মুসা (আ)

মুসা (আ) ও হারুণ (আ) এর ইতিহাস এবং তাদের জীবন বৃত্তান্ত,বিখ্যাত ইতিহাস বিদদের থেকে নেওয়া

তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দীত্ব বরণ

মূসা (আঃ)-এর প্রতি অবাধ্যতা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হওয়ার শাস্তি স্বরূপ বনু ইস্রাঈলগণকে মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে দীর্ঘ ৪০ বছরের জন্য বন্দী করা হয়। তাদের অবাধ্যতায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে নবী মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন,

قَالَ رَبِّ إِنِّي لا أَمْلِكُ إِلاَّ نَفْسِي وَأَخِيْ فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৫)-

‘হে আমার পালনকর্তা! আমি কোন ক্ষমতা রাখি না কেবল আমার নিজের উপর ও আমার ভাইয়ের উপর ব্যতীত। অতএব আপনি আমাদের ও পাপাচারী কওমের মধ্যে ফায়ছালা করে দিন’ (মায়েদাহ ৫/২৫)। জবাবে আল্লাহ বলেন,

قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً يَّتِيْهُوْنَ فِي الأَرْضِ فَلاَ تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৬)-

 

‘এদেশটি (বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ শামদেশ) চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হ’ল। এ সময় তারা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ফিরবে। অতএব তুমি অবাধ্য কওমের জন্য দুঃখ করো না’ (মায়েদাহ ৫/২৬)। تَاهَ يَتِيْهُ تِيْهًا অর্থ গর্ব করা, পথ হারিয়ে ঘোরা ইত্যাদি। এখান থেকেই উক্ত প্রান্তরের নাম হয়েছে ‘তীহ্’ (تِيْه)। বস্ত্ততঃ এই উন্মুক্ত কারাগারে না ছিল কোন প্রাচীর, না ছিল কোন কারারক্ষী। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’ত। আর সারাদিন চলার পর রাতে আবার সেখানে এসেই উপস্থিত হ’ত, যেখান থেকে সকালে তারা রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই তারা অদৃশ্য কারা প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারত না। এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত হতবুদ্ধি অবস্থায় দিগ্বিদিক ঘুরে এই হঠকারী অবাধ্য জাতি তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ভোগ করতে থাকে। যেমন ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর অবাধ্য কওম দুনিয়াবী শাস্তি হিসাবে প্লাবণে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। বস্ত্ততঃ চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হারূণ ও মূসা (আঃ)-এর তিন বছরের বিরতিতে মৃত্যু হয়। অতঃপর শাস্তির মেয়াদ শেষে পরবর্তী নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস জয়ে সমর্থ হয় এবং সেখানে প্রবেশ করে। বর্ণিত হয়েছে যে, ১২ জন নেতার মধ্যে ১০ জন অবাধ্য ও ভীরু নেতা এরি মধ্যে মারা যায় এবং মূসার অনুগত ইউশা‘ ও কালেব দুই নেতাই কেবল বেঁচে থাকেন, যাদের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজিত হয় (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর মায়েদাহ ২৬)।

 

মিসর থেকে হিজরতের কারণ

ইউসুফ হতে মূসা পর্যন্ত দীর্ঘ চার/পাঁচশ’ বছর মিসরে অবস্থানের পর এবং নিজেদের বিরাট জনসংখ্যা ছাড়াও ফেরাঊনীদের বহু সংখ্যক লোক গোপনে অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এবং মূসা (আঃ)-এর মত শক্তিশালী একজন নবীকে পাওয়া সত্ত্বেও বনু ইস্রাঈলকে কেন রাতের অন্ধকারে মিসর থেকে পালিয়ে আসতে হল? অতঃপর পৃথিবীর কোথাও তারা আর স্থায়ীভাবে একত্রে বসবাস করতে পারেনি, তার একমাত্র কারণ ছিল ‘জিহাদ বিমুখতা’। এই বিলাসী, ভীরু ও কাপুরুষের দল ‘ফেরাঊন ও তার দলবলের ভয়ে এতই ভীত ছিল যে, তাদের নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করত না। বরং মূসা (আঃ)-এর কাছে পাল্টা অভিযোগ তুলতো যে, তোমার কারণেই আমরা বিপদে পড়ে গেছি’। যেমন সূরা আ‘রাফ ১২৯ আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ‘অথচ ঐ সময় মিসরে মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছিল’।[মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/২৫০]

