নবুয়ত ও হযরত খাদীজা (রা)

মহিলাদের মাঝে প্রথম ইসলাম গ্রহনকারী মুসলিম নারী হযরত খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহু

একা একা চুপচাপ চিন্তা করা হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর অভ্যাস। এ অভ্যাস সেই ছোটবেলা থেকেই। তিনি খেলাধুলা তেমন পছন্দ করতেন না। 

 

চুপচাপ থেকে কেবলই কি যেন ভাবতেন। এটাই ছিল তাঁর স্বভাব। বিয়ের পর তিনি এই সুযোগটা বেশি পেলেন।

 

ব্যবসা-বাণিজ্য, টাকা-কড়ি, আরাম-আয়েশ কোন কিছুই তাঁর ভালো লাগে না। সংসারের কাজ-কর্মের ফাঁকে সুযোগ পেলেই মুহাম্মদ (সা) হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় চলে যান। 

 

সেখানে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হন। ধ্যান ভেঙ্গে গেলে বাড়ি ফিরে আসেন। এভাবে তাঁর হেরা গুহায় যাতায়াত শুরু হলো।

 

বুদ্ধিমতী খাদীজা (রা) স্বামীর মনের ভাব বুঝতে পারেন। তাঁর স্বামী কি যেন এক অজানা রহস্য তালাশ করছেন। তিনি তাঁর স্বামীর গতিবিধি লক্ষ্য করেন। স্বামীর কোন কাজে তিনি বাধা দেন না।

 

 স্বাধীনভাবে সব কিছু করতে দেন। ভুলেও তিনি কখনও স্বামীকে কোন প্রশ্ন করেন না। বরং স্বামীর এই কাজে তিনি সাহায্য ও সহযোগিতা করতে লাগলেন। স্বামী যা করতে বলেন, খাদীজা (রা) তাই করেন। এ ব্যাপারে টু শব্দটি পর্যন্ত তিনি করেন না।

 

হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর পার হলো। ঘরে থাকতে তাঁর আর মোটেই ভালো লাগে না। তিনি হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। গুহায় যাবার সময় হযরত খাদীজা (রা) দু'তিন দিনের খানা-পিনা তৈরি করে স্বামীকে দিয়ে দেন। খানা নিয়ে আনন্দচিত্তে স্বামী হেরা গুহায় চলে যান। 

 

খাবার শেষ হলে আবার এসে নিয়ে যান।

 

মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে যাওয়া তাঁর বাদ পড়ে যেত। বিচক্ষণ খাদীজা (রা) হিসেব রাখতেন, কবে কখন স্বামীর খাবার শেষ হবে। 

 

নির্দিষ্ট সময়ে যদি স্বামী গৃহে ফিরে না আসেন, খাদীজা তখন নিজেই খাদ্য-খাবার নিয়ে গুহায় চলে যান। স্বামীকে খাবার দিয়ে আসেন।

 

হেরা পর্বতকে বর্তমানে 'জাবালে নূর' বলে। একজন নারীর পক্ষে সেই হেরা গুহায় খাদ্য নিয়ে যাওয়া কি আর মুখের কথা? হযরত খাদীজা (রা)-এর বাড়ি থেকে

 

হেরা পর্বত প্রায় দেড় দু'মাইল দূর। গুহাটি আবার পাহাড়ের উপরে। পাহাড়ের গায়ে খাড়া পথ বেয়ে উপরে উঠে গেছে। এই পথ ধরে উপরে সেই গুহায় যেতে হয়।

 

 সেখানে উঠতে ও নামতে খাদীজা (রা)-এর কতই না কষ্ট হতো। তবুও এসব কষ্টকে তিনি কষ্ট মনে করতেন না। সব উপেক্ষা করে স্বামী ওখানে কি অসহায় আছেন তার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যে তিনি গুহায় যেতেন।

 

খাদীজা (রা) বাড়িতে থাকলেও তাঁর মন সব সময় স্বামীর নিকট হেরা পর্বতের গুহায় পড়ে থাকতো। হেরা পর্বতের দিকে তিনি সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতেন।

 

এমনিভাবে একদিন নয়, দু'দিন নয়, দীর্ঘ পাঁচটি বছর কেটে গেল। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর বয়স চল্লিশ পুরা হলো।

 

রমজান মাস।

 

হযরত মুহাম্মদ (সা) রাত-দিন আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন। কয়েকদিন হলো ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে তাঁর দিন কাটছে। কে যেন তাঁর কানে কানে বলে যাচ্ছেন: হে মুহাম্মদ! তুমি আল্লাহর রাসূল।

 

তিনি চোখ মেলে চারদিক দেখেন-কেউ নেই। তিনি আবার চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন হন। আবার কে যেন এসে একই কথা কানে কানে বলেন। তিনি আবার চোখ মেলে দেখেন। না, কেউ নেই। পুনরায় চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন হন। পেলেন

 

রাত গভীর। হযরত মুহাম্মদ (সা) ধ্যানে মগ্ন। এমন সময় হঠাৎ শুনতে কে যেন তাঁকে ডাকছেন: মুহাম্মদ। তাঁর ধ্যান ভেঙ্গে গেল। 

 

তিনি চোখ মেলে দেখলেন-একজন জ্যোতির্ময় পুরুষ তাঁর সম্মুখে দাঁড়ানো। তাঁর জ্যোতিতে অন্ধকার গুহা আলোকিত হয়ে গেছে। মুহাম্মদ (সা) ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর মুখ দিয়ে আর কোন শব্দ বের হচ্ছে না।

 

 গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। নির্বাক হয়ে তিনি শুধু লোকটির দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ ফেরাতে পারছেন না। লোকটি স্নিগ্ধ হেসে বললেন: আপনি পাঠ করুন!

