মাতৃত্বের স্বাদ

মাতৃত্বের স্বাদ। অচেনা স্বর, কিন্তু বাঙালি উচ্চারণ। “ইয়েস, ’অ্যাম ডক্টর বিসওয়াস। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
কোভ

হ্যালো! মিস বিশ্বাস?” 

অচেনা স্বর, কিন্তু বাঙালি উচ্চারণ। “ইয়েস, ’অ্যাম ডক্টর বিসওয়াস। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”

কোভিড-এর কড়া লকডাউন আলগা হবার পর, প্রায় রোজই দু’তিনটে নতুন ফোনকল পাই। যাদের সত্যিকারের প্রয়োজন, যারা গৃহবন্দি অবস্থায় কোনও সাহায্য পায়নি, তারা এখন তেড়েফুঁড়ে ফোন করে। আবার অনেকে দীর্ঘদিন ঘরে আটকা থেকে বিপর্যস্ত হয়ে করে। এই মহিলা কোন দলে?

“আপনি বাংলা বলেন?” 

আমার ইতিবাচক উত্তর শোনার আগেই ওদিক থেকে তোড়ে কথা ছুটল। 

“আমি দেবত্রীর মা, অনসূয়া দাম। আপনার সঙ্গে দেখা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এখনই আসতে চাই। খুব দরকার। কতগুলো বিশেষ কথা আছে।”

দেবত্রী সরকার আমার পেশেন্ট। কয়েক মাস হল আসছে। তার মা? কিন্তু ‘দরকার’ বললেই ছাড়পত্র দিতে হবে নাকি! দেবত্রী নিজের থেকে আমার কাছে আসেনি— বন্ধু মনোবিজ্ঞানী ডাঃ জুলিয়া প্রেন্টিসের সুপারিশে এসেছে। যবে থেকে প্র্যাকটিস আরম্ভ করেছি, জুলিয়া কিছু কিছু রোগী থেরাপির জন্যে পাঠায়। মানসিক রোগে সাইকায়াট্রিস্টরা ওষুধের প্রেসক্রিপশন লেখে ঠিকই, কিন্তু মনের জট খোলার কাজে লাগতে হয় আমাদের। আবার মানসিক ভারসাম্য মোটামুটি থিতু না হলে থেরাপির কাজ করা যায় না। তার জন্যে লাগে ওষুধ। অর্থাৎ আমরা দু’জনেই দু’জনের পরিপূরক। জানি না চিনি না, এক মহিলা ‘কথা আছে’ বললে তো চলবে না… ওঁর মেয়ে যে আমার পেশেন্ট তাও স্বীকার করতে পারি না। গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব আছে আমার

দেবত্রীকে যখন ওর স্বামী জুলিয়ার কাছে নিয়ে গেছিল তখন মেয়েটার বেশ ম্যানিক অবস্থা। মিষ্টি চেহারার ঝকঝকে মেয়ে, চোখেমুখে কথা বলছে— কথার গতিতে মেশিনগানের স্পিড। একই সঙ্গে হাত-পায়ে উইন্ডমিল চলছে। পরে শুনেছি অভিবাসী বাঙালি সমাজে দেবত্রীর বর্ণনা – প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল, আড্ডাবাজ। একটু বেশি বকবক করে ঠিকই, কিন্তু কী পরোপকারী, হাসিখুশি! আর সুন্দর মুখের জয় তো সর্বত্র হবেই। সবার মুখে একটা বিশেষণ বারবার ঘুরেছে – প্রাণবন্ত! 