মিসর থেকে বেরিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নগরী দখলের জন্যও তাদেরকে যখন জিহাদের হুকুম দেওয়া হল, তখনও তারা একইভাবে পিছুটান দিল। যার পরিণতি তারা সেদিনের ন্যায় আজও ভোগ করছে। বস্ত্ততঃ বিলাসী জাতি ভীরু হয় এবং জিহাদ বিমুখ জাতি কখনোই কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

 

 

শিক্ষণীয় বিষয়

━━━━━━━━━

মূসা (আঃ)-এর জীবনের এই শেষ পরীক্ষায় দৃশ্যত: তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে অনুমিত হলেও প্রকৃত অর্থে তিনি ব্যর্থ হননি। বরং তিনি সকল যুগের ঈমানদারগণকে জানিয়ে গেছেন যে, কেবল মু‘জেযা বা কারামত দিয়ে দ্বীন বিজয়ী হয় না। তার জন্য প্রয়োজন আল্লাহর উপরে দৃঢ় বিশ্বাসী একদল মুমিনের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। আর এটাই হ’ল জিহাদ। ৪০ বছর পর যখন তারা পুনরায় জিহাদে নামল, তখনই তারা বিজয়ী হ’ল। যুগে যুগে এটাই সত্য হয়েছে।

 

গাভী কুরবানীর হুকুম ও হত্যাকারী চিহ্নিত করণ

বনু ইস্রাঈলের জনৈক যুবক তার একমাত্র চাচাতো বোনকে বিয়ে করে তার চাচার অগাধ সম্পত্তির একক মালিক বনতে চায়। কিন্তু চাচা তাতে রাজি না হওয়ায় সে তাকে গোপনে হত্যা করে। পরের দিন বাহ্যিকভাবে কান্নাকাটি করে চাচার রক্তের দাবীদার সেজে কওমের নেতাদের কাছে বিচার দেয়। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে আসামী শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে মূসা (আঃ) অহী মারফত জেনে গিয়েছিলেন যে, বাদী স্বয়ং আসামী এবং সেই-ই একমাত্র হত্যাকারী। এমতাবস্থায় সম্প্রদায়ের নেতারা এসে বিষয়টি ফায়ছালার জন্য মূসা (আঃ)-কে অনুরোধ করল। মূসা (আঃ) তখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক যে ফায়ছালা দিলেন, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْساً فَادَّارَأْتُمْ فِيْهَا وَاللهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ ‘যখন তোমরা একজনকে হত্যা করে পরে সে সম্পর্কে একে অপরকে দায়ী করছিলে। অথচ আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিলেন, যা তোমরা গোপন করতে চাচ্ছিলে’ (বাক্বারাহ ২/৭২)। কিভাবে আল্লাহ সেটা প্রকাশ করে দিলেন, তার বিবরণ নিম্নরূপ:

‘যখন মূসা স্বীয় কওমকে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটা গাভী যবেহ করতে বলেছেন। তারা বলল, আপনি কি আমাদের সাথে উপহাস করছেন? তিনি বললেন, জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি’ (বাক্বারাহ ৬৭)। ‘তারা বলল, তাহলে আপনি আপনার পালনকর্তার নিকটে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন, যেন তিনি বলে দেন, গাভীটি কেমন হবে? তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন গাভীটি এমন হবে, যা না বুড়ী না বকনা, বরং দু’য়ের মাঝামাঝি বয়সের হবে। এখন তোমাদের যা আদেশ করা হয়েছে, তা সেরে ফেল’ (৬৮)। ‘তারা বলল, আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষ থেকে প্রার্থনা করুন যে, গাভীটির রং কেমন হবে। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, গাভীটি হবে চকচকে গাঢ় পীত বর্ণের, যা দর্শকদের চক্ষু শীতল করবে’ (৬৯)। ‘লোকেরা আবার বলল, আপনি আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন, যাতে তিনি বলে দেন যে, গাভীটি কিরূপ হবে। কেননা একই রংয়ের সাদৃশ্যপূর্ণ গাভী অনেক রয়েছে। আল্লাহ চাহে তো এবার আমরা অবশ্যই সঠিক দিশা পেয়ে যাব’ (৭০)। ‘তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, সে গাভীটি এমন হবে, যে কখনো ভূমি কর্ষণ বা পানি সেচনের শ্রমে অভ্যস্ত নয়, সুঠামদেহী ও খুঁৎহীন’। ‘তারা বলল, এতক্ষণে আপনি সঠিক তথ্য এনেছেন। অতঃপর তারা সেটা যবেহ করল। অথচ তারা (মনের থেকে) তা যবেহ করতে চাচ্ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/৬৭-৭১)।

