হযরত মরিয়ম আ. যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন নবী হযরত যাকারিয়া আ. এর যামানা। ঐ সময় বনী ইস্রাঈল বংশদ্ভূত হান্না নাম্নী এক পূণ্যবতী রমনী ছিলেন। তাঁর স্বামী ছিলেন ইমরান বিন লাখাম।
তিনি পরম ধার্মিক ও বাইতুল মুকাদ্দাসের সম্মানিত ইমাম ছিলেন। আর তাঁর পিতা লাখাম ছিলেন হযরত সুলাইমান আ. এর বংশধর। হান্নার এক ভগ্নি ছিলেন তাঁর নাম ছিল উশা বা আশা বিনতে ফাকুজ। হযরত যাকারিয়া আ. এর স্ত্রী ছিলেন তিনি। হান্না এবং ইমরান দম্পত্তি বৃদ্ধকাল পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন।
জনশ্রুতি আছে তাঁহার ভগ্নি উশাও বন্ধ্যা ছিলেন। কথিত আছে যে, ইমরানের স্ত্রী হান্না একদা একটি বৃক্ষলতায় উপবিষ্ট ছিলেন এমন সময় ঐ বৃক্ষশাখার দিকে দৃষ্টি পতিত হওয়ায় দেখলেন যে, একটি পাখির ডিম্ব হতে একটি বাচ্চা বের হয়ে কিচির-মিচির করে ডাকতে শুরু করল।
অমনি পাখিটি তাকে নিজের বুকের তলায় নিয়ে আহার করাতে লাগল। এই দৃশ্য অবলোকন করে হান্নার মনে একটি সন্তানের আকাঙ্খা প্রবলতর হল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সন্তান লাভের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন। শুধু তাই নয় বাইতুল মাকদাসে গমন করেও আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন যে, হে মাবূদ! আপনি অনুগ্রহ পূর্বক আমাকে একটি সন্তান দান করুন।
পার্থিব কোন স্বার্থের জন্য এই সন্তান কামনা করিনি। বরং তাকে আমরা আপনার পবিত্র মসজিদ বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতেই উৎসর্গ করব।
এই ছিল হান্নার মনের একান্ত কামনা-বাসনা। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বাসনা কবুল করে তাঁর গর্ভে একটি সন্তান দান করলেন। পেটে সন্তান স্থান নিয়েছে বলে অনুভব করলে তিনি ও তাঁর স্বামী এক নতুন ভাবনায় নিমজ্জিত হলেন।
যদি সন্তানটি ছেলে হয় তবে উদ্দেশ্য সফলই হবে। আর যদি মেয়ে হয় তা হলে মানত কিভাবে পূর্ণ করা হবে? এই ভাবনায় হান্না আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন।
ভাবনা-চিন্তার অবসান ঘটিয়ে যথা সময় বিবি হান্না একটি মেয়ে সন্তান প্রসব করলেন। এতে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং আল্লাহর দরবারে আবেদন করলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো মানত করেছিলাম যে, আমার একটি সন্তান হলে আমি তাকে আপনার মসজিদে খেদমতে নিযুক্ত করব।
এখন দেখা যাচ্ছে যে আমার একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে। এখন আমি কিভাবে আমার মানত পূরা করব? তখন তাঁকে আল্লাহ তা’আলা শান্তনা প্রদান করার জন্য ইরশাদ করলেন, হে হান্না! তুমি দুঃখিত হয়োনা। আমি তোমাকে যে কন্যা সন্তান দান করেছি কোন পুরুষ সন্তান তাঁর সমতুল্য হবে না।
আল্লাহ তা’আলা তাকে আরও জানিয়ে দিলেন যে, আন্তরিক সৎ উদ্দেশ্য আমার নিকট গ্রহণীয়। ছেলে বা মেয়ে কোন কথা নয়। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে এই বাণী শ্রবণ করে শান্ত হৃদয়ে বলে উঠলেন যে, আমি এই কন্যার নাম রাখলাম ‘মরিয়ম’। আমি তাঁর ও তার ভবিষ্যৎ বংশধরদের বিতাড়িত ইবলিশের ফেৎনা হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আল্লাহ তা’আলা তাঁকে অবগত করালেন, তোমার প্রার্থনা আমি কবুল করলাম। তুমি তোমার কন্যাটিকে যাকারিয়ার হাতে সমর্পন কর। যাকারিয়া আ. ছিলেন তৎকালীন নবী এবং মরিয়মের খালু। হযরত যাকারিয়া আ. এ সময়ে সদা-সর্বদা বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান করতেন।