দেবত্রী এদেশে এসেছিল নিউ জার্সির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের স্নাতকোত্তর ছাত্রী হয়ে। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো না হলে হুট করে বৃত্তি পেয়ে কেউ বিদেশ আসতে পারে না – বিশেষ করে আজকের দিনে। আসার কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটা ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্টস্‌ গ্রুপে একটা সাংস্কৃতিক ফাংশান লাগিয়ে দিল। রবীন্দ্রসংগীত, গীতিনাট্য আর প্রধান অতিথির গলায় মালা-চাদর। দর্শক অভ্যর্থনা করা হল চন্দনের টিপ আর গোলাপজলের ঝারি দিয়ে – সে এক মনোহরা উৎসব। একটা মেয়ে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে জোগাড়যন্ত্র করছে, সহকারীদের মিষ্টি বকুনি দিচ্ছে! সকলেই মুগ্ধ! সেই আসরেই এই অনন্য মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেল অভিবাসী সমাজের দীপ্যমান স্কলার প্রদীপ্ত দে। সে গল্প আমি প্রদীপ্তর কাছে শুনেছি।দিব্যি ঢেউ কেটে চলছিল ওদের ভালবাসার পানসি, কিন্তু বাঙালি মা-বাবা ডেটিং-এর কাল বাড়তে দিলেন না। প্রেমের পরিণতি যে বিবাহ সে কথা প্রদীপ্তকে সমঝিয়ে, কম্যুনিটির আচারানুষ্ঠান বিশারদদের সাহায্য নিয়ে, লালসুতোয় বেঁধে দিলেন দু’জনের হাত। মেয়েটির আপনজন কেউ বিয়েতে আসতে পারেনি। বিদেশ-বিভুঁই, তায় খরচের হ্যাপা বিশাল… এমন তো হতেই পারে!

প্রদীপ্ত বলেছিল, “আমরা হানিমুনে মাউন্ট রাসমোর-এ গেছিলাম। সেই প্রথম মনে হয়েছিল কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। দেবী নিজেই যেতে চেয়েছিল… আমি ভেবেছিলাম হাওয়াই যাব। সেমেস্টার চলাকালীন ছুটি নিয়েছে, তাই দূরে যেতে রাজি হল না। ঠিক হল একটা ভালো লজ-এ থাকব, আর রাসমোর থেকে ড্রাইভ করে গ্র্যান্ড টিটন পার্ক দেখে আসব। সাতদিনের প্রোগ্রাম। যেদিন পৌঁছেছি সন্ধে নেমে গেছিল। পরদিন বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারল না দেবী। শরীর খারাপ? – না; মন খারাপ? – না; রাগ হয়েছে? – না। শুধু চোখ বুজে শুয়ে রইল বিছানা আঁকড়ে। এমনটা চলল ছ’দিন। দু’চোখ বন্ধ, কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। আমি হাতে করে খাইয়ে দিলে একটু মুখে দেয়, নইলে শুধু বাথরুমে যেতে ওঠে। ডাক্তার ডাকতে দেবে না। প্রথমে ভাবলাম মা-বাবার জন্যে দুঃখ হচ্ছে, তারপর মনে হল আমার মা জোর করাতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে – তাই।”

মনে হওয়াই স্বাভাবিক। যে মেয়ে প্রতি মুহূর্তে ফুলঝুরির মতো ঝিকমিক করে সে যদি বাক্যিহারা হয়ে দিনের পর দিন শুয়ে থাকে, তাহলে জবরদস্তি করা হয়েছে মনে তো হবেই! মজার কথা, রাসমোর থেকে ফেরার পথে বিষাদ ফিকে হতে আরম্ভ করল। আগের চাঞ্চল্য ফিরে না পেলেও দেবত্রী সামলে উঠল। ক’দিন পরে এই নতুন দেবত্রীকে অনেক বেশি ম্যাচিয়োর মনে হল প্রদীপ্তর, অনেক বেশি সংযত। কম্যুনিটির মাসিরা মুখ টিপে হাসলেন, ‘বিয়ের জল গায়ে লেগেচে বলে কতা!’ 

প্রদীপ্তর মনের কোনায় এক টুকরো কালো মেঘ লুকিয়ে ছিল বৈকি, কিন্তু দিনের পর দিন বউয়ের অবিমিশ্র প্রেমের প্রকাশ আর টিপটপ সংসার চালানোয় সেটা হালকা হয়ে মিলিয়ে গেল একদিন। দেবত্রী পড়াশোনা করে, গান গায়, রান্না করে, বাড়িঘর তকতকে রাখে। প্রদীপ্তকে কিচ্ছু করতে হয় না – করতে দেয় না। ওদের ছবির মতো কুহু-কুহু দুঁহু-দুঁহু অ্যাপার্টমেন্ট দেখে বন্ধুরা নিজেদের স্ত্রীদের খোঁটা দেয় আর প্রদীপ্তকে বলে ‘উফ্‌, তোর বউ কী কাজের রে! দেরিতে বিয়ে করে জিতে গেলি!

