আছে আমার
দেবত্রীকে যখন ওর স্বামী জুলিয়ার কাছে নিয়ে গেছিল তখন মেয়েটার বেশ ম্যানিক অবস্থা। মিষ্টি চেহারার ঝকঝকে মেয়ে, চোখেমুখে কথা বলছে— কথার গতিতে মেশিনগানের স্পিড। একই সঙ্গে হাত-পায়ে উইন্ডমিল চলছে। পরে শুনেছি অভিবাসী বাঙালি সমাজে দেবত্রীর বর্ণনা – প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল, আড্ডাবাজ। একটু বেশি বকবক করে ঠিকই, কিন্তু কী পরোপকারী, হাসিখুশি! আর সুন্দর মুখের জয় তো সর্বত্র হবেই। সবার মুখে একটা বিশেষণ বারবার ঘুরেছে – প্রাণবন্ত!
দেবত্রী এদেশে এসেছিল নিউ জার্সির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের স্নাতকোত্তর ছাত্রী হয়ে। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো না হলে হুট করে বৃত্তি পেয়ে কেউ বিদেশ আসতে পারে না – বিশেষ করে আজকের দিনে। আসার কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটা ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্টস্ গ্রুপে একটা সাংস্কৃতিক ফাংশান লাগিয়ে দিল। রবীন্দ্রসংগীত, গীতিনাট্য আর প্রধান অতিথির গলায় মালা-চাদর। দর্শক অভ্যর্থনা করা হল চন্দনের টিপ আর গোলাপজলের ঝারি দিয়ে – সে এক মনোহরা উৎসব। একটা মেয়ে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে জোগাড়যন্ত্র করছে, সহকারীদের মিষ্টি বকুনি দিচ্ছে! সকলেই মুগ্ধ! সেই আসরেই এই অনন্য মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেল অভিবাসী সমাজের দীপ্যমান স্কলার প্রদীপ্ত দে। সে গল্প আমি প্রদীপ্তর কাছে শুনেছি।দিব্যি ঢেউ কেটে চলছিল ওদের ভালবাসার পানসি, কিন্তু বাঙালি মা-বাবা ডেটিং-এর কাল বাড়তে দিলেন না। প্রেমের পরিণতি যে বিবাহ সে কথা প্রদীপ্তকে সমঝিয়ে, কম্যুনিটির আচারানুষ্ঠান বিশারদদের সাহায্য নিয়ে, লালসুতোয় বেঁধে দিলেন দু’জনের হাত। মেয়েটির আপনজন কেউ বিয়েতে আসতে পারেনি। বিদেশ-বিভুঁই, তায় খরচের হ্যাপা বিশাল… এমন তো হতেই পারে!
প্রদীপ্ত বলেছিল, “আমরা হানিমুনে মাউন্ট রাসমোর-এ গেছিলাম। সেই প্রথম মনে হয়েছিল কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। দেবী নিজেই যেতে চেয়েছিল… আমি ভেবেছিলাম হাওয়াই যাব। সেমেস্টার চলাকালীন ছুটি নিয়েছে, তাই দূরে যেতে রাজি হল না। ঠিক হল একটা ভালো লজ-এ থাকব, আর রাসমোর থেকে ড্রাইভ করে গ্র্যান্ড টিটন পার্ক দেখে আসব। সাতদিনের প্রোগ্রাম। যেদিন পৌঁছেছি সন্ধে নেমে গেছিল। পরদিন বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারল না দেবী। শরীর খারাপ? – না; মন খারাপ? – না; রাগ হয়েছে? – না। শুধু চোখ বুজে শুয়ে রইল বিছানা আঁকড়ে। এমনটা চলল ছ’দিন। দু’চোখ বন্ধ, কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। আমি হাতে করে খাইয়ে দিলে একটু মুখে দেয়, নইলে শুধু বাথরুমে যেতে ওঠে। ডাক্তার ডাকতে দেবে না। প্রথমে ভাবলাম মা-বাবার জন্যে দুঃখ হচ্ছে, তারপর মনে হল আমার মা জোর করাতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে – তাই।”
মনে হওয়াই স্বাভাবিক। যে মেয়ে প্রতি মুহূর্তে ফুলঝুরির মতো ঝিকমিক করে সে যদি বাক্যিহারা হয়ে দিনের পর দিন শুয়ে থাকে, তাহলে জবরদস্তি করা হয়েছে মনে তো হবেই! মজার কথা, রাসমোর থেকে ফেরার পথে বিষাদ ফিকে হতে আরম্ভ করল। আগের চাঞ্চল্য ফিরে না পেলেও দেবত্রী সামলে উঠল। ক’দিন পরে এই নতুন দেবত্রীকে অনেক বেশি ম্যাচিয়োর মনে হল প্রদীপ্তর, অনেক বেশি সংযত। কম্যুনিটির মাসিরা মুখ টিপে হাসলেন, ‘বিয়ের জল গায়ে লেগেচে বলে কতা!’