 

 মুহাম্মদ (সা) কাঁপতে কাঁপতে বললেন: আমি তো পড়তে জানি না।

 

লোকটি মুহাম্মদ (সা)-এর হাত ধরে দাঁড় করালেন। তাঁর বুকে বুক লাগিয়ে একটু জোরে চাপ দিলেন। এতে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মনে হলো যেন তাঁর সমস্ত দেহ,

 

 আলোকময় হয়ে গেল। লোকটি পুনরায় তাঁকে বললেন: পাঠ করুন। এবারও তিনি আগের মত উত্তর দিলেন: আমি পড়তে জানি না।

 

লোকটি আবার মুহাম্মদ (সা)-কে বুকে চেপে ধরলেন। এভাবে লোকটি তিন বার বুকে চাপ দেয়ার পর মুহাম্মদ (সা)-এর জ্ঞানের দ্বার খুলে গেল।

 

তারপর লোকটি বললেন: ইক্রা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালক। অর্থ : পাঠ করুন, আপনার সেই আল্লাহর নামে যিনি (সমস্তই) সৃষ্টি করেছেন......। 

 

কী আশ্চর্য। এবার হযরত মুহাম্মদ (সা) লোকটি বলার সাথে সাথে পড়তে। লাগলেন। একটুও অসুবিধা হলো না। কিন্তু পড়ার পর লোকটি গুহা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

 

 এবার হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর চৈতন্য ফিরে এলো। তিনি গুহার বাইরের দিকে তাকালেন, দেখলেন আকাশপথে লোকটি তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর ভীষণ ভয় হতে লাগল। তিনি ভীত হয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে ছুটলেন।

 

ছুটতে ছুটতে তিনি বাড়িতে এলেন। কিন্তু দরজা বন্ধ। তিনি সজোরে দরজায় খট্ খট্ আওয়াজ করলেন। দরজায় খট্ খট শব্দ শুনে ঘুমন্ত খাদীজা চমকে উঠলেন।

 

 এত রাতে দরজায় কে কড়া নাড়ে? আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি দরজার নিকট এলেন। কে যেন কড়া নাড়ছেন আর কম্পিত স্বরে ডাকছেনঃ খাদীজা! খাদীজা! দরজা খোল।

 

প্রথমে খাদীজা (রা) বুঝতে পারেন নি। ঘুমের ঘোর কাটার পর তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর স্বামী মুহাম্মদ (সা) ডাকছেন। তারপর খাদীজা (রা) তাড়াতাড়ি দরজা খুললেন। স্বামীকে দেখে তিনি আশ্চর্য! কী ব্যাপার? আপনি কাঁপছেন কেন? কি হয়েছে আপনার?

 

কাঁপতে কাঁপতেই হযরত মুহাম্মদ (সা) বললেন: খাদীজা! জলদী আমাকে কম্বল দিয়ে ঢাক। আমার ভয় হচ্ছে।

 

খাদীজা কালবিলম্ব না করে, স্বামীকে বিছানায় শুইয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর তিনি স্বামীকে অভয় সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।

 

 একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি সমস্ত ঘটনা খাদীজাকে খুলে বললেন। কিন্তু তখনও হযরত মুহাম্মদ (সা) সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ লোকটিকে দেখতে পাচ্ছেন। লোকটি তাকে বললেন: হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহ্র রাসূল! আর আমি জীবরাঈল!

 

কি

 

এই ঘটনা শোনার পর হযরত খাদীজা (রা) বুঝতে পারছেন না যে, তাঁর স্বামী ফেরেশতার কবলে পড়েছেন না শয়তানের কবলে পড়েছেন? এটা

 

প্রথমে খাদীজা (রা) তাঁর স্বামীকে বিছানা থেকে তুলে বসালেন। তারপর নিজের বাম উরুর উপর স্বামীকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: এখন কি আপনি কাউকে দেখতে পাচ্ছেন?

 

হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেন: হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি।

 

তখন খাদীজা (রা) স্বামীকে ডান উরুর উপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখনও কি তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন?

 

স্বামী বললেন: হ্যাঁ, এখনও তাঁকে দেখতে পাচ্ছি।

 

এবার খাদীজা (রা) স্বামীকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

 

স্বামী ঐ একই উত্তর দিলেন। খাদীজা (রা) এবার তাঁর মাথার ওড়না ফেলে দিয়ে শরীরটাকে একটু উন্মোচন করে বললেন: এবার কি দেখতে পাচ্ছেন?