দেবত্রী সত্যিই কর্মঠ। অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি কোনা টুথব্রাশ দিয়ে ঘষে; কাঠের মেঝে একবার ঝাড়ু দিয়ে আবার দেয়, তারপর হাঁটু মুড়ে বসে পালিশ করে। থেকে থেকে হাত ধোয়। বলে, ‘আমি রসায়নের ছাত্রী, কী করে সংক্রমণ ছড়ায় ভালোভাবে জানি। সেটি হতে দেব না।’ এই পিটপিটিতে অনেক সময় প্রদীপ্ত অসহায় বোধ করে, আবার ভাবে, ‘ও যদি নোংরা হত, তাহলে কী করতাম? এই ভালো!’ মাঝেমধ্যে মনে পড়ে মাউন্ট রাসমোরের সেই অবোধ্য সপ্তাহ। কী হয়েছিল দেবত্রীর? প্রথমদিকে ভয় পেত আবার যদি তেমন হয়? হয়নি। দু’বছর নিশ্চিন্তে কেটে গেল। 

তারপর, বউয়ের মাস্টার্স ডিগ্রি পাওয়ার আনন্দে পার্টি দিল প্রদীপ্ত। সবাইকে আশ্বাস দিল ডক্টরেট পেলে বড় রেস্ট্যুরেন্টে খাওয়াবে।

বিল্ডিংয়ের পেছনে, ছোট্ট একটু জমিতে বার’ব’ক্যিউ পার্টি জমে উঠেছে। বাড়ির লোকজন, বন্ধু-বান্ধব, অন্যান্য আবাসিকরা। হই চই, জমজমাট! সবার হাতে বিয়ার-ওয়াইনের গ্লাস, কাগজের প্লেটে চিকেন, পটাটো স্যালাড, বার্গার, ভুট্টা। বয়স্করা একটু দূরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন – তাদের খাবার সাপ্লাই দিচ্ছে বউরা। এক রাউন্ড চিকেন উড়িয়ে সকলে সামান্য ঢিলে দিয়েছে। হঠাৎ রতনের স্ত্রী শ্যামলী এসে উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল, “ঋষা কোথায়? ওকে দেখছি না যে?” 

প্রদীপ্ত তখন গ্রিলের গুরুভার রতনের ঘাড়ে চাপিয়ে আগুনের থেকে সরে গায়ের ঘাম শুকোচ্ছে। রতন ব্যস্ত – বউয়ের উত্তেজনাকে পাত্তা দিল না। 

“খেলছিল তো বাচ্চাদের সঙ্গে ওইখানে। দেখো না! হয়তো বাথরুমে গেছে।”

শ্যামলীর গলায় আতঙ্ক, “বাথরুমে গেছে ভেবে ওপরে ঘুরে এসেছি। নেই। দেবত্রীকেও দেখছি না। কোথায় ওরা?

সামান্য দূরে দাঁড়ানো প্রদীপ্তর কানে গেল প্রশ্নটা। একটা অজানা আতঙ্ক মুঠো পাকালো বুকের ঠিক মাঝখানে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে খুঁজল দেবীকে – নেই। সত্যি তো, গেল কোথায়? একটু আগেই দেখেছে! একগুচ্ছ বাচ্চা খেলছে হুটোপাটি করে, তাদের মধ্যে ঋষাকে খুঁজল – নেই। কোনদিকে যেতে পারে ভাবতে ভাবতে প্রদীপ্ত এগিয়ে গেল ব্যাকইয়ার্ড ফেলে সামনের দিকে। ঋষা কি দেবত্রীর সঙ্গে? শ্যামলী গেল বাচ্চাদের দিকে। চাপা গলায় ওদের কী জিজ্ঞেস করল ভালো শোনা গেল না, তবে তীক্ষ্ণ কচি গলার উত্তর ভেসে এল কানে, “ডেভি আন্টি টুক হার। দে ওয়েন্ট দ্যাট-আ-ওয়ে।”

