বহেড়া গাছ বড় ধরনের। সাধারণতঃ ২৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা বা উঁচু থাকে। বহেড়া গাছ সোজা উপরের দিকে বেড়ে উঠে। ছাল তেমন পুরু হয়না। এক গাঢ় ধুসর বর্ণের। গাছটির কাঠ ধুসরবর্ণ কিংবা ঈষৎ পীতবর্ণ ও শক্ত। পাতা ণিত, ১৮-২০ সেঃ মিঃ লম্বা হয়। দেখতে অনেকটা ছোট আকারের বট পাতার তো।
তবে একটু লম্বা প্রকৃতির হয়। শীতকালে গাছের পাতা ঝরে যায়। বসন্তকালে এবার নতুন পাতা গজায়। পাতা লালচে হয়ে ঝরে পড়ে। নতুন পাতা গজাতে যে সময় আগে, এ সময়ের মধ্যে গাছে ফুল আসে।
যেটিতে ফুল ধরে সেই দন্ডটি ৮ থেকে ১২ গঃ মিঃ লায় হয়। ফুল ছোট দেখতে অনেকটা নাকছাবির মতো। ফুলগুলো দন্ডের রিদিকে সাজানো থাকে এবং গন্ধ মিষ্ট। পরবর্তীতে ফল হয়, ধীরে ধীরে ফল বড় হতে থাকে। গ্রীষ্ম ও বর্ষা শেষে শীতের পূর্বে ফল পেকে আপনা আপনি ঝরে পড়ে।
প্রতিটি ফলে একটি বীজ থাকে তার মধ্যে বাদামের মত মজ্জা থাকে। এই গাছটি ভারতের ছোট নাগপুর, বিহার, হিমাচল প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে প্রচুর জন্মে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সর্বত্রই কম বেশী বহেড়া গাছ জন্মে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাছটি রোপন করার তেমন দরকার হয়না। পতিত জমি ও মাঠের ধারে বীজ পড়ে আপনা আপনি গাছ হয়। সাধারণতঃ আমাদের দেশে দুই ধরনের বহেড়া দেখা যায়। এক প্রকারের বহেডা দেখতে ডিম্বাকৃতি, পক্ষান্তরে অপরটি কিছুটা লম্বাকৃতি। কিন্তু একই প্রজাতি।
ব্যবহার্য অংশঃ ফলত্বক ও ফলমজ্জা।
মিযাজ (Temparament): প্রথম শ্রেণীর শীতল ও ২য় শ্রেণীর শুষ্ক।
বর্ণঃ ফল মেটে বা বাদামী রংয়ের হয়ে থাকে।
সেবনমাত্রাঃ ফলত্বক চূর্ণ ২ থেকে ৫ গ্রাম, ফলমজ্জা ২-৩ গ্রাম।
অপকারিতা: মাত্রাতিরিক্ত সেবনে অন্ত্রনালী ও গুহ্যদারের জন্য ক্ষতিকারক।
সংশোধনঃ মধু, সির্কা, চিনি ও মৌরি এর সংশোধক।
সাধারণ ক্রিয়াঃ বহেড়া মস্তিষ্কের বলকারক, পাকস্থলীর শক্তিবর্ধক, বিরেচক, ক্ষুধাবর্ধক, রুচিকারক, প্রশান্তিদায়ক, বীর্যস্তম্ভক ও ইন্দ্রিয় শক্তিবর্ধক। তাছাড়া অর্শ, শোথ, অজীর্ণ, যকৃতের গোলযোগ, উদরাময়, অতিসার, শ্বাসকষ্ট, মাথা ব্যথা ও জ্বরে বিশেষ উপকারী।
আময়িক ব্যবহার: ত্রিফলার একটি অন্যতম ফল হলো বহেড়া। স্মরণাতীত কাল হতে
ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে বহেড়া ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভারতে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক সম্প্রদায় বহেড়াকে সংকোচক ও মৃদু বিরেচক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাছাড়া গলা ও বক্ষের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বহেড়া, সৈন্দব লবণ ও পিপুল সহযোগে সেবনের পরামর্শ দিয়েছেন। বহেড়া দিয়ে ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ যৌগিক ওষুধ (Compound medicine) তৈরি করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে- কুরছ মুলাইয়েন, হাব্বে শাবইয়ার, সফ্ফ মুছাফি খাস, এত্রিফলে উস্তৃখুদূস, এত্রিফল কবীর, এত্রিফল বাদিয়ান প্রভৃতি।
উল্লেখিত ওষুধগুলো থেকে তিনটি ওষুধের ফর্মুলাসহ কার্যকারিতা, প্রস্তুত প্রণালী ও সেবনবিধি নিম্নে প্রদান করা গেলঃ
কুরছ মুলাইয়েন (QURS MULAYIN) 8
কোষ্ঠকাঠিন্য প্রকৃতপক্ষে কোন রোগ না হলেও আমাদের দেশে অনেকেরই এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। বিশেষতঃ অনিয়মিত আহার, নির্দিষ্ট সময় মলত্যাগ না করা, অস্ত্রের দুর্বলতা, দেশ ভ্রমণ, যকৃতের গোলযোগ, বারবার রেচক (Purgative) ওষুধ সেবন করা, প্রভৃতি কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। নিম্নের ফর্মুলাটি কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রতিবন্ধকতাজনিত অন্ত্রের ব্যথা, পুরনো মাথা ব্যথা, আন্ত্রিক অবরোধ, (Intestinal obstruction) ও শ্লেষ্মা নিঃসরনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী ও নিরাপদ ওষুধ।
ফর্মুলা:
উপাদানসমূহ: বাংলা বা স্থানীয় নাম
ইউনানী নাম বাদিয়ান মুহূতগী রুমী
বৈজ্ঞানিক নাম/ রাসায়নিক গঠন
Foeniculum vulgare Pistacia lentiscus Lavendula stoechas
পরিমাণ
৪. সকমুনিয়া
সমুনিয়া
Convolvulus scammonia
৫. রেউচিনি
রেওয়ান্দ চীনী
Rheum emodi
৬. বড় হরীতকীর খোসা
পোস্ত হলীলা কাবলী
Terminalia chebula
৭. বহেড়ার খোসা
পোস্ত বলীলা
Terminalia bellerica
৮. শুকনো আমলকী
আমলা খুশক
Phyllanthus emblica
৫০ এছ
২০ গ্রাম
২০ গ্রাম
২০ গ্রাম
৯. জঙ্গী হরীতকী
হলীলা সিয়াহ
Terminalia chebula
২০ গ্রাম
১০. তেউরীমূল
তুরবুদ
Operculina turpethum
২০ গ্রাম
২. সাদা বচ
৩. বহেড়ার মে
৪. বড় হরীতক
৫. নিমছাল
৬. দারুহরিদ্রা
প্রস্তুতপ্রণালী (Preparation): ২নং ও ৪নং উপাদান বাদ দিয়ে অন্যান্য উপাদানসমূহ ভালভাবে পরিষ্কার করে অর্ধকুটা করার পর রৌদ্রে কিংবা ড্রাই চেম্বারে শুকিয়ে নিন। এবার হামানদিস্তা কিংবা হার্বস ক্রাসিং মেশিনে (Pulveriser Machine) মিহিচূর্ণ করে ৬০ মেশের চালনীতে চেলে নিন। অতঃপর ২নং উপাদান অর্থাৎ রুমি মস্তগীকে হালকা চাপে খড়ল করে নির্বাচিত চূর্ণের সাথে মিশিয়ে নিন। এরপর ৪নং উপাদান অর্থাৎ সমূনিয়াকে হামানদিস্তায় মিহিচূর্ণ করে চেলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট চূর্ণের সাথে ভালভাবে মিশিয়ে প্রয়োজনমতো পরিশ্রুত পানি সহযোগে ৫০০ মিঃ গ্রামের বড়ি তৈরি করে রৌদ্রে কিংবা ড্রাই চেম্বারে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন।