 

আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি বললাম, যবেহকৃত গরুর গোশতের একটি টুকরা দিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশের গায়ে আঘাত কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শন সমূহ প্রদর্শন করেন। যাতে তোমরা চিন্তা কর’ (বাক্বারাহ ২/৭৩)।

বলা বাহুল্য, গোশতের টুকরা দিয়ে আঘাত করার সাথে সাথে মৃত লোকটি জীবিত হল এবং তার হত্যাকারী ভাতিজার নাম বলে দিয়ে পুনরায় মারা গেল। ধারণা করা চলে যে, মূসা (আঃ) সেমতে শাস্তি বিধান করেন এবং হত্যাকারী ভাতিজাকে হত্যার মাধ্যমে ‘ক্বিছাছ’ আদায় করেন।

কিন্তু এতবড় একটা অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেও এই হঠকারী কওমের হৃদয় আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়নি। তাই আল্লাহ বলেন, ثُمَّ قَسَتْ قُلُوْبُكُمْ مِّنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ‘অতঃপর তোমাদের হৃদয় শক্ত হয়ে গেল। যেন তা পাথর, এমনকি তার চেয়েও শক্ত... (বাক্বারাহ ২/৭৪)।

 

 

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

━━━━━━━━━━━━━

(১) এখানে প্রথম যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, সেটি এই যে, আল্লাহর উপরে পূর্ণরূপে ভরসা করলে অনেক সময় যুক্তিগ্রাহ্য বস্ত্তর বাইরের বিষয় দ্বারা সত্য প্রকাশিত হয়। যেমন এখানে গরুর গোশতের টুকরা মেরে মৃতকে জীবিত করার মাধ্যমে হত্যাকারী শনাক্ত করানোর ব্যবস্থা করা হ’ল। অথচ বিষয়টি ছিল যুক্তি ও স্বাভাবিক জ্ঞানের বিরোধী।

 

(২) মধ্যম বয়সী গাভী কুরবানীর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, নৈতিকভাবে মৃত জাতিকে পুনর্জীবিত করতে হলে পূর্ণ নৈতিকতা সম্পন্ন ঈমানদার যুবশক্তির চূড়ান্ত ত্যাগ ও কুরবানী আবশ্যক।

 

(৩) নবী-রাসূলগণের আনুগত্য এবং তাঁদের প্রদত্ত শারঈ বিধান সহজভাবে মেনে নেওয়ার মধ্যেই জাতির মঙ্গল নিহিত। বিতর্কে লিপ্ত হলে বিধান কঠোর হয় এবং আল্লাহর গজব অবশ্যম্ভাবী হয়। যেমন বনু ইস্রাঈলগণ যদি প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী যেকোন একটা গাভী যবেহ করত, তবে তাতেই যথেষ্ট হ’ত। কিন্তু তারা যত বেশী প্রশ্ন করেছে, তত বেশী বিধান কঠোর হয়েছে। এমনকি অবশেষে হত্যাকারী চিহ্নিত হলেও আল্লাহর ক্রোধে তাদের হৃদয়গুলো পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে।

 

(৪) এই গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় ঘটনাকে চির জাগরুক করে রাখার জন্য আল্লাহ পাক গাভীর নামে সূরা বাক্বারাহ নামকরণ করেন। এটিই কুরআনের ২৮৬টি আয়াত সমৃদ্ধ সবচেয়ে বড় ও বরকতমন্ডিত সূরা। এই সূরার ফযীলত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের গৃহগুলিকে কবরে পরিণত করো না। নিশ্চয়ই শয়তান ঐ ঘর থেকে পালিয়ে যায়, যে ঘরে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়’।[মুসলিম, মিশকাত হা/২১১৯ ‘কুরআনের ফযীলত সমূহ’] এ সূরার মধ্যে আয়াতুল কুরসী (২৫৫ নং আয়াত) রয়েছে, যাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘শ্রেষ্ঠতম’ (اعظم) আয়াত বলে বর্ণনা করেছেন।(মুসলিম, মিশকাত হা/২১২২)