প্রদীপ্তর মনের কোনায় এক টুকরো কালো মেঘ লুকিয়ে ছিল বৈকি, কিন্তু দিনের পর দিন বউয়ের অবিমিশ্র প্রেমের প্রকাশ আর টিপটপ সংসার চালানোয় সেটা হালকা হয়ে মিলিয়ে গেল একদিন। দেবত্রী পড়াশোনা করে, গান গায়, রান্না করে, বাড়িঘর তকতকে রাখে। প্রদীপ্তকে কিচ্ছু করতে হয় না – করতে দেয় না। ওদের ছবির মতো কুহু-কুহু দুঁহু-দুঁহু অ্যাপার্টমেন্ট দেখে বন্ধুরা নিজেদের স্ত্রীদের খোঁটা দেয় আর প্রদীপ্তকে বলে ‘উফ্, তোর বউ কী কাজের রে! দেরিতে বিয়ে করে জিতে গেলি!
দেবত্রী সত্যিই কর্মঠ। অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি কোনা টুথব্রাশ দিয়ে ঘষে; কাঠের মেঝে একবার ঝাড়ু দিয়ে আবার দেয়, তারপর হাঁটু মুড়ে বসে পালিশ করে। থেকে থেকে হাত ধোয়। বলে, ‘আমি রসায়নের ছাত্রী, কী করে সংক্রমণ ছড়ায় ভালোভাবে জানি। সেটি হতে দেব না।’ এই পিটপিটিতে অনেক সময় প্রদীপ্ত অসহায় বোধ করে, আবার ভাবে, ‘ও যদি নোংরা হত, তাহলে কী করতাম? এই ভালো!’ মাঝেমধ্যে মনে পড়ে মাউন্ট রাসমোরের সেই অবোধ্য সপ্তাহ। কী হয়েছিল দেবত্রীর? প্রথমদিকে ভয় পেত আবার যদি তেমন হয়? হয়নি। দু’বছর নিশ্চিন্তে কেটে গেল।
তারপর, বউয়ের মাস্টার্স ডিগ্রি পাওয়ার আনন্দে পার্টি দিল প্রদীপ্ত। সবাইকে আশ্বাস দিল ডক্টরেট পেলে বড় রেস্ট্যুরেন্টে খাওয়াবে।
বিল্ডিংয়ের পেছনে, ছোট্ট একটু জমিতে বার’ব’ক্যিউ পার্টি জমে উঠেছে। বাড়ির লোকজন, বন্ধু-বান্ধব, অন্যান্য আবাসিকরা। হই চই, জমজমাট! সবার হাতে বিয়ার-ওয়াইনের গ্লাস, কাগজের প্লেটে চিকেন, পটাটো স্যালাড, বার্গার, ভুট্টা। বয়স্করা একটু দূরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন – তাদের খাবার সাপ্লাই দিচ্ছে বউরা। এক রাউন্ড চিকেন উড়িয়ে সকলে সামান্য ঢিলে দিয়েছে। হঠাৎ রতনের স্ত্রী শ্যামলী এসে উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল, “ঋষা কোথায়? ওকে দেখছি না যে?”
প্রদীপ্ত তখন গ্রিলের গুরুভার রতনের ঘাড়ে চাপিয়ে আগুনের থেকে সরে গায়ের ঘাম শুকোচ্ছে। রতন ব্যস্ত – বউয়ের উত্তেজনাকে পাত্তা দিল না।
“খেলছিল তো বাচ্চাদের সঙ্গে ওইখানে। দেখো না! হয়তো বাথরুমে গেছে।”
শ্যামলীর গলায় আতঙ্ক, “বাথরুমে গেছে ভেবে ওপরে ঘুরে এসেছি। নেই। দেবত্রীকেও দেখছি না। কোথায় ওরা?