ইসলাম গ্রহণঃ-
সা’দের পিতা আবু ওয়াক্কাস ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তাঁর অন্তিম রোগশয্যায় রাসূল সা. তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। মাতা হামনাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলৈন। তবে প্রথমতঃ তাঁর পুত্র সা’দের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে হৈ চৈ ও বিলাপ শুরু করে লোকজন জড়ো করে ফেললেন। মায়ের কাণ্ড দেখে ক্ষোভে দুঃখে হতভম্ব হয়ে সা’দ ঘরের এক কোণে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ বিলাপ ও হৈ চৈ করার পর মা পরিষ্কার বলে দিলেনঃ ‘সা’দ যতক্ষণ মুহাম্মাদের রিসালাতের অস্বীকৃতির ঘোষণা না ভেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পান করব না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও আসব না। মার আনুগত্যের হুকুম তো আল্লাহও দিয়েছেন। আমার কথা না শুনলে অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে এবং মার সাথে তার কোন সম্পর্কও থাকবেন।’
হযরত সা’দ বড় অস্থির হয়ে পড়লেন। রাসূললের সা. খিদমতে হাজির হয়ে সব ঘটনা বিবৃত করলেন। রাসূললের সা. নিকট থেকে জবাব পাওয়ার পূর্বেই সূরা আল আনকবুতের অষ্টম আয়াতটি নাযিল হলঃ
‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার ওপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে বলে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের মেনো না।’
কুরআনের এ আয়াতটি হযরত সা’দের মানসিক অস্থিরতা দূর করে দিল। তাঁর মা তিনদিন পর্যন্ত কিছু মুখে দিলেন না, কারো সাথে কথা বললেন না এবং রোদ থেকে ছায়াতেও এলেন না। তাঁর অবস্থা বড় শোচনীয় হয়ে পড়ল। বার বার তিনি মার কাছে এসে তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তাঁর একই কথা, তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করতে হবে। অবশেষে তিনি মার মুখের ওপর বলে দিতে বাধ্য হলেঃ
‘মা, আপনার মতো হাজারটি মাও যদি আমার ইসলাম ত্যাগ করার ব্যাপারে জিদ করে পানাহারে ছেড়ে দেয় এবং প্রাণ বিসর্জন দেয়, তবুও সত্য দ্বীন পরিত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
হযরত সা’দের এ চরম সত্য কথাটি তাঁর মার অন্তরে দাগ কাটে। অবশেষে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। ইমাম মুসিলম তাঁর সহীহ গ্রন্থে ‘আল-ফাদায়িল’ অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবু বকর ছিলেন সা’দের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আবু বকরের দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
নবুওয়াতের তৃতীয় বছরে সুলাইম গোত্রের ’আমর ইবন ’আবাসা গোপনে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখনও প্রকাশ্য দাওয়াতের অনুমতি আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি। ইসলাম গ্রহণের পর ’আমর শিয়াবে আলী তালিবের এক কোণে নামায আদায় করছিলেন। কুরাইশরা প্রস্তর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তা দেখে দু’একজন মুসলমানের সাথে সা’দও এগিয়ে এলেন এবং উক্ত কুরাইশ কাফিরদের সাথে তাদের ঝগড়া ও হাতাহাতি শুরু হয়।
হযরত সা’দ তাঁর চাবুকটি দিয়ে এক কাফিরকে বেদম মার দিলেন। লোকটির দেহ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। কোন মুসলিমানের হাতে কোন মুশরিকের রক্ত ঝরানোর এ ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম।
হযরত মুসয়াব ইবন ’উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুমের মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর যে চার ব্যক্তি মদীনায় হিজরাত করেন তাঁদের একজন সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস। সহীহ বুখারীতে বারা ইবন আযিব থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ ‘সর্বপ্রথম আমাদের নিকট আগমণ করেন মুসয়াব ইবন ’উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম। এ দু’ব্যক্তি মদীনাবাসীদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। অতঃপর বিলাল, সা’দ ও আম্মার বিন ইয়াসির আগমন করেন। ইবন সা’দ ‘তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থে ওয়াকিদীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন, সা’দ ও তাঁর ভাই উমাইর মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় এসে তাদের অন্য এক ভাই ’উতবা ইবন আবী ওয়াক্কাসের নিকট অবস্থান করেন। তার কয়েক বছর পূর্বেই ’উতবা এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় নেয়।
আল্লাহর পথে জিহাদে হযরত সা’দের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতা ইসলাম-দুশমনদের খুব মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তিনিই প্রথম মুসলিম যিনি আল্লাহর পথে তীর নিক্ষেপ করেন। তিনি নিজেও বলতেন,
‘আমি প্রথম আরব যে আল্লাহর জন্য তীর চালনা করেছিল।’
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর বেশ কিছুকাল যাবত মুহাজির মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। তাদের না ছিল খাদ্য সম্ভার, না ছিল পরিধেয় বস্ত্র এবং না ছিল সুনির্দিষ্ট জীবিকার উপায় উপকরণ। মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের চাপে মদীনায় সীমিত পরিসরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিতটি নড়ে উঠেছিল। মদীনার আনসার-মুহাজির নির্বিশেষে গোটা মুসলিম সমাজ চরম আর্থিক দুর্গতির মধ্যে নিপতিত হয়। এমন চরম দারিদ্রের মধ্যে তাঁরা ইসলামের প্রচার প্রসারের কাজ জারি রাখেন এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁদের এ চরম দারিদ্র সম্পর্কে হযরত সা’দ বলেনঃ
‘আমরা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাম; অথচ তখন গাছের পাতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার কিছুই থাকতো না। (তা খেয়েই আমরা জীবন ধারণ করতাম) আর আমাদের বিষ্ঠা হত উট ছাগলের বিষ্ঠার মত।’- (বুখারী ও মুসলিমঃ মানাকিবু সা’দরা.)
হিজরাতের এক বছর পর সফর মাসে রাসূল সা. ষাটজন উষ্ট্রারোহীর একটি দলকে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে টহল দিতে পাঠালেন। এ দলে হযরত সা’দও ছিলেন। এক পর্যায়ে ইকরিমা ইবন আবী জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশদের বিরাট একটি দল তাঁরা দেখতে পেলেন। কিন্তু উভয় পক্ষ সংঘর্ষ এড়িয়ে গেল। তবে কুরাইশ পক্ষের কেউ একজন হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে হযরত সা’দ সাথে সাথে তীর নিক্ষেপ করলেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে কাফিরদের প্রতি নিক্ষিপ্ত প্রথম তীর।
হিজরী দ্বিতীয় সনের রবিউস সানী মাসে রাসূল সা. দু’শো সাহাবীকে সংগে নিয়ে মদীনা থেকে বের হলেন। উদ্দেশ্য, মদীনার আশে পাশে দুশমনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং দুশমনদের জানিয়ে দেওয়া যে মুসলমানরা ঘুমিয়ে নেই। এ বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন হযরত সা’দ রা.। বাওয়াত নামক স্থানে কুরাইশদের সাথে এবার ছোট খাট একটি সংঘর্ষও হয়। এর ছয়মাস পর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বদর যুদ্ধের অল্প কয়েকদিন আগে রাসূল সা. কুরাইশ কাফিলার সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিন জনের যে দলটি পাঠান তাদের একজন ছিলেন সা’দ রা.। তাঁরা বদরের কূপের নিকট ওৎ পেতে থেকে প্রতিপক্ষের দু’জনকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে আসেন। রাসূল সা. তাঁদের নিকট থেকে শত্রু পক্ষের অনেক তথ্য অবগত হন।
যুদ্ধে অংশগ্রহণঃ-