 

মূসা ও খিযিরের কাহিনী

এ ঘটনাটি বনু ইস্রাঈলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। পিতা ইবরাহীম (আঃ) সহ বড় বড় নবী-রাসূলগণের জীবনে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মূসা (আঃ)-এর জীবনে এটাও ছিল অনুরূপ একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে। আনুষঙ্গিক বিবরণ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত বন্দীশালায় থাকাকালীন সময়ে ঘটেছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ:

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে বর্ণিত হাদীছ হতে[বুখারী হা/৪৭২৫-২৭; মুসলিম, হা/৬১৬৫] এবং সূরা কাহফ ৬০ হতে ৮২ পর্যন্ত ২৩টি আয়াতে বর্ণিত বিবরণ থেকে যা জানা যায়, তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নে বিবৃত হ’ল।-

 

 

ঘটনার প্রেক্ষাপট :

━━━━━━━━━━━

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, একদিন হযরত মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? ঐ সময়ে যেহেতু মূসা ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর চাইতে অধিক জ্ঞানী ছিলেন না, তাই তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পসন্দ হয়নি। কেননা এতে কিছুটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’। আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা শুনে মূসা (আঃ) প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারি’। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের (সম্ভবতঃ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থল) দিকে সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে’। মূসা (আঃ) স্বীয় ভাগিনা ও শিষ্য (এবং পরবর্তীকালে নবী) ইউশা‘ বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের ঢেউয়ের ছিটা মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও থলে থেকে বেরিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। ইউশা‘ ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু মূসা (আঃ) ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে গেলেন। অতঃপর তারা আবার পথ চলতে শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন। অতঃপর মূসা (আঃ) নাশতা দিতে বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ওযর পেশ করে আনুপূর্বিক সব ঘটনা মূসা (আঃ)-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (কাহফ ১৮/৬৩)। তখন মূসা (আঃ) বললেন, ঐ স্থানটিই তো ছিল আমাদের গন্তব্য স্থল।

ফলে তাঁরা আবার সেপথে ফিরে চললেন। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, একজন লোক আপাদ-মস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মূসা (আঃ) তাকে সালাম করলেন। লোকটি মুখ বের করে বললেন, এদেশে সালাম? কে আপনি? বললেন, আমি বনু ইস্রাঈলের মূসা। আপনার কাছ থেকে ঐ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে দান করেছেন’।

খিযির বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না হে মূসা! আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি আপনাকে দেননি। পক্ষান্তরে আপনাকে তিনি যে জ্ঞান দান করেছেন, তা আমাকে দেননি’। মূসা বললেন, ‘আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করব না’ (কাহফ ১৮/৬৯)। খিযির বললেন, ‘যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি’।

(১) অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য একটা নৌকা পেলেন। অতঃপর নৌকা থেকে নামার সময় তাতে ছিদ্র করে দিলেন। শারঈ বিধানের অধিকারী নবী মূসা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারলেন না। কেননা বিনা দোষে অন্যের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া স্পষ্টভাবেই অন্যায়। তিনি বলেই ফেললেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি একটা গুরুতর মন্দ কাজ করলেন’। তখন খিযির বললেন, আমি কি পূর্বেই বলিনি যে, ‘আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা ক্ষমা চাইলেন। ইতিমধ্যে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে খিযির মূসা (আঃ)-কে বললেন, علمي و علمك و علم الخلائق فى علم الله إلا مقدار ما غمس هذا العصفور منقاره ‘আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফোঁটা পানির সমতুল্য’।(বুখারী হা/৪৭২৭)