কার্যকারিতা: কোষ্ঠ পরিষ্কারক, শ্লেষ্মা নিঃসারক, কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রতিবন্ধকতাজনিত কলিক বেদনা, হজমের গোলযোগ ও পুরনো মাথ্যাব্যথায় কার্যকরী।
সেবনবিধি: ১-২ বড়ি রাত্রে শয়নকালে গরম পানিসহ সেব্য।
টীকা:
১। তৈউরীমূলের ভিতরের শক্ত কাঠ ফেলে দিয়ে উপরের অংশ ব্যবহার করতে হয়। ২। বড়ি তৈরির সুবিধার্থে উক্ত ফর্মুলায় ২৫ গ্রাম আরবী গাম মিশানো যেতে পারে। ৩। দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনমতো সংরক্ষক (Preservative) মিশানো আবশ্যক।
সফূফ মুছাফি খাস (SUFOOF MUSAFFI KHAS) :
উক্ত ফর্মুলাটি সুবৃহৎ গ্রন্থ হামদর্দ ফার্মাকোপিয়া হতে নেওয়া হয়েছে। এটি বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগে বিশেষ কার্যকরী।
২. সাদা বচ্
ওয়াজ তুর্কী
Acorus calamus
৫০ গ্রাম
৩. বহেড়ার খোসা
পোস্ত বলীলা
Terminalia bellerica
৫০ গ্রাম
৪. বড় হরীতকীর খোসা
পোস্ত হলীলা যদ
Terminalia chebula
৫০ গ্রাম
৫. নিমছাল
নীম
Azadirachta indica
৫০ গ্রাম
৬. দারুহরিদ্রা ফল
যারিশক
Berberis aristata
৫০ গ্রাম
৭. কটূকী
কুকী
Picrorhiza kurroa
৫০ গ্রাম
৮. গুলঞ্চ
গেল্
Tinospora cordifolia
৫০ গ্রাম
৯. মনজিষ্ঠা
কূহ/মজেঠ
Rubia cordifolia
৫০ গ্রাম
প্রস্তুতপ্রণালী (Preparation): সংশ্লিষ্ট ফর্মুলার সমস্ত উপাদানসমূহ ভালোভাবে
পরিষ্কার করে রৌদ্রে কিংবা ড্রাই চেম্বারে শুকিয়ে হামানদিস্তা কিংবা হার্বস ক্রাসিং মেশিনে (Pulveriser Machine) মিহিচূর্ণকরে ৬০ মেশের চালনীতে ঢেলে নিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন।
কার্যকারিতা: খোঁসপাচড়া, রক্তদুষ্টি, একজিমা, কুষ্ঠ, চুলকানি, ব্রণ, সোরিয়াসিস ও ত্বকের লাবণ্যতায় বিশেষ কার্যকরী।
সেবনমাত্রা: ৫ গ্রাম (১ চা চামচ) পরিমাণ ওষুধ প্রত্যহ ২ বার পানিসহ সেব্য।
এত্রিফল উচ্ছৃখুদূস (ETRIFAL USTUKHUDUS) :
'এত্রিফল উখুদূস' ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি দ্রুত কার্যকরী হালুয়া (Semi Solid) জাতীয় ওষুধ। আবহমান কাল হতে ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত আস্থার সাথে এ ওষুধটিকে ব্যবহার করে আসছেন। এটি মাথা ব্যথা, মস্তিষ্কের অসার পদার্থ নিঃসরণ, পুরনো সর্দি, মৃগী, মুখের পক্ষাঘাত, পক্ষাঘাত, স্নায়ু দুর্বলতা ও কোষ্ঠকাঠিন্যে বিশেষ ফলপ্রদ।
ফর্মুলা:
উপাদানসমূহ:
বাংলা বা স্থানীয় নাম
