সিংহাসনের উপরে একটি নিষ্প্রাণ দেহ প্রাপ্তির ঘটনা
আল্লাহ বলেন- وَلَقَدْ فَتَنَّا سُلَيْمَانَ وَأَلْقَيْنَا عَلَى كُرْسِيِّهِ جَسَداً ثُمَّ أَنَابَ (ص ৩৪) ‘আমি সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং রেখে দিলাম তার সিংহাসনের উপর একটি নিষ্প্রাণ দেহ। অতঃপর সে রুজু হল’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৪)। এ বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা কেবল এতটুকুই। এক্ষণে সেই নিষ্প্রাণ দেহটি কিসের ছিল, একে সিংহাসনের উপর রাখার হেতু কি ছিল, এর মাধ্যমে কি ধরনের পরীক্ষা হল- এসব বিবরণ কুরআন বা সহীহ হাদীছে কিছুই বর্ণিত হয়নি। অতএব এ বিষয়ে কেবল এতটুকু ঈমান রাখা কর্তব্য যে, সুলায়মান (আঃ) এভাবে পরীক্ষায় পতিত হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি আল্লাহর প্রতি আরো বেশী রুজু হন ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি তাঁর অটুট আনুগত্যের পরিচয় বহন করে।
উক্ত ঘটনাকে রং চড়িয়ে ইস্রাঈলী রেওয়ায়াত সমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, সুলায়মানের রাজত্বের গুঢ় রহস্য তার আংটির মধ্যে নিহিত ছিল। একদিন এক শয়তান তাঁর আংটিটা হাতিয়ে নেয় এবং নিজেই সুলায়মান সেজে সিংহাসনে বসে। এদিকে আংটি হারা সুলায়মান (আঃ) সিংহাসন হারিয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকেন। একদিন ঘটনাক্রমে একটি মাছের পেট থেকে সুলায়মান উক্ত আংটি উদ্ধার করেন ও চল্লিশ দিন পর পুনরায় সিংহাসন লাভ করেন’। সিংহাসনে বসা ঐ শয়তানের রাখা কোন বস্ত্তকে এখানে আল্লাহ নিষ্প্রাণ দেহ বলেছেন।
বস্ত্ততঃ এসবই বানোয়াট কাহিনী। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আহলে কিতাবের একটি দল হযরত সুলায়মান (আঃ)-কে নবী বলেই স্বীকার করে না। বাহ্যতঃ এসব কাহিনী তাদেরই অপকীর্তি’।
‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার ফল
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনার সারমর্ম এই যে, একবার হযরত সুলায়মান (আঃ) এ মনোভাব ব্যক্ত করলেন যে, রাত্রিতে আমি (আমার ৯০ বা ১০০) সকল স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব। যাতে প্রত্যেকের গর্ভ থেকে একটি করে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে ও পরে তারা আল্লাহর পথে ঘোড় সওয়ার হয়ে জিহাদ করবে। কিন্তু এ সময় তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ (অর্থঃ ‘যদি আল্লাহ চান’) বলতে ভুলে গেলেন। নবীর এ ত্রুটি আল্লাহ পসন্দ করলেন না। ফলে মাত্র একজন স্ত্রীর গর্ভ থেকে একটি অপূর্ণাঙ্গ ও মৃত শিশু ভূমিষ্ট হল’।[মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭২০] এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সুলায়মান বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাদশাহ হ’লেও এবং জিন, বায়ু, পক্ষীকুল ও সকল জীবজন্তু তাঁর হুকুম বরদার হলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অতএব তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে ভুলে যাওয়াটা ছোটখাট কোন অপরাধ নয়। এ ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয় যে, যারা যত বড় পদাধিকারী হবেন, তাদের ততবেশী আল্লাহর অনুগত হ’তে হবে এবং সর্বাবস্থায় সকল কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। সর্বদা বিনীত হয়ে চলতে হবে এবং কোন অবস্থাতেই অহংকার করা চলবে না।
