হযরত খাদীজা (রা)-এর প্রেরণা
হযরত মুহাম্মদ (সা) এবার ইসলাম প্রচারের দিকে মনোযোগ দিলেন। সে সময় আরবের রীতি ছিল-কেউ কোন বিপদে পড়ে সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিসকন্তু দিয়ে ডাক দিলে, লোকজন ঐ পাহাড়ের নিকট ছুটে আসত। হযরত মুহাম্মদ (সা)-এ তাই করলেন। তিনি সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে উচ্চস্বরে সকলকে ডাকলেন।
কে ডাকে? কেন ডাকে? নিশ্চয়ই কারো কোন বিপদ হয়েছে-এই কেনে ছুটলো সকলে সেই সাফা পাহাড়ের দিকে। এসে দেখে আল-আমীন। সততা ও বিশ্বয়- তার জন্য মক্কার লোকেরা হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে 'আল-আমীন' বলে ডাকত। প্রথমে তিনি আগত লোকজনকে নানান ধরনের উদাহরণ দিয়ে বোঝালেম
তারপর মূর্তি পূজা ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং এক আল্লাহর ইবাদত করতে বললেন। এ কথা শুনে দলপতি বা গোত্রের নেতারা একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম ছেড়ে নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে হবে? ছোট-বড় সবাইকে সমান ভাবতে হবে? তাদের গায়ে যেন আগুন জ্বলতে লাগলো। ঝালাপাল করতে লাগলো সমস্ত শরীর। অতঃপর অকথ্য ভাষায় নবীজীকে গালি দিতে দিতে তারা বাড়ি চলে গেল।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। স্বামীর চেহারা দেখে বুদ্ধিমতী খাদীজা (রা) ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তবুও স্বামীর নিকট সব ঘটনা শুনলেন। অনে তিনিও মনে দুঃখ পেলেন। তারপর স্বামীকে সান্ত্বনা, সাহস ও উৎসাহ দিলেন। স্ত্রীর কথায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) হারানো মনোবল ফিরে পেলেন।
পরদিন রাসুলুল্লাহ্ (সা) আবার মানুষের দ্বারে দ্বারে গেলেন। মক্কার অলি গলি বাড়ি বাড়ি ঘুরে তিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে লাগলেন। তাদেরকে বোকাতে লাগলেন আল্লাহর কথা।
এভাবে তিনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে থাকলেন। কিন্তু কমবত্তেরা তাঁর কথায় কান দিলো না। বরং তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে শত্রুতা শুরু করে দিল এবং ইসলাম প্রচারের বিরোধিতা করতে
হযরত খাদীজা (রা)
লাগলো। শুধু তাই নয়, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর তারা অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে দিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর প্রচার কাজ বন্ধ করলেন না। গোপনে গোপনে চালাতে লাগলেন। ফলে দু'একজন করে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। খাদীজা (রা)-এর পর পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবূ বকর (রা), বালকদের মধ্যে হযরত আলী (রা) এবং ক্রীতদাসতের মধ্যে হযরত যায়েদ বিন হারিসা (রা) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করলেন। তাছাড়াও কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করলো। কিন্তু তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। মক্কার কাফিররা শুধু রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর অত্যাচার করেই ক্ষ্যান্ত হলো না। তারা নব মুসলিমদের উপরও চালাতে লাগলো অমানুষিক নির্যাতন। রাসুলুল্লাহ (সা) যখন রাস্তা দিয়ে চলতে থাকেন, কিংবা কোথাও কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকেন, তখন কাফিররা তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে, পাগল বলে উপহাস করে, অত্যাচার করে, অকথ্য ভাষায় গালি দেয়। এমন কি নবীজীর চলার পথে কাঁটা পুঁতে রাখে।
এ ছাড়া আল্লাহর নবীকে বিরক্ত, উত্ত্যক্ত ও নির্যাতন করার জন্যে যা করা দরকার তারা তার একটিও বাদ দেয় না। শুধু বড় মানুষরাই যে একাজ করতো তা নয়। তারা শহরের দুষ্টমতির ছেলেদেরকেও নবীজীর পিছনে লেলিয়ে দিত। এগুলো ছিল তাদের নিত্যদিনের আচরণ।
প্রায় দিনই রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাফিরদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বিষন্ন মনে বাড়ি ফেরেন। স্বামীর মলিন চেহারা দেখেই পতিপ্রাণা খাদীজা (রা) সব বুঝতে পারেন। তিনি স্বামীর খেদমতের জন্যে অধীর হয়ে পড়েন।
হযরত খাদীজা (রা) ভালরূপেই জানেন যে, স্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ, মিষ্টি মধুর কথা ও ভাল ব্যবহার পেলে স্বামীর বিষণ্ণতা কেটে যায়, অন্তরের সকল দুঃখ-বেদনা দূর হয়। তাই তিনি হাসিমুখে সুমিষ্ট কথা ও ভাল আচরণ দ্বারা স্বামীর বিষণ্ণ মনকে প্রফুল্ল করে তোলেন। সেবা-যত্নের দ্বারা সবল করে তোলেন স্বামীর দেহ ও মনকে।
স্ত্রীর এমন মধুর ব্যবহারে রাসূলুল্লাহ (সা) মুগ্ধ হন, সব দুঃখ ভুলে যান। তারপর সারা দিনের দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনাগুলো খাদীজা (রা)-এর নিকটি হালকা করেন। এ সব ঘটনা শুনে হযরত খাদীজা (রা) মনে খুব বাদা
আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শী সকলেই
)
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর শত্রু। এত শত্রুর মধ্যে তিনি কিভাবে ইসলাম প্রচার করবেন। হযরত খাদীজা (রা) ভেবে কুল কিনারা পান না। তবুও সাহসের উপর ভর করে খাদীজ (রা) স্বামীকে বলেন:
"ইয়া রাসূল! আপনি কখনও নিরাশ হবেন না, ভয় পাবেন না। এটা আল্লাহর কাজ। এ কাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। সে যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন। কারণ, আল্লাহর সঙ্গে মোকাবিলা করার মত ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ্ আপনাকে সাহায্য করবেন। সত্যের জয় একদিন হবেই হবে।
এসব কথা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অজানা নয়। কিন্তু নানা চিন্তায় কথাগুলো তিমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। বিজ্ঞ স্ত্রীর মুখে কথাগুলো শোনামাত্র ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ঝিমিয়ে পড়া মনটা আবার সবল হয়ে ওঠে। নব উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মানুষের নিকট ইসলাম প্রচারে প্রবৃত্ত হলেন। তাই তো কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন:
একা কভু হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি,
শক্তি সাহস প্রেরণা দিয়েছে
বিজয়িনী লক্ষ্মী নারী।
হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন নবীজীর পারিবারিক জীবনের শান্তি, আরাম ও নিরাপত্তার একমাত্র নির্ভরস্থল। কাফিরদের ঠাট্টা, বিদ্রূপ, উপহাস ও নির্যাতনে জর্জরিত। হয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নবীজী ঘরে ফিরে বলতেন: খাদীজা আমার সঙ্গে কথা বা তোমার আলাপেই আমার শান্তি ফিরে আসে।
অনেক সময় নবীজী বাইরে থেকে বিষণ্ণ মনে ঘরে ফিরে এলে খাদীজা (রা) সংসারের কাজ ফেলে স্বামীর পার্শ্বে এসে বসতেন। নানাভাবে স্বামীর মনোরঞ্জন করতে চেষ্টা করেন।