বাচ্চাটার দিকে এক লহমা তাকিয়ে দৌড়তে আরম্ভ করল প্রদীপ্ত। পেছনে ছুটে আসছে শ্যামলী – গলা থেকে অদ্ভুত কাকুতি বেরোচ্ছে, “প্রদীপ্তদা!… প্রদীপ্তদা…! ঋষা…!” 

ততক্ষণে পার্টির কয়েকজন কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। রতনও হাতের লম্বা খুন্তি ফেলে এদিকেই আসছে। এবারের চিকেনগুলো নির্ঘাত পুড়বে! প্রদীপ্ত দৌড়ে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাইরের বড়রাস্তায় পড়ে বাঁদিকে মোড় নিল। রতনের দিকে ডানহাতের আঙুল তুলে নির্দেশ ছুঁড়ল, “তুই ওদিকে যা!” শ্যামলীও ছুটল রতনের সঙ্গে।

চার লেনের চওড়া রাস্তা, হাইওয়ে নয় ঠিকই কিন্তু খুবই ব্যস্ত। অজস্র গাড়ি দু’দিকে ছুটে চলেছে। আসা-যাওয়ার দিক ভাগ করতে মাঝখানে রয়েছে সরু ডিভাইডার। রাস্তার লেভেল থেকে সামান্য উঁচু, সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। দু’পাশে সরু ফুটপাথ – এদেশের ভাষায় সাইডওয়াক। প্রদীপ্ত দৌড়ে চলল একদিকের ফুটপাথ ধরে। 

একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে কতদূর যেতে পারে দেবত্রী? ঋষাকে আদৌ নিয়েছে কি? ওরা সবাই মিলে মিথ্যে সন্দেহে ছুটোছুটি করছে না তো! কিন্তু ওই বাচ্চাটা যে বলল দেবী-আন্টি নিয়েছে? হয়তো ঋষাকে কোনও কারণে ডেকেছিল দেবী, তারপর নিজে কিছু আনতে গেছে বা অন্য কারোর বাড়ি গিয়ে বসে আছে! হয়তো এত হট্টগোল ভালো লাগছে না! দৌড়তে দৌড়তে ধন্ধের দোলায় দুলতে লাগল প্রদীপ্ত। আর যদি দেবীকে পায় আর ঋষা সঙ্গে না থাকে? অদ্ভুত এক স্বস্তি এল মনে! 

ফিরে যাবে কি? ভাবতে ভাবতেই প্রদীপ্ত দেখল রাস্তার দু’দিকের ফুটপাথে মানুষের জটলা, সকলেই তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। এমার্জেন্সি ব্লিঙ্কার জ্বালিয়ে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে রাস্তার ধারে। আর… আর… রাস্তার ডিভাইডারের ওপর শাড়ি পরা দেবত্রী, একটা ছোট্ট বাচ্চার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে হেঁটে যাচ্ছে। বাচ্চাটা যেতে চাইছে না, হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছে, কাঁদছে তারস্বরে। ঋষা! দু’দিকের ছুটন্ত গাড়িগুলো স্পিড কমিয়েছে, যেন অ্যাক্সিডেন্ট হবেই জেনে সকলে সন্তর্পণে এগোচ্ছে। কয়েকটা গাড়ির শার্শি নামিয়ে যাত্রীরা কী সব বলছে বিশ্রী সুরে।

এক মুহূর্ত দেরি করল না প্রদীপ্ত। কোনও দিকে না তাকিয়ে, ছুট্টে রাস্তা পার হয়ে পৌঁছল মিডিয়ানের ওপর – চট করে কোলে তুলে নিল ঋষাকে। দেবত্রী অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল। 