(২) তারপর তাঁরা সমুদ্রের তীর বেয়ে চলতে থাকলেন। কিছু দূর গিয়ে তাঁরা সাগরপাড়ে খেলায় রত একদল বালককে দেখলেন। খিযির তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে তাকে হত্যা করলেন। এ দৃশ্য দেখে মূসা আৎকে উঠে বললেন, একি! একটা নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা করলেন? এ যে মস্তবড় গোনাহের কাজ’। খিযির বললেন, আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আবার ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন, ‘এরপর যদি আমি কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আপনি আমাকে আর সাথে রাখবেন না’ (কাহফ ১৮/৭৫)।

(৩) ‘অতঃপর তারা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি জনপদে পৌঁছলেন, তখন তাদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেয়ে সেটাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তখন মূসা বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন’। খিযির বললেন هَذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ سَأُنَبِّئُكَ بِتَأْوِيلِ مَا لَمْ تَسْتَطِعْ عَلَيْهِ صَبْراً ‘এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হ’ল। এখন যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, আমি সেগুলির তাৎপর্য বলে দিচ্ছি’ (কাহফ ১৮/৭৮)।

 

 

শিক্ষণীয় বিষয় :

━━━━━━━━━━

(১) বড় যুলুম থেকে বাঁচানোর জন্য কারু উপরে ছোট-খাট যুলুম করা যায়। যেমন নৌকা ছিদ্র করা থেকে এবং বালকটিকে হত্যা করা থেকে প্রমাণিত হয়। তবে শরী‘আতে মুহাম্মাদীতে এগুলি সবই সামাজিক বিধি-বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ করে হত্যাকান্ডের মত বিষয় একমাত্র রাষ্ট্রানুমোদিত বিচার কর্তৃপক্ষ ব্যতীত কারু জন্য অনুমোদিত নয়।

 

(২) পিতা-মাতার সৎকর্মের ফল সন্তানরাও পেয়ে থাকে। যেমন সৎকর্মশীল পিতার রেখে যাওয়া গুপ্তধন তার সন্তানরা যাতে পায়, সেজন্য খিযির সাহায্য করলেন। তাছাড়া এ বিষয়েও ইঙ্গিত রয়েছে যে, আলেম ও সৎকর্মশীলগণের সন্তানদের প্রতি সকলেরই স্নেহ পরায়ণ হওয়া কর্তব্য।

 

(৩) মানুষ অনেক সময় অনেক বিষয়কে ভাল মনে করে। কিন্তু সেটি তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,

عَسَى أَن تَكْرَهُوْا شَيْئاً وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تُحِبُّوْا شَيْئاً وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُون- (البقرة ২১৬)-

‘তোমরা অনেক বিষয়কে অপসন্দ কর। অথচ সেটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার অনেক বিষয় তোমরা ভাল মনে কর, কিন্তু সেটি তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্ত্ততঃ আল্লাহই প্রকৃত অবস্থা জানেন, তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, لايَقْضِى اللهُ للمؤمن من قضاءٍ الا كان خيرًا له ‘আল্লাহ তার মুমিন বান্দার জন্য যা ফায়ছালা করেন, তা কেবল তার মঙ্গলের জন্যই হয়ে থাকে’।[আহমাদ হা/১২৯২৯ ‘সনদ সহীহ, -আরনাঊত্ব]

 

(৪) অতঃপর আরেকটি মৌলিক বিষয় এখানে রয়েছে যে, মূসা ও খিযিরের এ শিহরণমূলক কাহিনীটি ছিল ‘আগাগোড়া একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের বহিঃপ্রকাশ’। থলের মধ্যেকার মরা মাছ জীবিত হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সাগরে চলে যাওয়া যেমন সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত বিষয়, তেমনি আল্লাহ পাক কোন ফেরেশতাকে খিযিরের রূপ ধারণ করে মূসাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যও পাঠিয়ে থাকতে পারেন। যাকে তিনি সাময়িকভাবে শরী‘আতী ইলমের বাইরে অলৌকিক ও অতীন্দ্রিয় জ্ঞান দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, যা মূসার জ্ঞানের বাইরে ছিল। এর দ্বারা আল্লাহ মূসা সহ সকল মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।

 

(৫) বান্দার জন্য যে অহংকার নিষিদ্ধ, অত্র ঘটনায় সেটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয়।


Bonolota

106 Blog posts

Comments