অনেক তাফসীরবিদ সূরা ছোয়াদ ৩৪ আয়াতে বর্ণিত ‘সিংহাসনের উপরে নিষ্প্রাণ দেহ’ রাখার ঘটনার সাথে কিছুটা সাদৃশ্য দেখে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত উপরোক্ত ঘটনাকে উক্ত আয়াতের তাফসীর হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলেন যে, সিংহাসনে নিষ্প্রাণ দেহ রাখার অর্থ এই যে, সুলায়মান (আঃ)-এর জনৈক চাকর উক্ত মৃত সন্তানকে এনে তাঁর সিংহাসনে রেখে দেয়। এতে সুলায়মান (আঃ) বুঝে নেন যে, এটা তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার ফল। সেমতে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হলেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ক্বাযী আবুস সাঊদ, আল্লামা আলূসী, আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ এ তাফসীর বর্ণনা করেছেন। এতদ্ব্যতীত ইমাম রাযীও আরেকটি তাফসীর করেছেন যে, সুলায়মান (আঃ) একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে এমন দুর্বল হয়ে পড়েন যে, সিংহাসনে বসালে তাঁকে নিষ্প্রাণ দেহ বলে মনে হ’ত। পরে সুস্থ হ’লে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হন...। এ তাফসীর একেবারেই অনুমান ভিত্তিক। কুরআনী বর্ণনার সাথে এর কোন মিল নেই।
প্রকৃত প্রস্তাবে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত ঘটনাকে উক্ত আয়াতের অকাট্ট তাফসীর বলা যায় না। কেননা এ ঘটনায় বর্ণিত রেওয়ায়াত সমূহের কোনটাতেই এরূপ ইঙ্গিত পাওয়া যায় না যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলোচ্য ঘটনাটিকে উক্ত আয়াতের তাফসীর হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সম্ভবতঃ এ কারণেই অত্র হাদীছটি সহীহ বুখারীর ‘জিহাদ’ ‘আম্বিয়া’ ‘শপথসমূহ’ প্রভৃতি অধ্যায়ে একাধিক সনদে আনা হ’লেও সূরা ছোয়াদের উপরোক্ত ৩৪ আয়াতের তাফসীরে ইমাম বুখারী আনেননি। এতে বুঝা যায় যে, ইমাম বুখারীর মতেও আলোচ্য হাদীছটি উক্ত আয়াতের তাফসীর নয়। বরং রাসূলূল্লাহ (সাঃ) অন্যান্য পয়গম্বরের যেমন বহু ঘটনা বর্ণনা করেছেন, এটাও তেমনি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। এটা কোন আয়াতের তাফসীর নয়।
বস্ত্ততঃ কুরআন পাকে এই ঘটনা উল্লেখ করার আসল উদ্দেশ্য হল মানুষকে একথা বুঝানো যে, তারা কোন বিপদাপদে বা পরীক্ষায় পতিত হলে যেন পূর্বাপেক্ষা অধিকভাবে আল্লাহর দিকে রুজু হয়। যেমন সুলায়মান (আঃ) হয়েছিলেন।
হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনী
সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্বকালে বেঈমান জিনেরা লোকদের ধোঁকা দিত এই বলে যে, সুলায়মান জাদুর জোরে সবকিছু করেন। তিনি কোন নবী নন। শয়তানদের ভেল্কিবাজিতে বহু লোক বিভ্রান্ত হচ্ছিল। এমনকি শেষনবী (সাঃ)-এর সময়েও যখন তিনি সুলায়মান (আঃ)-এর প্রশংসা করেন, তখন ইহুদী নেতারা বলেছিল, আশ্চর্যের বিষয় যে, মুহাম্মাদ সুলায়মানকে নবীদের মধ্যে শামিল করে হক ও বাতিলের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন জাদুকর মাত্র। কেননা স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ কি বায়ুর পিঠে সওয়ার হয়ে চলতে পারে? (ইবনু জারীর)।
এক্ষণে সুলায়মান (আঃ) যে সত্য নবী, তিনি যে জাদুকর নন, জনগণকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এবং নবীগণের মু‘জেযা ও শয়তানদের জাদুর মধ্যে পার্থক্য বুঝাবার জন্য আল্লাহ পাক হারূত ও মারূত নামে দু’জন ফেরেশতাকে ‘বাবেল’ শহরে মানুষের বেশে পাঠিয়ে দেন। ‘বাবেল’ হ’ল ইরাকের একটি প্রাচীন নগরী, যা ঐসময় জাদু বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। ফেরেশতাদ্বয় সেখানে এসে জাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে থাকেন এবং জাদুকরদের অনুসরণ থেকে বিরত হয়ে যেন সবাই সুলায়মানের নবুঅতের অনুসারী হয়, সেকথা বলতে লাগলেন।
জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য এই যে, জাদু প্রাকৃতিক কারণের অধীন। কারণ ব্যতীত জাদু সংঘটিত হয় না। কিন্তু দর্শক সে কারণ সম্পর্কে অবহিত থাকে না বলেই তাতে বিভ্রান্ত হয়। এমনকি কুফরীতে লিপ্ত হয় এবং ঐ জাদুকরকেই সকল ক্ষমতার মালিক বলে ধারণা করতে থাকে। আজকের যুগে ভিডিও চিত্রসহ হাযার মাইল দূরের ভাষণ ঘরে বসে শুনে এবং দেখে যেকোন অজ্ঞ লোকের পক্ষে নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিতে পড়া স্বাভাবিক। তেমনি সেযুগেও জাদুকরদের বিভিন্ন অলৌকিক বস্ত্ত দেখে অজ্ঞ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত।