বদরে সা’দ ও তাঁর ভাই ’উমাইর রা. অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে লড়েন। প্রত্যেকেই একাধিক কাফিরকে হত্যা করে জাহান্নামে পাঠান। এ যুদ্ধে হযরত ’উমাইর রা. শাহাদাত বরণ করেন। এবং সা’দ রা. সাঈদ ইবন আ’সকে হত্যা করে তার তলোয়ারখানি নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট সমর্পণ করেন। তিনি রাসূলের সা. নিকট তলোয়ারখানি পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জবাবে তিনি বললেনঃ এ তলোয়ার না তোমার না আমার। সা’দ রাসূলের সা. নিকট থেকে উঠে কিছুদূর যেতে না যেতেই সূরা আনফাল নাযিল হয়। অতঃপর রাসূল সা. তাঁকে ডেকে বলেনঃ ‘তোমার তলোয়ার নিয়ে যাও।’
উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদরের এক বছর পর। হযরত সা’দ এ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কতিপয় মুসলিম সৈনিকের ভুলের কারণে নিশ্চিত বিজয় যখন পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়, তখন মুষ্টিমেয় যে ক’জন সৈনিক নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাসূলকে সা. ঘিরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন, সা’দ রা. ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ইমাম বুখারী এ ঘটনা সা’দের রা. যবানেই বর্ণনা করেছেনঃ
’উহুদের দিনে রাসূল সা. তাঁর তুনীর আমার সামনে ছড়িয়ে দিলেন এবং বললেনঃ
তীর মার! আমার মা-বাবা তোমার প্রতি কুরবান হোক।’ ইবন সা’দ আরও বলেছেনঃ ‘ঘটনাক্রমে একটি তুনীর ফলা ছিলনা। সা’দ রা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ এটাতো খালি। বললেনঃ ওটাও ছুঁড়ে দাও।’ হযরত সা’দের এক ভাই ’উমাইর বদর যুদ্ধে শহীদ হন। উহুদের যুদ্ধে সা’দ রা. যখন কাফিরদের প্রবল আক্রমণ থেকে রাসূলকে সা. হিফাজতের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে লড়ছেন, ঠিক তখনই তাঁর অন্য ভাই নরাধম ’উতবার নিক্ষিপ্ত প্রস্তরাঘাতে প্রিয় নবীর মুখ আহত হয় এবং একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। সা’দ রা. প্রায়ই বলতেনঃ কাফিরদের অন্য কাউকে হত্যার এত প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না যেমন ছিল ’উতবার ব্যাপারে। কিন্তু যখন আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনলাম, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের চেহারা রক্ত-রঞ্জিত করেছে, তার ওপর আল্লাহর গজব আপতিত হবে, তখন তার হত্যার আকাঙ্ক্ষা আমার নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং আমার অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে। উহুদের যুদ্ধে তিনি এক অস্বাভাবিক দৃশ্য অবলোকন করেন। তিনি বলেনঃ ‘উহুদের দিন আমি রাসূলুল্লাহর সা. ডানে ও বামে ধবধবে সাদা দু’ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। কাফিরদের সাথে তারা প্রচণ্ড লড়ছে। এর আগে বা পরে আর কখনও আমি তাদেরকে দেখিনি।’
খন্দকের যুদ্ধ হয় উহুদের দু’বছর পর। এ যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং একজন চতুর কাফির ঘোরসওয়ারের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে তার চোখ এমনভাবে এফাঁড় ওফোঁড় করেন যে, তা দেখে রাসূল সা. হঠাৎ হেসে ওঠেন। খন্দকের যুদ্ধে সালা পর্বতের এক উপত্যকায় রাসুলের সা. জন্য একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়। এক ঠাণ্ডার রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে রসূল সা. একাকী শুয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেলেন্। জিজ্ঞেস করলেনঃ কে? উত্তর পেলেনঃ সা’দ- আবী ওয়াক্কাসের পুত্র। কি জন্য এসেছ? বললেনঃ সা’দের হাজার জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রাসূল হচ্ছেন তার প্রিয়তম। এ অন্ধকার ঠাণ্ডা রাতে আপনার ব্যাপারে আমার ভয় হল। তাই পাহারার জন্য হাজির হয়েছি। আল্লাহর নবী বললেনঃ সা’দ! আমার চোখ খোলা ছিল। আমি আশা করছিলাম আজ যদি কোন নেককার বান্দা আমার হিফাজত করত!
হিজরী দশম সনে রাসূলুল্লাহর সা. বিদায় হজ্জের সংগী ছিলেন সা’দও। কিন্তু হজ্জের পূর্বেই মক্কায় তিনি দারুণভাবে পীড়িত হয়ে পড়েন। জীবনের আশা এক প্রকার ছেড়ে দিলেন। এ সময় রাসুল সা. মাঝে মাঝে এসে তাঁর খোঁজ-খবর নিতেন। হযরত সা’দ বললেনঃ একদিন তিনি আমার সাথে কথা বলার পর আমার কপালে হাত রাখলেন। তারপর মুখমণ্ডলের ওপর হাতের স্পর্শ বুলিয়ে পেট পর্যন্ত নিয়ে গেলেন এবং দুআ করলেনঃ হে আল্লাহ, আপনি সা’দকে শিফা দান করুন, তার হিজরাতকে পূর্ণতা দান করুন। অর্থাৎ হিজরাতের স্থান মদীনাতেই তার মৃত্যুদান করুন। হযরত সা’দ বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহর সা. হাতে সেই শীতল স্পর্শ ও প্রশান্তি আজও আমার অন্তরে অনুভব করে থাকি।’ তিনি সুস্থ হয়ে আরও পঁয়তাল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন।
হযরত আবু ’উবাইদা ও মুসান্নার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পারস্যের কিসরা বাহিনীকে পরাজিত করে ইরাক জয় করে নিয়েছে। ইরাক এখন মুসিলম বাহিনী নিয়ন্ত্রণে। কিসরার স্বজনবৃন্দ নিজেদের সকল প্রকার মতভেদ ভুলে গিয়ে ইয়াজদিগির্দকে সিংহাসনে বসিয়ে সেনাপতি রুস্তমের নেতৃত্বে নতুন করে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণের জন্য বিরাট বাহিনী গড়ে তুলেছে। হযরত উমার এ প্রস্তুতির খবর পেলেন। তিনি নিজেই মুসান্নার সাহায্যে একটি বাহিনী নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। কিন্তু মজলিসে শূরার অনুমতি না পেয়ে শূরার সিদ্ধান্ত মুতাবিক সা’দকে পাঠালেন এবং তাঁকেই নিযুক্ত করলেন ইরানী ফ্রন্টের সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। হযরত সা’দ রা. মদীনা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে কাদেসিয়া পৌঁছলেন। তাঁর পৌঁছার পূর্বেই মুসান্না ইনতিকাল করেন। এ কাদেসিয়া প্রান্তরে সেনাপতি সা’দের নেতৃত্বে মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে এক চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বিশাল পারস্য বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যুহ তছনছ হয়ে যায় এবং একের পর এক তারা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে।
সাসানী সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েনের পথে মুসলিম বাহিনী ‘বাহ্রাসীর’ দখল করে আছে। এ বাহ্রাসীর ও মাদায়েনের মধ্যে উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ দিজলা নদী প্রবাহিত। হযরত সা’দ খবর পেলেন, শাহানশাহ ইয়াজদিগির্দ রাজধানী মাদায়েন থেকে সকল মূল্যবান সম্পদ সরিয়ে নিচ্ছে। হযরত সা’দ সৈন্য বাহিনী নিয়ে দ্রুত মাদায়েনের দিকে অগ্রসর হলেন। দিজলা তীরে এসে দেখলেন, ইরানীরা নদীর পুলটি পূর্বেই ধ্বংস করে দিয়েছে। এ দিজলার তীরে তিনি মুসিলম মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। ভাষণটির সার সংক্ষেপ নিম্নরূপঃ
‘ওহে আল্লাহর বান্দারা, দ্বীনের সিপাহীরা! সাসানী শাসকরা আল্লাহর বান্দাহদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে মিথ্যা ও বানোয়াট কথার মাধ্যমে ধোঁকা দিয়ে অগ্নি ও সূর্যের উপাসনা করতে বাধ্য করেছে। তাদের ঘামঝরা কষ্টোপার্জিত সম্পদ নিজেদের পুঞ্জিভূত করেছে। তোমরা যখন তাদের পরিত্রাণদাতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে তখন তারা পালাবার পথ ধরেছে এবং দরিদ্র জনসাধারণের ধন সম্পদ ঘোড়া ও গাধার পিঠে বোঝাই করেছে। আমরা কক্ষণো তাদের এমন সুযোগ দেব না। তাদের বাহনের ওপর বোঝাইকৃত ধন-ভাণ্ডর যাতে আমরা ছিনিয়ে নিতে না পারি এজন্য তারা পুল ভেঙ্গে দিয়েছে। কিন্তু ইরানীরা আমাদের সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। তারা জানে না আল্লাহর ওপর ভরসাকারীরা, মানবতার সেবকরা, পুল বা নৌকার ওপর ভরসা করে না। আমি পরম দয়ালু-দাতা আল্লাহর নামে আমার ঘোড়াটি নদীতে নামিয়ে দিচ্ছি। তোমরা আমার অনুসরণ কর। একজনের পেছনে অন্যজন, একজনের পাশে অন্যজন সারিবদ্ধভাবে তোমরা দিজলা পার হও। আল্লাহ তোমাদের সাহায্য ও হিফাজত করুন।’
ভাষণ শেষ করে হযরত সা’দ বিসমিল্লাহ বলে নিজের ঘোড়াটি নদীর মধ্যে চালিয়ে দিলেন। অন্য মুজাহিদরাও তাঁদের সেনাপতিকে অনুসরণ করলেন। নদী ছিল অশান্ত। কিন্তু আল্লাহর সিপাহীদের সারিতে একটু বিশৃঙ্খলা দেখা দিল না। তাঁরা সারিবদ্ধভাবে নদী পার হয়ে অপর তীরে পৌঁছলেন। ইরানী সৈন্যরা একটু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিল। তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। অবলীলাক্রমে তারা চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘দৈত্য আসছে, দানব আসছে। পালাও পালাও।’ মুসলিম মুজাহিদদের এ আকস্মিক হামলায় বাদশাহ ইয়াজদিগির্দ অগণিত ধনরত্ন ফেলে মাদায়েন ত্যাগ করে হালওয়ানের দিকে যাত্রা করে। হযরত সা’দ নির্জন শ্বেত প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। পরিবেশ ছিল ভয়াবহ। প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষ ছিল যেন শিক্ষা ও উপদেশের স্মারক। হযরত সা’দের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো সূরাদুখানের এ আয়াতগুলিঃ
‘তারা পেছনে ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্য ক্ষেত্র ও সুরম্য প্রাসাদ এবং কত বিলাস-উপকরণ, যা তাদেরকে আনন্দ দিত! এমনটি ঘটেছিল এবং আমি এ সবকিছুর উত্তরাধিকারী করেছিলাম অন্য সম্প্রদায়কে।’ (সূরা দুখানঃ ২৫–২৮)
হযরত সা’দ শ্বেত প্রাসাদে প্রবেশ করে আট রাকয়াত ‘সালাতুল ফাতহ’ আদায় করেন। তারপর তিনি ঘোষণা দেন, এ শাহী প্রাসাদে আজ জুমআর জামাআত অনুষ্ঠিত হবে। অতঃপর মিম্বর তৈরী করে জুমআর নামায আদায় করেন। এটাই ছিল পারস্যে প্রথম জুমআর নামায।
মাদায়েন বিজয়ের পর খলীফা উমার রা. সেনাপতি সা’দকে নির্দেশ দেন, তিনি নিজে যেন ইরানীদের পেছনে ধাওয়া না করেন, বরং এ কাজের জন্য অন্য কাউকে নির্বাচন করে দায়িত্ব দেন। অতঃপর খলীফার আদেশে তিনি অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা, প্রশাসনের পুনর্গঠন, ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং নও মুসলিমদের তালীম ও তারবিয়াতে আত্মনিয়োগ করেন। যে মাদায়েন ছিল শত শত বছর ধরে অগ্নি উপাসকদের কেন্দ্রভূমি এবং যে মাদায়ের কখনও শোনেনি এক আল্লাহর নাম, সেখানে প্রথম বারের মত হযরত সা’দ নির্মাণ করেন এক জামে মসজিদ। ইরানের অন্যান্য শহরেও তিনি মসজিদ নির্মাণ করেন। আরব মুসলমানদের বসবাসের জন্য কুফা শহরের সম্প্রসারণ করেন। ইরাকের বসরা শহরের স্থপতিও তিনি।