“ওমা, তুমি এসে গেছ? মনে মনে খুব চাইছিলাম – আসার সময় মাংস রাঁধছ দেখে আর বিরক্ত করিনি। আমার ইচ্ছার কী জোর দেখো! আসলে জন্ম থেকেই একটা অতিমানবীয় শক্তি আমার আছে। তুমি নিশ্চয়ই সেটা আগেই টের পেয়েছ! কোত্থেকে যে এল জানি না…”

কাকুর গলা জড়িয়ে কাঁদছে ঋষা – ওকে এক হাতে জড়িয়ে অন্য হাতে স্ত্রীর কবজি চেপে ধরল প্রদীপ্ত। সঙ্গে সঙ্গে দু’টো হাত কোল থেকে টেনে নিল ঋষাকে – রতন আর শ্যামলী এসে পড়েছে। রতনের মুখে ঝড়ের চিহ্ন, শ্যামলীর দু’চোখে জলের ধারা। 

“প্রদীপ্ত, এখন বাড়ি যাই। পরে কথা হবে।”

শ্যামলীকে দেখে খুশিতে উদ্বেল হল দেবত্রী, “এত তাড়াতাড়ি যাবি কেন রে? আর একটু গল্প করি চল… পার্টিতে ফিরবি না? …স্যাম, তুই কাঁদছিস নাকি? রতন বকেছে?” 

রতনের মুখ লাল, চোয়াল কঠিন। রাগে দুঃখে শ্যামলী ফুঁপিয়ে উঠল, “তুই না বলে ঋষাকে এখানে নিয়ে এলি কেন?”

দেবত্রীকে হতচকিত দেখাল। “কেন রে? মনে হল ঋষার একটু খোলা বাতাস দরকার। ওখানে যা ভিড়! বাচ্চাগুলো অসভ্যের মতো ধাক্কাধাক্কি করছে। তাই ওকে নিয়ে ফাঁকাফাঁকায় হাঁটছিলাম।” 

বার’ব’ক্যিউ না খেয়েই কিছুক্ষণের মধ্যে নিমন্ত্রিতরা বিদায় নিল। সন্ধেয় পুলিশ এল প্রদীপ্তের সঙ্গে কথা বলতে। কে যেন পুলিশকে জানিয়েছে। প্রদীপ্তর বাড়িতে ওর মা-বাবা তখনও রয়েছেন। পুলিশ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল, আর সামনে বসে দেবত্রী বিশাল হাঁ করে বড় বড় হাই তুলতে লাগল ক্রমাগত। 

“আই অ্যাম সরি, অফিসারস। আজ আমার গ্র্যাজুয়েশন পার্টি ছিল, তাই খুব ক্লান্ত। তোমরা আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বল। আর ফাউ হিসেবে রেখে গেলাম আমার ইন-ল’দের।” এক গাল হেসে, চোখ টিপে, পাশের ঘরে গিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দেবত্রী। 

পুলিস অফিসারেরা কতটা হতভম্ব হয়েছে বোঝা গেল না। মুখের অভিব্যক্তিতে মনের আবেগ না দেখানোর ট্রেনিং নেয় ওরা। শুধু প্রদীপ্তকে জানিয়ে গেল, এই মুহূর্তে মিসেস সরকারের নামে কোনও অভিযোগ লিখছে না এক শর্তে – এক সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে যেতে হবে। পরের সপ্তাহে এসে ওরা খোঁজ নেবে। সেই সন্ধিক্ষণেই জুলিয়া প্রেন্টিসের মঞ্চে আগমন আর তার ল্যাজ ধরে আমি।

থেরাপিতে যেমন হয়… এর মধ্যে প্রদীপ্ত আর ওর মা-বাবার সঙ্গে অন্তত কয়েক ঘণ্টার যুগ্ম সেশন হয়েছে। ততদিনে জুলিয়া প্রেন্টিস নিদান দিয়েছে দেবত্রী ‘বাইপোলার’ মানসিক অসুখে ভুগছে। অস্বাভাবিক উদ্দীপনা আর গভীর অবসাদের পরপর ঢেউ এই রোগেরই লক্ষণ। আমারও তাই মত। বাইপোলার রোগীরা হঠাৎ হঠাৎ স্বল্পমেয়াদের জন্যে বাস্তবজ্ঞানও হারিয়ে ফেলে, বিশেষত চিকিৎসা না করালে। ঋষাকে ‘বেড়াতে’ নেবার ঘটনা তারই নিদর্শন। 