সে সময়ে বাইতুল মুকাদ্দাসের তত্ত্বাবধায়ক পদে শুধু হযরত যাকারিয়া আ. ছিলেন না; বরং ঐ পদে আরোও কতিপয় লোক মোতায়েন ছিলেন। হযরত যাকারিয়া আ. ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। হযরত মরিয়ম আ. যখন ভূমিষ্ট হলেন তখন উক্ত মসজিদের প্রাক্তন ইমাম জীবিত ছিলেন না।
সুতরাং জন্মের পরে মরিয়মকে যথা সময়ে তার মাতা হান্নাই নিজের মানত অনুসারে বাইতুল মুকাদ্দাসে নিয়ে গেলেন। মরিয়ম যেহেতু ঐ মসজিদের প্রাক্তন ইমাম ইমরানের কন্যা ছিলেন। তাই তাঁর প্রতি প্রত্যেকের একটি স্বাভাবিক স্নেহবাৎসল্য ছিল এবং তাঁর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রাপ্তির ইচ্ছা প্রবলতর ছিল।
আর প্রত্যেকেই এই ধারণা পোষণ করছিল যে, মরিয়মের তত্ত্বাবধান নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করে সৌভাগ্যবান হবে। প্রত্যেকের মনে এরূপ বাসনা পোষণের ফলে তাঁদের মধ্যে মনোবাদ, বাক-বিতণ্ডা ও কলহের সূচনা ঘটল। হযরত যাকারিয়া আ. তার খালু ছিলেন তাই মরিয়মের প্রতি তার দাবি অধিক বলে তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন।
কিন্তু অন্যান্যরা তা মানতে রাজি হলেন না। অবশেষে হযরত যাকারিয়া আ. একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেন যে, তোমরা যখন মরিয়মকে আমার দায়িত্বে প্রদান করতে সম্মত হচ্ছো না, তখন এস আমরা সকলে অন্য কোন মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা করি।
এই প্রস্তাবে সকলেই রাজি হল। সিদ্ধান্ত গৃহিত হলো তারা তাদের যে লৌহ কলম দ্বারা তৌরাত গ্রন্থ লিখেন, সেই কলম পানির মধ্যে নিক্ষেপ করবেন। তারপর যার কলম পানিতে ভাসতে থাকবে সে ব্যক্তি মরিয়মের তত্ত্বাবধানকারী হবে। অথবা কলমগুলি নিকটস্ত স্রোত বিশিষ্ট জর্দান নদীতে ফেলে দেয়া হবে। অতঃপর যার কলম পানির উপরে এক জায়গায় স্থির থাকবে কিংবা স্রোতের প্রতিকুলে ভেসে যেতে থাকবে, তিনিই মরিয়মের দায়িত্ব, লালন-পালনের ভার গ্রহণ করবেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেকের কলমগুলি পানিতে নিক্ষেপ করা হল। অতঃপর দেখা গেল হযরত যাকারিয়া আ. এর কলম একই স্থানে ভেসে রইল বা স্রোতের বিপরীত দিকে ভেসে যেতে লাগল। তখন সর্বসম্মতিক্রমেই হযরত যাকারিয়া আ. মরিয়ম আ.- এর লালন-পালন ও তত্ত্বাবধান গ্রহণ করলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বয়ং আল্লাহ তা’আলারও এরূপ ইচ্ছা ছিল।
বিবি মরিয়ম নাছেরা নামক একটি শহরের অধিবাসিনী ছিলেন। নাছেরা শহরটি বাইতুল মুকাদ্দাসের অদূরেই অবস্থিত ছিল।
বিবি মরিয়ম পিতা মাতার মানত পূর্ণ করার জন্য বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বাল্যকাল থেকেই অতিশয় সুশীলা এবং ধর্মানুরাগিণী ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ইমরান এবং নবী জাকারিয়া (আ.)-এর শ্যালিকা বিবি হান্না তার জননী ছিলেন।
একদিন বিবি মরিয়ম নামাজ পড়ছিলেন, হঠাৎ ফেরেশতা জিব্রাঈল অবতীর্ণ হলেন। তিনি বললেন, তোমার প্রতি সালাম, তুমি আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তা। আল্লাহ তোমার সাথে রয়েছেন।
বিবি মরিয়ম এই অপ্রত্যাশিতপূর্ব সম্বোধনে ভীতচকিতা হলেন। ভাবতে লাগলেন-কে এলো, কিসের সালাম। হযরত জিব্রাঈল (আ.) বললেন-আমি আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রাঈল। তুমি ভীত হইও না; তুমি পবিত্র সন্তান লাভ করবে, এই সুসংবাদ তোমাকে দিতে এসেছি।
বালিকা ভীত হলেন এবং বললেন-তা কেমন করে হবে? আমি যে কুমারী। আমি স্বামীর সঙ্গ লাভ করিনি। ফেরেশতা বললেন, ‘আল্লাহর কুদরতেই হবে এটি। তাঁর কাছে এটি কঠিন কাজ নয়।’
এই বলে ফেরেশতা অন্তর্হিত হলেন। ছয় মাস পূর্বে হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছেন-এখন আবার কুমারী মরিয়ম আল্লাহর কুদরতে গর্ভবতী হলেন।
বিবি মরিয়ম যদিও আল্লাহর কুদরতে সন্তানসম্ভবা হলেন, কিন্তু দেশের লোকেরা তা মেনে নেবে কেন? কুমারী নারীর এভাবে গর্ভবতী হওয়ার ফলে সবাই তাকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বের করে দিলেন-এমন কি তাকে স্বগ্রামও ছেড়ে যেতে হলো। সঙ্গী সহায়হীন অবস্থায় গর্ভবতী মরিয়ম একটি নির্জন প্রান্তরে সন্তান প্রসব করলেন।
বিপদাপন্ন মরিয়ম কোনো আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে একটি শহরের দ্বারপ্রান্তে আস্তাবলের একটি পতিত প্রাঙ্গণের একটি খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন। হায়-যিনি পৃথিবীর মহা সমমানিত নবী, তিনি সেই নগণ্য স্থানে ভূমিষ্ঠ হলেন। যে মহানবীর ধর্মানুসরণ আজ পৃথিবীময় বিসতৃত, শক্তি এবং সমমানে যারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে রয়েছে; তাদের নবী ভূমিষ্ঠ হলেন একটি আস্তাবলের অব্যবহার্য আঙিনায়। দরিদ্রতম পিতা-মাতার সন্তানও এই সময় একটু শয্যালাভ করে থাকে, একটু শান্তির উপকরণ পায়, কিন্তু মরিয়মের সন্তান শোয়ানোর জন্য আস্তাবলের ঘরটুকু ছাড়া আর কিছুই ভাগ্যে হলো না।
আট দিন বয়সে সন্তানের ত্বক ছেদন করা হলো। তাঁর নামকরণ করা হলো ঈসা। ইনি মছিহ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছেন।
হযরত মুসা (আ.)-এর শরিয়ত অনুসারে বাদশাহ কিংবা পয়গম্বর তাঁর পদে বহাল হওয়ার অনুষ্ঠানে, তেল লেপন করার নিয়ম ছিল। এছাড়া তাওরাত কিতাবে হযরত ঈসা (আ.)-এর নাম মছিহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে একজোড়া ঘুঘু জাতীয় পাখি উৎসর্গ করার নিয়ম হযরত মুসা (আ.)-এর শরিয়তের বিধান ছিল।
মরিয়ম সুচি-স্নাতা হওয়ার পর সন্তান সাথে নিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে পাখির মানত পালন করলেন।
এই সময় একদল অগ্নিপূজক হযরত ঈসা (আ.)-কে খুঁজে ফিরছিল। তারা জ্যোতিষী ছিল। নক্ষত্র দেখে তারা ‘হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম হয়েছে’ এটি জানতে পেরেছিল। হিরুইস বাদশাহ এটি শুনে ভয় পেলেন এবং সেই অনুসন্ধানকারী দলের কাছে গোপনে বললেন যে, তারা যেন সেই বালকের সন্ধান করে কোথায় আছে তা বের করে। অগ্নিপূজকরা খুঁজতে খুঁজতে বিবি মরিয়মের কাছে পৌঁছল ও সেই ক্ষুদ্র শিশুকে সেজদা করল এবং সেখাতে মানত ইত্যাদি সম্পন্ন করল। রাতে তারা স্বপ্নে দেখল, তাদের হিরুইসের কাছে ফিরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা হিরুইস তার জীবনের শত্রু।