খলীফা উমার হযরত সা’দকে কুফার গভর্ণর নিয়োগ করেন। কিছু দিন পর তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় কুফাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পদ থেকে তাঁকে বরখাস্ত করেন। কুফায় সা’দ নিজের জন্য যে প্রাসাদটি তৈরী করেছিলেন, ’উমারের রা. নির্দেশে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা মদীনা থেকে কুফা গিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেন। (মাজমূ’ ফাতাওয়া–ইবন তাইমিয়া, খণ্ড ৩৫ পৃঃ ৪০)
হযরত সা’দের বিরুদ্ধে উসামা ইবন কাতাদা নামক কুফার যে লোকটি খলীফা উমারের নিকট কসম করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিল, সা’দ তার ওপর বদ-দুআ করে তিনটি জিনিস তার জন্য আল্লাহর নিকট কামনা করেনঃ আল্লাহ যেন তাকে দীর্ঘজীবি করেন, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত করেন এবং তার সত্তাকে ফিতনার শিকারে পরিণত করেন। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, তাঁর এ দুআ অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ তিনি তো ছিলেন ‘মুজতাজাবুদ দাওয়াহ’। স্বয়ং রাসূল সা. তাঁর জন্যে দু’আ করেছেনঃ ‘হে আল্লাহ, আপনি সা’দের দু’আ কবুল করুন, যখন সে দু’আ করবে।
হযরত ’উমার রা. সা’দের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ যে সত্য বলে বিশ্বাস করেছিলেন তা কিন্তু ঠিক নয়। তাই তিনি বলেছেঃন ‘আমি সা’দকে রাষ্ট্র প্রশাসনে অযোগ্য বা তার প্রতি আস্থাহীনতার কারণে বরখাস্ত করিনি।’(বুখারীঃ কিতাবুল মানাকিব) হযরত সা’দ যে খলীফা উমারের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসভাজন ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মৃত্যুর পূর্বে পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্য বিশিষ্ট যে বোর্ডটি গঠন করে দিয়ে যান তাতে হযরত সা’দের অন্তর্ভুক্তির মধ্যে। সা’দ সম্পর্কে তাঁর অন্তিম বাণী ছিলঃ ‘যদি খিলাফতের দায়িত্ব সা’দ পেয়ে যান, তাহলে তিনি তার উপযুক্ত। আর তা যদি না হয়, তবে যিনি খলীফা হবেন তিনি যেন তাঁর সাহায্য গ্রহণ করেন।’ (বুখারীঃ কিতাবুল মানাকিব ও আল–ইসাবা)।
হযরত উসমান তাঁর খিলাফতের প্রথম বছরেই পুনরায় সা’দকে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিন্তু কিছদিনের মধ্যে কুফার কোষাধ্যক্ষ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ ও তাঁর মধ্যে কোন একটি বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় খলীফা সা’দকে প্রত্যাহার করেন। ইবন সাবার আনসারী হাঙ্গামাবাজরা খলীফা উসমানকে ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে মদীনায় প্রবেশ করেছে। খলীফা মসজিদে নববীতে জুমআর নামাযের খুতবার মধ্যে হাঙ্গামাবাজদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করলেন। তারাও পাথর নিক্ষেপ করে খলীফাকে আহত করে। এ সময় তাদের প্রতিরোধে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন হযরত সা’দ। তারপর অন্যান্য সাহাবীরা একযোগে উঠে তাদের হটিয়ে দেন।
বিদ্রোহীদের হাতে হযরত উসমান শহীদ হলেন। হযরত সা’দ তখন মদীনায়। মদীনাবাসীরা হযরত আলীকে খলীফা মনোনীত করে তাঁর হাতে বাইয়াত করলেন। আলীর রা. হাতে বাইয়াতের জন্য লোকেরা যখন সা’দের বাড়ীতে গেল, তিনি তাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেনঃ ‘যতক্ষণ না সব মানুষ বাইয়াত করেছে, আমি করব না। তবে আমার পক্ষ থেকে কোন বিপদের আশঙ্কা নেই।’