পক্ষান্তরে মু‘জেযা কোন প্রাকৃতিক কারণের অধীন নয়। বরং তা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে সম্পাদিত হয়। নবী ব্যতীত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তাঁর ‘কারামত’ বা সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও একইভাবে সম্পাদিত হয়। এতে প্রাকৃতিক কারণের যেমন কোন সম্পৃক্ততা নেই, তেমনি সম্মানিত ব্যক্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা হাত নেই। উভয় বস্ত্তর পার্থক্য বুঝার সহজ উপায় এই যে, মু‘জেযা কেবল নবীগণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যারা আল্লাহভীতি, উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং পবিত্র জীবন যাপন সহ সকল মানবিক গুণে সর্বকালে সকলের আদর্শ স্থানীয় হন।
আর নবী ও অলীগণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নবীগণ প্রকাশ্যে নবুঅতের দাবী করে থাকেন। কিন্তু অলীগণ কখনোই নিজেকে অলী বলে দাবী করেন না। অলীগণ সাধারণভাবে নেককার মানুষ। কিন্তু নবীগণ আল্লাহর বিশেষভাবে নির্বাচিত বান্দা, যাদেরকে তিনি নবুঅতের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। নবীগণের মু‘জেযা প্রকাশে তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা কৃতিত্ব নেই। পক্ষান্তরে দুষ্ট লোকেরাই জাদুবিদ্যা শিখে ও তার মাধ্যমে নিজেদের দুনিয়া হাছিল করে থাকে। উভয়ের চরিত্র জনগণের মাঝে পরিষ্কারভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করে।
বস্ত্ততঃ সুলায়মান (আঃ)-এর নবুঅতের সমর্থনেই আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে বাবেল শহরে পাঠিয়ে ছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَاتَّبَعُوْا مَا تَتْلُوا الشَّيَاطِيْنُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَـكِنَّ الشَّيْاطِيْنَ كَفَرُوْا يُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوْتَ وَمَارُوْتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُوْلاَ إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُوْنَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُوْنَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَآرِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلاَّ بِإِذْنِ اللهِ وَيَتَعَلَّمُوْنَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنْفَعُهُمْ، وَلَقَدْ عَلِمُوْا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنْ خَلاَقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ- وَلَوْ أَنَّهُمْ آمَنُوْا واتَّقَوْا لَمَثُوْبَةٌ مِّنْ عِنْدِ اللهِ خَيْرٌ، لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ- (البقرة ১০২-১০৩)-
‘(ইহুদী-নাছারাগণ) ঐ সবের অনুসরণ করে থাকে, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। অথচ সুলায়মান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে জাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত এবং বাবেল শহরে হারূত ও মারূত দুই ফেরেশতার উপরে যা নাযিল হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। বস্ত্ততঃ তারা (হারূত-মারূত) উভয়ে একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা এসেছি পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই তুমি (জাদু শিখে) কাফির হয়ো না। কিন্তু তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যার দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। অথচ আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা তারা কারু ক্ষতি করতে পারত না। লোকেরা তাদের কাছে শিখত ঐসব বস্ত্ত যা তাদের ক্ষতি করে এবং তাদের কোন উপকার করে না। তারা ভালভাবেই জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করবে, তার জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ, যদি তারা জানতো’। ‘যদি তারা ঈমান আনত ও আল্লাহভীরু হত, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত, যদি তারা জানত’ (বাক্বারাহ ২/১০২-১০৩)।
বলা বাহুল্য, সুলায়মান (আঃ)-কে জিন, বায়ু, পক্ষীকুল ও জীবজন্তুর উপরে একচ্ছত্র ক্ষমতা দান করা ছিল আল্লাহর এক মহা পরীক্ষা। শয়তান ও তাদের অনুসারী দুষ্ট লোকেরা সর্বদা এটাকে বস্ত্তবাদী দৃষ্টিতে দেখেছে এবং যুক্তিবাদের ধূম্রজালে পড়ে পথ হারিয়েছে। অথচ আল্লাহর নবী সুলায়মান (আঃ) সর্বদা আল্লাহর নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করেছেন। আমরাও তার নবুঅতের প্রতি দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বাস স্থাপন করি।
বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ ও সুলায়মান (আঃ)-এর মৃত্যুর বিস্ময়কর ঘটনা
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম (আঃ)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বাগৃহ নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হযরত ইয়াকূব (আঃ) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তার প্রায় হাযার বছর পরে দাঊদ (আঃ) তার পুনর্নির্মাণ শুরু করেন এবং সুলায়মান (আঃ)-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হ’লেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও বাকী ছিল। এমন সময় হযরত সুলায়মানের মৃত্যুকাল ঘনিয়ে এল। এই কাজগুলি অবাধ্যতাপ্রবণ জিনদের উপরে ন্যস্ত ছিল। তারা হযরত সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে রেখে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভিতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হ’ল। আল্লাহর হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়ে গেল না। জিনেরা ভয়ে কাছে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হলে আল্লাহর হুকুমে কিছু উই পোকার সাহায্যে লাঠি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং সুলায়মান (আঃ)-এর লাশ মাটিতে পড়ে যায়। উক্ত কথাগুলি আল্লাহ বলেন নিম্নোক্ত ভাবে-
فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَى مَوْتِهِ إِلاَّ دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ الْجِنُّ أَن لَّوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوْا فِي الْعَذَابِ الْمُهِيْنِ- (سبا ১৪)-
‘অতঃপর যখন আমি সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহলে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আযাবের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না’ (সাবা ৩৪/১৪)। সুলায়মানের মৃত্যুর এই ঘটনা আংশিক কুরআনের আলোচ্য আয়াতের এবং আংশিক ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাছীর)।
সুলায়মানের এই অলৌকিক মৃত্যু কাহিনীর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে নবী-রাসূল যে-ই হৌন না কেন, এক সেকেন্ড আগপিছ হবে না।
(২) আল্লাহ কোন মহান কাজ সম্পন্ন করতে চাইলে যেকোন উপায়ে তা সম্পন্ন করেন। এমনকি মৃত লাশের মাধ্যমেও করতে পারেন।
(৩) ইতিপূর্বে জিনেরা বিভিন্ন আগাম খবর এনে বলত যে, আমরা গায়েবের খবর জানি। অথচ চোখের সামনে মৃত্যুবরণকারী সুলায়মান (আঃ)-এর খবর তারা জানতে পারেনি এক বছরের মধ্যে। এতে তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী অসার প্রমাণিত হয়