মরিয়ম এরূপ স্বপ্ন দেখলেন যে, সম্রাট এই সন্তানের শত্রু, সে তাকে হত্যা করতে চায়। সে যেন শিশুকে নিয়ে মিসরে চলে যায়। জ্যোতিষীরা সম্রাটের কাছে আর ফিরে গেল না। এতে বাদশাহ ভয়ানক রাগ হলো। সে হুকুম করল যে, বাইতুল্লাহর এবং এর আশপাশের সকল বস্তির সন্তানদের যেন হত্যা করে ফেলা হয়।
ইতিপূর্বে মরিয়ম তাঁর সন্তান নিয়ে মিসরে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। হিরুইস যত দিন জীবিত ছিল, তত দিন সন্তান নিয়ে তিনি মিসরেই অবস্থান করলেন। হিরুইসের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর তিনি নিজ দেশ নাছেরায় চলে এলেন।
সন্তান দিন দিন বাড়তে লাগল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঈসার মধ্যে প্রখর জ্ঞান এবং তীক্ষ্ণ মেধাশক্তির পরিচয় ফুটে উঠল। আল্লাহর বিশেষ একটি অনুগ্রহ যে তাঁর ওপর রয়েছে, দিন দিন তা প্রকাশ পেতে শুরু করল। ঈসার মাতা ঈসা (আ.)-সহ প্রতি বছর ঈদের উৎসব ইরুসালেমে যোগদান করতেন। ঈসার ১২ বছর বয়সে ইরুসালেমে বড় বড় জ্ঞানী এবং পণ্ডিতবর্গের সাথে ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর বাকপটুতা এবং তত্ত্বজ্ঞান শুনে পণ্ডিতরা অবাক হয়ে যেতেন। ক্রমান্বয়ে হযরত ঈসা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পূর্ণতা লাভ করতে লাগলেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ‘ওহি’ লাভ করেন এবং নবীরূপে ধর্মপ্রচার করতে শুরু করলেন।
হযরত ইয়াহহিয়া বিবি মরিয়মের খালাতো ভাই হতেন। তিনি ইয়ারদন নদীর তীরে লোকদের ধর্মোপদেশ দান করতেন। হযরত ঈসা (আ.) সেখানে গিয়ে ওয়াজ করতে শুরু করেন।-ওহি আসা শুরু করার পর থেকে ইনজিল কিতাব অবতীর্ণ হতে থাকে। তিনি তাঁর নবুয়তের প্রমাণস্বরূপ বহু অলৌকিক কার্যাবলি দেখাতে শুরু করেন। মাটি দিয়ে পাখি তৈরি করে উড়িয়ে দেয়া, অন্ধকে দৃষ্টিদান, বোবাকে বাকশক্তি দান, কুষ্ঠকে আরোগ্য করা, পানির উপরে হাঁটা ইত্যাদি তার মোজেজা ছিল।
তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বলে বহু রোগী আরোগ্য লাভ করে। বহু লোক ধর্মজ্ঞান লাভ করে। সর্বপ্রথমে যারা হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর ঈমান এনেছিলেন, সাথে থেকে সাহায্য করেছিলেন তাদের ‘হাওয়ারি’ বলা হতো। তাঁরা সর্বদা হযরত ঈসা (আ.)-এর সাথে থাকতেন। হযরত ঈসা (আ.) যখন নবী হন, সেকালে ইয়াহুদি ধর্মগুরুরা অতিশয় শিথিল হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে প্রকৃত ধর্মানুভূতির পরিবর্তে ভণ্ডামি প্রবেশ করেছিল। তাদের মধ্যে কেবল ধর্মের বাহ্যিক আবরণ ছিল। হযরত ঈসা (আ.) এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর ওয়াজ বক্তৃতায় ইয়াহুদি ধর্মগুরুদের কঠোর সমালোচনা করতেন।
এতে সেই সকল বাহ্যাবরণ বিশিষ্ট ইয়াহুদি ধর্মপ্রচারকরা হযরত ঈসা (আ.)-এর ঘোর শত্রুতে পরিণত হন। কিন্তু হযরত ঈসা (আ.)-এর বাণী ছিল আল্লাহর বাণী। তা এমনই হৃদয়গ্রাহী হতো যে, যে শুনত তার হৃদয়ই তাতে আকৃষ্ট হতো। বিদ্বেষপরায়ণ ইয়াহুদি পুরোহিতরা কোনো কথায়ই হযরত ঈসা (আ.) কে ধরতে পারতেন না। তারা হযরত ঈসা (আ.)-কে নানা ছুতানাতায় দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হলেন।
হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর অত্যধিক প্রেমে অভিভূত হয়ে আল্লাহকে পিতা বলেছিলেন। এরূপ আরো দুই-একটি দৃষ্টান্তমূলক বাক্য নিয়ে হিংসাপরায়ণ ইয়াহুদি আলেমগণ নানা কথা সৃষ্টি করলেন। এভাবে তারা হযরত ঈসা (আ.) কে ধর্মদ্রোহী কাফের বলে ফতোয়া দিলেন। তাদের শরিয়তে মৃত্যুই সেই সকল অপরাধের একমাত্র সাজা। দেশে তখন রুমীয়দের রাজত্ব ছিল। তখনকার দিনে রাজা ছাড়া আর কারো মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অধিকার ছিল না। সুতরাং তারা সম্রাটের কানে হযরত ঈসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে শুরু করল।
হযরত ঈসা (আ.) তার বক্তৃতার অধিকাংশ সময় আসমানি বাদশাহের কথা উল্লেখ করতেন। এতে শত্রুদের একটি সুযোগ জুটে গেল। তারা আসমানি বাদশাহীর ব্যাখ্যা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি রাজদ্রোহীর অভিযোগ সৃষ্টি করল। গোপনভাবে তাকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
অদৃষ্টের এমনি বিড়ম্বনা, যে হাওয়ারি দল ঈসা (আ.)-এর সঙ্গী এবং বিশ্বস্ত বন্ধুরূপে বিরাজ করতেন, তারাই এখন গুপ্তচর হলেন। সেই হাওয়ারিদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ইয়াহুদ। শত্রুদের কাছ থেকে তিনি টাকার ঘুষ গ্রহণ করে হযরত ঈসা (আ.)- কে রুমীয় সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
হাওয়ারিদের মধ্যে পিতর ছিল একজন ঘনিষ্ঠ এবং প্রধান সঙ্গী, রাজদ্রোহের অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য তিনিও সম্রাটের দরবারে নিজ পরিচয় গোপন এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই বলে প্রকাশ করলেন। হযরত ঈসা (আ.) ধৃত হলেন এবং রাজবিচারে তিনি মৃত্যুদণ্ড লাভ করলেন। সে সময়ের মৃত্যুদণ্ডে এখনকার মতো গলায় ফাঁসি দেয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ছলিবের সাহায্যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
ছলিবের আকৃতি হলো এই-একটি লম্বা কাঠের উপরের অংশে আর একখানি কাঠ আড়াআড়িভাবে জুড়ে দেয়া হতো। তাতে অপরাধীকে এমনিভাবে ঝুলিয়ে দেয়া হতো যে অপরাধীর পৃষ্ঠদেশ কাষ্ঠদ্বয়ের সংযুক্তি স্থলের ওপর রক্ষিত হতো। আড়া কাঠের উভয় দিকে দুই হাত বিস্তারিত করে দিয়ে তাতে পেরেক মেরে দেয়া হতো। কারো হাঁটুতেও পেরেক ফুঁড়ে কাঠসংলগ্ন করে দেয়া হতো। এই অবস্থায় ঝুলে থেকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও যন্ত্রণায় ছটফট করে মরে যেত।
হযরত ঈসা (আ.) কে ছলিবে বিদ্ধ করে রাখা হলো। পরদিন ইয়াহুদিদের উৎসবের দিনে কোনো অপরাধীর ছলিবে ঝুলন্ত থাকা তাদের ধর্মমতে বিধেয় ছিল না। হযরত ঈসা (আ.) কে দুপুরের দিকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিল। পায়ে কাঁটা বিদ্ধ করা হচ্ছিল না। তবুও তিনি সেই যাতনায়ই