প্রদীপ্তর মা’র প্রথম ও শেষ কথা, ‘ওদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দিন। দেবত্রী অসুস্থ… এ বিয়ে বৈধ হতে পারে না।’ বিয়েটা যে ওঁর ছেলে করেছে এবং তার মতামত কী, সে ব্যাপারে উনি সম্পূর্ণ উদাসীন। অনেক চেষ্টা করেও ওঁকে বোঝাতে পারলাম না, এই ডায়াগনোসিস হওয়া মানে জীবনপ্রবাহ থেকে বিদায় নেওয়া নয়। ওষুধ আর থেরাপির সাহায্যে দেবত্রী ভালোই পড়াশোনা, ঘরসংসার, কাজকর্ম সামলাতে পারবে – এতদিন যেমন করেছে। তবে হ্যাঁ, কিছু সাবধানতা মেনে চলতেই হবে। খুব উঁচুমাত্রার উত্তেজনা, ট্রমা, মানসিক চাপ যতটা পারে এড়িয়ে চলাই ভালো। কিন্তু প্রদীপ্তর পরিবার সে সব শুনতে নারাজ। শেষে ছেলেই সমস্যার সমাধান করল। পরিষ্কার জানাল, ‘বিপদের সময় দেবীকে ছেড়ে যেতে ও পারবে না।’ ব্যাস, তর্কাতর্কির আপাত-সমাপ্তি। এই ক’হপ্তা আগে সে সব মিটেছে, এখন আবার আরেক মা এসে উপস্থিত? 

কী করে মহিলাকে ফিরিয়ে দেব ভাবছি, দেখি মায়ের সঙ্গে দেবত্রী এসেছে। বুঝলাম মা’র কাছে গোপনীয়তা ভাঙতে মেয়ের আপত্তি নেই। মহিলা সদ্য কলকাতা থেকে এসেছেন – প্রচণ্ড মারমুখী। কোনও ভণিতায় গেলেন না। 

“আপনি প্রদীপ্তকে বলবেন ওদের একটা বাচ্চা দরকার। সেটার ব্যবস্থা করতে চাপ দিন। দেবীমা’র একটা সন্তান হলে সব ঠিক হয়ে যাবে আর ওদের জীবনটাও দানা বাঁধবে। সেটাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”

চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে আছে দেবত্রী, ঘাড় তুলে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। মা’র শৌর্যের সামনে সম্পূর্ণ পরাভূত সে। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মা’কে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, দেবত্রীর জীবনে মাতৃত্ব আরও কিছুদিন সরিয়ে রাখা দরকার। সেই নতুন চাপে তার ক্ষতি হতে পারে। আর মাতৃত্বই মেয়েদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। দেবত্রীর পক্ষে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু মহিলা নাছোড়বান্দা। বলে চললেন তাঁর বোন, দেবত্রীর মাসি, একই রকম প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ছিল, একই রকমের বিন্দাস। বাচ্চা হবার পর কী ভীষণ দায়িত্বশীল এখন — কথা কম বলে, ধীরে হাঁটে, ইত্যাদি। দূর থেকে রোগনির্ণয় করা মুশকিল, তবে মনে হল, দেবত্রীর পরিবারে ম্যানিয়া আর ডিপ্রেশন হয়তো একেবারে অপরিচিত নয়। 

শেষে আর না পেরে, যাকে নিয়ে এত কথোপকথন, তার দিকে তাকালাম, “তুমি কী ভাবছ, দেবত্রী?” 

দু’হাতের আঙুল সাঁড়াশির মতো নিজেদের আঁকড়ে ধরেছে, মুখের প্রতিটি শিরা উপশিরা টানটান, ঠোঁট শাদা। দেবত্রী চোখ তুলল না। “আমি বাচ্চা ভালোবাসি। একটা বাচ্চা হলে খুব ভালো লাগবে।” 

পেশেন্টের কাছ থেকে এমন উপরোধ আগে শুনিনি তা নয়। তবু আশঙ্কার শৈত্য নামল শরীরে। “এ বিষয়ে পরের দিনে আলোচনা করব, কেমন?” 