ইউনানী নাম
বৈজ্ঞানিক নাম
পরিমাণ
১. বড় হরীতকীর খোসা ২. জঙ্গী হরীতকী
পোস্ত হলীলা যর্দ
Terminalia chebula
২০০ গ্রাম
হলীলা সিয়াহ পোস্ত বলীলা
Terminalia chebula
১০০ গ্রাম ১০০ গ্রাম ১০০ গ্রাম
৩. বহেড়ার খোসা
Terminalia bellerica
আমলা
Phyllanthus emblica
রোগ ও উদ্ভিদ তত্ত্ব
Rosa damascena
১০০ গ্রাম
৬. উচ্ছৃখৃদুস
উচ্ছৃখুদুস
Lavendula stoechas
৭. বস্ফায়েজ
বফায়েজ
Polypodium vulgare
১০০ গ্রাম
৮. স্বর্ণলতা/শূন্যলতা
আতীমূন
Cuscuta epithymтит
১০০ গ্রাম
৯. কিস্মিস্/দ্রাক্ষা
কিশমিশ
Vitis vinifera
১০০ গ্রাম
১০. ঘি
রওগণ যদ
Ghee
১০০ গ্রাম
১১. মধু
শহৃদ
Apis mellifera
১২০ গ্রাম
প্রস্তুতপ্রণালী (Preparation) : বড় হরীতকীর খোসা, বহেড়ার খোসা ও আমলকীকে
৩ কেজি
আলাদাভাবে নিয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে হামানদিস্তা কিংবা হার্বস ক্রাসিং মেশিনে (Pulvriser Machine) মিহিচূর্ণ করে ৬০ মেশের চালনীতে চেলে নিন। অতঃপর নির্বাচিত চূর্ণকে রওগন যর্দ (ঘি) অথবা রওগন বাদাম শিরীন এ মাখিয়ে কিছুটা সিক্ত করে নিন। এবার মধু ব্যতীত অন্যান্য উপাদানগুলো শুকিয়ে হামানদিস্তা কিংবা হার্বস ক্রাসিং মেশিনে মিহিচূর্ণ করে চেলে নিন। এরপর কিশিকে ভালভাবে ধৌত করে পাটায় পিষে নিন। তারপর মৃদু তাপে মধু দ্বারা কেওয়াম বা সিরাপ প্রস্তুত করে প্রথমতঃ ত্রিফলার চূর্ণসমূহ ও কিশমিশের পেষ্ট ভালোভাবে মিশিয়ে পরবর্তীতে অন্যান্য চূর্ণসমূহ ধীরে ধীরে মিশিয়ে নিন। এত্রিফল ঠান্ডা হবার পর শুষ্ক ও বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন।
টীকা:
সেবনবিধি: ৫-১০ গ্রাম ওষুধ রাতে শয়নকালে আরক বাদিয়ান কিংবা গরমপানিসহ সেবা।
বেনজয়েট সংমিশ্রণ করা যেতে পারে।
১। ওষুধটি তৈরির প্রাক্কালে সংরক্ষক (Preservative) হিসেবে ৩০-৩৫ গ্রাম সোডিয়াম
২। এই ফর্মুলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ যেমন- উচ্ছৃখৃদূস, বড় হরীতকীর খোসা, বহেড়ার খোসা ও আমলকী।
রোগ প্রতিকারে বহেড়ার প্রয়োগ
১। হাঁপানিতে: বহেড়া বীজের শাঁস বা মজ্জা দুই-একটি করে দুই ঘন্টা অন্তর চিবিয়ে খেলে হাঁপানিতে উপকার হয়। তবে কার্ডিয়াক এ্যাজমাতে কোন উপকার পাওয়া যাবে না।
২। আমাশয়ে : রক্ত আমাশয় কিংবা পুরাতন আমাশয়ের ক্ষেত্রে বহেড়া চূর্ণ ৩-৪ গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে ২ বার পানিসহ নিয়মিত কিছুদিন সেবন করে গেলে
আশাতীত উপকার হয়।
৩। শ্বাসকষ্টে : বহেড়ার খোসা চূর্ণ ১ চা-চামচ নিয়ে এর মধ্যে মধু ২-৩ চা-চামচ Z42শয়ে চেটে চেটে কিংবা লেহন করে দিনে ২-৩ বার খেলে প্রবল কাশি এবং শ্বাসকষ্টে