হযরত উসমানের হত্যাকান্ডের পর ইসলামের ইতিহাসে যে বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা হয় তার আলোচনা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। তবে এ সময় হযরত সা’দের ভূমিকা বুঝার জন্য এততটুকু ইঙ্গিত প্রয়োজন যে, সে সময় ইসলামী উম্মাত তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল হযরত আলীর পক্ষে, একদল তাঁর বিপক্ষে এবং একদল নিরপেক্ষ। হযরত আলীর পক্ষে, বিপক্ষের উভয় দলেই যেমন বিশিষ্ট সাহাবীরা ছিলেন, তেমনিভাবে ছিলেন এ নিরপেক্ষ দলেও। তাঁরা কোন মুসলমানের পক্ষে বিপক্ষে তরবারি উত্তোলনকে জায়েয মনে করেননি। এ কারণে আমরা হযরত সা’দকে দেখতে পাই তিনি উট বা সিফফিনের যুদ্ধে কোন পক্ষেই যোগ দেননি, তখন তিনি মদীনায় নিজ গৃহে অবস্থান করছেন।
মোটকথা, হযরত উসমানের শাহাদাতের পর তিনি নির্জনতা অবলম্বন করেন। একবার তিনি তাঁর উটের আস্তাবলে তাঁর পুত্র উমারকে আসতে দেখে বললেনঃ ‘আল্লাহ এ অশ্বারোহীর অনিষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করুন।’ অতঃপর উমার এসে পিতাকে বললেনঃ ‘আপনি উট ও ছাগলের মধ্যে সময় অতিবাহিত করছেন, আর এদিকে লোকেরা রাষ্ট্রীয় ঝগড়ায় লিপ্ত।’ হযরত সা’দ পুত্রের বুকের উপর হাত দিয়ে আঘাত করে বললেনঃ ‘চুপ কর!’ আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ ভালোবাসেন নির্জনবাসী, মুত্তাকী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যে মানুষের রাগ বিরাগের পরোয়া করেনা, তাকে।
হযরত সা’দ আলীর হাতে বাইয়াত করে পুনরায় তাঁর দলত্যাগী খারেজীদের ফাসিক বলে মনে করতেন। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর তাঁর পুত্র উমার তাঁর নিকট এসে বলেনঃ খিলফাত পরিচালনার জন্য এখন উম্মাতে মুসিলমার একজন বিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। আমাদের ধারণায় আপনিই এর উপযুক্ত। এতটুকু বলতেই তিনি বলে ওঠেনঃ ‘থাক, হয়েছে। আমাকে আর উৎসাহিত করতে হবে না।’
হযরত সা’দ মদীনা থেকে দশ মাইল দূরে আকীক উপত্যকায় কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ইনতিকাল করেন। জীবনীকারদের মধ্যে তাঁর মৃত্যুসন সম্পর্কে মতভেদ আছে। তবে হিজরী ৫৫ সনে ৮৫ বছর বয়সে তাঁর ইনতিকাল হয় বলে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি আছে। ইবন হাজার তাঁর ‘তাহজীব’ গ্রন্থে এ মতই সমর্থন করেছেন। গোসল ও কাফনের পর লাশ মদীনায় আনা হয়। মদীনার তৎকালীন গভর্ণর মারওয়ান জানাযার ইমামতি করেন। সহীহ মুসলিমের একাধিক বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর জানাযার বিষয়টি বিস্তারিত জানা যায়।
মৃত্যুঃ-
হযরত সা’দের ইনতিকালের পর উম্মুল মু’মিনীন হযরত ’আয়িশা ও অন্যান্য আযওয়াজে মুতাহ্হারাহ্ বলে পাঠালেন, তাঁর লাশ মসজিদে আনা হোক, যাতে আমরা জানাযার শরীক হতে পারি। কিন্তু লোকেরা লাশ মসজিদে নেয়া যেতে পারে কিনা এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। হযরত আয়িশা রা. একথা জানতে পেরে বললেনঃ ‘তোমরা এত তাড়াতাড়িই ভুলে যাও? রাসূল সা. তো সুহাইল ইবন বায়দার জানাযা এই মসজিদে আদায় করেছেন।’ অতঃপর লাশ উম্মুহাতুল মু’মিনীনের হুজরার নিকট আনা হল এবং তাঁরা নামায আদায় করলেন।
মরণকালে হযরত সা’দ রা. বহু অর্থ-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি একটি অতি পুরাতন পশমী জুববা চেয়ে নিয়ে বলেনঃ ‘এ দিয়েই তোমরা আমাকে কাফন দেবে। এ জুব্বা পরেই আমি বদর যুদ্ধে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমার ইচ্ছা, এটা নিয়েই আমি আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হই।’
হযরত সা’দের ছেলে মুসয়াব বলেনঃ আমার পিতার অন্তিম সময়ে তাঁর মাথাটি আমার কোলের ওপর ছিল। তাঁর মুমূর্ষ অবস্থা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ বেটা কাঁদছ কেন? বললামঃ আপনার এ অবস্থা দেখে। বললেনঃ ‘আমার জন্য কেঁদোনা। আল্লাহ কক্ষণো আমাকে শাস্তি দেবেন না, আমি জান্নাতবাসী। আল্লাহ মু’মিনদেরকে তাদের সৎকাজের প্রতিদান দেবেন এবং কাফিরদের সৎকাজের বিনিময়ে তাদের শাস্তি লাঘব করবেন।’ (হায়াতুস সাহাবা– ৩/৫৪)
রাসূল সা., খুলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবীদের নিকট হযরত সা’দের মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল অতি উচ্চে। তাঁরা তাঁর মতামতকে যে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করতেন, বহু হাদীসের মাধ্যমে একথা জানা যায়। একবার সা’দ মোজার ওপর মসেহ সংক্রান্ত একটি হাদীস বর্ণনা করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার তাঁর পিতা হযরত উমার ফারুক রা. থেকে হাদীসটির সত্যতা যাচাই করতে চাইলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হাদীসটি কি সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস থেকে শুনেছ? বললেনঃ ‘হাঁ। উমার বললেনঃ হাঁ সা’দ যখন তোমাদের নিকট কোন হাদীস বর্ণনা করে, তখন সে সম্পর্কে অন্য কারো নিকট কিছু জিজ্ঞেস করবে না।’
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে চারজন ছিলেন সর্বাধিক কঠোরঃ উমার, আলী যুবাইর, সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুম। রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় হযরত বিলালের অনুপস্থিতিতে সা’দ তিনবার আযান দিয়েছেন। রাসুল সা. তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমার সংগে বিলালকে না দেখলে তুমি আযান দেবে।’ (হায়াতুস সাহাবা ৩/১১৬)
হযরত সা’দ রাসূল সা. থেকে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর নিকট থেকে তাঁর ছেলে-মেয়েরা, যেমন, ইবরাহীম, আমের, মুসয়াব, মুহাম্মাদ, আয়িশা এবং বিশিষ্ট সাহাবীরা, যেমন, আয়িশা, ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জাবির রা. এবং বিশিষ্ট তাবেয়ীরা, যেমন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব আবু উসমান আন-নাহদী, কায়িস ইবন আবী হাযিম, আলকামা, আহনাফ ও অন্যরা হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল–ইসাবা ৩/৩৩)
হযরত সা’দের মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। প্রাচীন সূত্রগুলিতে তাঁর কিছু কবিতা সংকলিত হয়েছে। ইবন হাজার‘আল–ইসাবা’ গ্রন্থে কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করেছেন।
হযরত সা’দের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ’ অর্থাৎ জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের অন্যতম এবং তিনি এ দলের সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।