সেই পরের দিন আর আসেনি। দেবত্রী আমার কাছে আসা ছেড়ে দিল। নিজের কম্যুনিটির মেয়ে বলে হয়তো নীতির বাইরে গিয়েই বেশ কয়েকবার ওর খোঁজ করেছি। বারবার ‘আসব’ বলেও আসেনি। বাধ্যতামূলক চিকিৎসার শর্তপূরণ হয়ে গিয়েছিল বলে পুলিশও আর তাড়া লাগায়নি। বড় বড় খুন-রাহাজানি মেটাতে তারা ব্যস্ত!

সময় গড়িয়ে গেল সময়ের নিয়মে। দেড় বছরে আমিও ভুলে গেলাম এক বাঙালি মেয়ের মানসিক দুর্গমতার লড়াই। তারপর, এক কাকভোরে সবকিছু মনে করিয়ে দিল একটা ফোনকল।

পুলিশই ডাক দিল। হুড়মুড়িয়ে ছুটে গেলাম মাউন্টেন রিজ পার্কে। অত ভোরে শুধু পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে – আর কিছু কর্মব্যস্ত এমার্জেন্সি কর্মী। মার্চের শীত তখনও জাঁদরেল। গাছগুলো পত্রহীন। একটু দূরে, দু’হাঁটুর মধ্যে মাথা নামিয়ে বেঞ্চে বসে আছে দেবত্রী, ওর কাছে দাঁড়িয়ে দু’জন মহিলা পুলিশ অফিসার। কী ঘটেছে জিজ্ঞেস করার আগে, তাদেরই একজন আমার দিকে এগিয়ে এল। 

“আর ইউ হার থেরাপিস্ট?”

“আগে ছিলাম, অনেকদিন ড্রপ করেছে। যাহোক, কী হয়েছে?” 

“হার হাসব্যান্ড ইজ অন এ বিজনেস ট্রিপ। পাঁচ মাসের বাচ্চাকে নিয়ে মা একা বাড়িতে ছিল। রাতে বোধহয় বাচ্চাটা কাঁদছিল, তাই পার্কে এনে সারারাত একটা দোলনায় বসিয়ে দুলিয়েছে। ভোরে এক জগার দেখে ৯১১ কল করেছে। হোয়েন উই কেম, দ্য বেবি ওয়াজ স্টিল অন দ্য সুইং। নাও উই আর ট্রায়িং টু রিভাইব হার।”  

বোঁ করে মাথা ঘুরে গেল! অফিসার হাত বাড়িয়ে ধরলেন, পায়ের তলার মাটি দৃঢ় হল। দেখলাম এক এমার্জেন্সি-কর্মী সেই অফিসারের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা নাড়াল। ছাদে লাল-নীল বাতি জ্বালিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা হুস করে বেরিয়ে গেল পার্ক থেকে। পুলিশ অফিসার দু’চোখ বন্ধ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। “দ্য বেবি ইজ গন…। নাউ, লেটস টক টু দ্য মাদার।” 

দু’পা সিমেন্টে গাঁথা – অতি কষ্টে টেনেটেনে এগিয়ে হাত রাখলাম দেবত্রীর পিঠে। বরফ-জমা শীতে শুধু একটা পাতলা সোয়েটার পরা। বাচ্চাটাকে কী পরিয়েছিল? জোর করে সরিয়ে দিলাম ভাবনাটা। 

“দেবী, এই অফিসাররা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। চল, বাড়ির ভেতরে গিয়ে বসি। ওঠো…” 

দেবত্রী উঠল না। দেখলাম, ওর চারদিকে একটা হালকা প্রজাপতি ফুরফুর করে উড়ে বেড়াচ্ছে! সেই দুর্বার হাওয়ার ঝাপটা সহ্য করার মত শক্তি আমার নেই।


somrat222

10 Blog posts

Comments