 

স্বামী মুহাম্মদ (সা) বললেন: না। এখন আর তাকে দেখতে পাচ্ছি না।

 

খাদীজা (রা) আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বামীকে বললেন: আপনার কোন ভয় নেই। আপনি একটুও ভয় করবেন না, চিন্তাও করবেন না। আপনি যাকে দেখেছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোন ফেরেশতা, শয়তান নয়। শয়তান হলে এখনও সে আমার প্রতি তাকিয়ে থাকতো।

 

কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর ভয় দূর হলো না। তিনি কম্বল গায়ে দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পড়লেন। স্বামীর এরূপ অবস্থা দেখে খাদীজা (রা) স্থির থাকতে পারলেন না। 

 

স্বামীকে নিয়ে তিনি তাঁর চাচাত ভাই ওয়ারাকার নিকট গেলেন। তিনি ছিলেন প্রবীণ খৃস্টান পণ্ডিত। তওরাত ও ইনজিল কিতাবে তিনি ছিলেন বিজ্ঞ।

 

 তাঁকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। ঘটনা শুনে আনন্দে উল্লসিত হয়ে তিনি বললেন: কুদ্দুসুদ। কুদ্দুসুন।। (পবিত্র! পবিত্র !!) চিন্তার কোন কারণ নেই বোন।

 

 মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল হবে। আর যাঁকে দেখছেন, তিনি হলেন আল্লাহর ফেরেশতা। পূর্ববর্তী রাসূলগণের নিকট যে নমুসে আকবর (বড় ফেরেশতা) আসতেন, তিনিই মুহাম্মদ (সা)-এর নিকট আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছেন।

 

 পূর্ববর্তী নবীদের বেলায়ও এরূপ ঘটত। খাদীজা। তোমার স্বামী নিশ্চয়ই শেষ নবী। এতে কোন সন্দেহ নেই।

 

 

তারপর ওয়ারাকা ভাবাবেগ কণ্ঠে বললেনঃ হে মুহাম্মদ। তোমার দেশবাসী চার করবে নির্যাতন করবে। এমন কি তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে

 

দিতে পারে। কারণ, প্রতিটি নবী-রাসূলকে তাঁর দেশবাসী অত্যাচার করেছে, নির্যাতন করেছে, দুঃখ-কষ্ট দিয়েছে। 

 

কোন নবী-রাসূলই এসব থেকে রেহাই পান নি। তোমাকেও তারা রেহাই দেবে না। আমি যদি সেই সমস্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকি তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করবো।

 

একথা বলে পরম শ্রদ্ধার সাথে ওয়ারাকা মুহাম্মদ (সা)-এর কপালে চুমু দিলেন। এই ঘটনার কিছুকাল পর ওয়ারাকা ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে নবীজীর 

 

ভবিষ্যতের বিপদ আপদ ও দুঃখ-কষ্টের কথা চিন্তা করে তিনি বার বার আফসোস করেছিলেন।

 

স্বামী আল্লাহর রাসূল হবেন একথা শুনে হযরত খাদীজা (রা)-এর মনে আনন্দ আর ধরে না। তিনি আর বিলম্ব না করে স্বামীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। হযরত মুহাম্মদ (সা) এবার শান্ত হলেন। তাঁর ভয়ভীতি সব দূর হয়ে গেলো।

 

বলতে পার সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ লোকটি কে? তিনি হলেন আল্লাহ তা'আলার বাণীবাহক ফেরেশতা হযরত জীবরাঈল (আ)। 

 

তিনি মানুষের সুরত ধরে আল্লাহ্ তা'আলার বাণী নিয়ে হেরা পর্বতের গুহায় এসেছিলেন।

 

তারপর সেই মানুষরূপী ফেরেশতাটির আগমনের জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সা) অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 

এভাবে আশায় আশায় থাকতে থাকতে প্রায় ছয় মাস গত হলো। কিন্তু সেই ফেরেশতা আর আসেন না। হযরত মুহাম্মদ (সা) ভাবলেন, কোন ভুলত্রুটি হয়েছে বোধ হয়, তাই আল্লাহ্ নারাজ হয়ে তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। তাঁর অন্তরে এইরূপ নানান কথার উদয় হতে লাগলো।

 

একদিন হঠাৎ সেই ফেরেশতা এসে হাযির। সব সন্দেহ দূর হলো। আনন্দে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মন ভরে গেলো। হযরত জীবরাঈল (আ) তাঁকে আল্লাহর বাণী শোনালেন। হযরত মুহাম্মদ (সা) নবুয়ত পেলেন এবং আল্লাহর রাসুল নিযুক্ত হলেন।

 

 তখন থেকেই তিনি সত্য ধর্ম ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলেন।

 

তিনি সর্বপ্রথম খাদীজা (রা)-কে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইসলাম ধর্ম কবুল করলেন। তিনিই হলেন সর্বপ্রথম মুসলমান।

 

 এত খাদীজা (রা)-কে উম্মুল মু'মিনীনও বলা হয়। 'উম্মুল মু'মিনীন' অর্থ মু'মিনদের মা।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments