আরব জাতিঃ মধ্যপ্রাচ্যের মূল অধিবাসী হ’লেন আরব জাতি। সেকারণ একে আরব উপদ্বীপ (جزيرة العرب) বলা হয়। আরবরা মূলতঃ তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত।
১. আদি আরব (العربُ البائدةُ) যারা আদ, ছামূদ, আমালেক্বা প্রভৃতি আদি বংশের লোক। যাদের বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া যায় না।
২. ক্বাহত্বানী আরব (العربُ العارِبَةُ)। যারা ইয়ামনের অধিবাসী। এরা ইয়া‘রাব বিন ইয়াশজাব বিন ক্বাহত্বানের বংশধর।
৩. ‘আদনানী আরব (العربُ الْمُسْتَعْرِبَةُ)। এরা ইরাক থেকে আগত ইবরাহীম-পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশোদ্ভূত ‘আদনান-এর বংশধর। এদের বংশেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্ম হয়।
আরবের অবস্থানস্থলঃ তিনদিকে সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যাপী বিশ্বসেরা আরব উপদ্বীপ কেবল পৃথিবীর মধ্যস্থলেই অবস্থিত নয়, বরং এটি তখন ছিল চতুর্দিকের সহজ যোগাযোগস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি। বর্তমান ফ্রান্সের প্রায় দ্বিগুণ এই বিশাল ভূখন্ডটির অধিকাংশ এলাকা মরুময়।
অথচ এই ধূসর মরুর নীচে রয়েছে আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা বিশ্বের মধ্যে মূল্যবান তরল সোনার সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এর পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্বে আরব উপসাগর। যা গ্রীকদের নিকট পারস্য উপসাগর নামে খ্যাত। দক্ষিণে আরব সাগর (যা ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ) এবং উত্তরে সিরিয়া ও ইরাকের ভূখন্ড। পানিপথ ও স্থলপথে আরব উপদ্বীপ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশের সাথে যুক্ত।
নবুঅতের কেন্দ্রস্থলঃ আদি পিতা আদম, নূহ, ইদ্রীস, হূদ, ছালেহ, ইবরাহীম, লূত্ব, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, শু‘আয়েব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহইয়া ও ঈসা (‘আলাইহিমুস সালাম) এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সহ সকল নবী ও রাসূলের আবির্ভাব ও কর্মস্থল ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এই পবিত্র ভূখন্ড। এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে আমাদের ধারণায়ঃ
প্রথম কারণ ছিল অনুর্বর এলাকা হওয়ায় এখানকার অধিবাসীগণ ব্যবসায়ে অভ্যস্ত ছিল। ফলে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আরবদের নিয়মিত বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সেকারণ খুব সহজেই এখান থেকে নবুঅতের দাওয়াত সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত।
দ্বিতীয় কারণ হ’ল এই ভূখন্ডে ছিল দু’টি পবিত্র স্থানের অবস্থিতি। প্রথমটি ছিল মক্কায় বায়তুল্লাহ বা কা‘বাগৃহ। যা হযরত আদম (আঃ) কর্তৃক প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর ইবরাহীম ও তৎপুত্র ইসমাঈলের হাতে পুনর্নির্মিত হয়। দ্বিতীয়টি ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা কা‘বাগৃহের চল্লিশ বছর পর আদম-পুত্রগণের কারু হাতে প্রথম নির্মিত হয়, যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ)-এর পৌত্র ইয়াকূব বিন ইসহাক (আঃ) কর্তৃক নির্মিত হয়। অতঃপর দাউদ ও সুলায়মান (আঃ) কর্তৃক পুনর্নির্মিত হয়। ইবরাহীমপুত্র ইসমাঈল-এর বংশধরগণ মক্কা এলাকা আবাদ করেন। তাঁরাই বংশ পরম্পরায় বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, হাজী ছাহেবদের জান-মালের হেফাযত এবং তাদের পানি সরবরাহ, আপ্যায়ন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধরগণ বায়তুল মুক্বাদ্দাস তথা আজকের ফিলিস্তীন এলাকায় বসবাস করেন। ইসহাক-পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ (إسرائيل বা ‘আল্লাহর দাস’)। সেকারণ তাঁর বংশধরগণ ‘বনু ইস্রাঈল’ নামে পরিচিত। এভাবে আরব উপদ্বীপের দুই প্রধান এলাকা সহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর বনু ইসমাঈল ও বনু ইস্রাঈল কর্তৃক তাওহীদের দাওয়াত প্রসার লাভ করে। সাথে সাথে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি সর্বত্র বিস্তৃত হয়।
আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মনোনীত করেছেন আদম ও নূহকে এবং ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে জগদ্বাসীর মধ্য হ’তে’। ‘তারা একে অপরের সন্তান। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪; আনকাবূত ২৯/২৭)। ইমরান ছিলেন মূসা (আঃ)-এর পিতা অথবা মারিয়াম-এর পিতা। সকলের মূল পিতা হ’লেন আবুল আম্বিয়া ইবরাহীম (আঃ)। পৃথকভাবে ‘আলে ইমরান’ বলার মাধ্যমে মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর বিশাল সংখ্যক উম্মতকে বুঝানো হয়েছে। আর ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে শেষনবী ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটেছে। যাঁর উম্মত সংখ্যা দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাধিক।