রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بُعِثْتُ مِنْ خَيْرِ قُرُونِ بَنِى آدَمَ قَرْنًا فَقَرْنًا، حَتَّى كُنْتُ مِنَ الْقَرْنِ الَّذِى كُنْتُ فِيهِ ‘আমি যুগ পরম্পরায় বনু আদমের শ্রেষ্ঠ যুগে প্রেরিত হয়েছি। অবশেষে আমি সেই যুগে এসেছি, যে যুগে আমি রয়েছি’ (বুখারী হা/৩৫৫৭)।
(২) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে হোদায়বিয়া সন্ধির পরে তার কুফরী অবস্থায় প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের মধ্যে নবী দাবীকারী ব্যক্তির বংশ কেমন? উত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, هُوَ فِينَا ذُو حَسَبٍ ‘তিনি আমাদের মধ্যে উচ্চ বংশীয়’। হেরাক্লিয়াস বলেছিলেন, كَذَلِكَ الرُّسُلُ تُبْعَثُ فِى أَحْسَابِ قَوْمِهَا ‘এভাবেই নবী-রাসূলগণ তার সম্প্রদায়ের সেরা বংশে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন’।[1]
(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ اصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِبْرَاهِيْمَ إِسْمَاعِيْلَ وَاصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِسْمَاعِيْلَ بَنِي كِنَانَةَ وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي كِنَانَةَ قُرَيْشًا وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ وَاصْطَفَانِى مِنْ بَنِي هَاشِمٍ- ‘আল্লাহ ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাঈলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বনু কেনানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বনু কেনানাহ থেকে কুরায়েশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন।[2] এভাবে আল্লাহর অনুগ্রহে শেষনবী (ছাঃ) বনু আদমের সেরা বংশের সেরা গোত্রে সেরা সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন।
(৪) তিনি বলতেন, أَنَا دَعْوَةُ أَبِي إِبْرَاهِيْمَ، وَبُشْرَى عِيْسَى عَلَيْهِمَا السَّلاَم ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো‘আ ও ঈসার সুসংবাদ’।[3] কেননা ইবরাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় দো‘আ করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়-
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- (بقرة ১২৯)-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি তাদের মধ্য হ’তে একজনকে তাদের প্রতি রাসূল হিসাবে প্রেরণ কর, যিনি তাদের নিকটে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)।
পিতা-পুত্রের এই মিলিত দো‘আ দুই হাযারের অধিক বছর পরে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বংশের উচ্চ মর্যাদা ও পবিত্রতা বর্ণনায় ছহীহ হাদীছসমূহ থাকা সত্ত্বেও অনেক বানোয়াট হাদীছ তৈরী করা হয়েছে। যেমন,
(১) আমি পিতা-মাতার মাধ্যমে দুনিয়াতে এসেছি। আদম থেকে শুরু করে জাহেলী যুগের কোনরূপ ব্যভিচারের মাধ্যমে কখনো দুই পিতা আমাকে স্পর্শ করেনি’ (বায়হাক্বী, দালায়েল ১/১৭৪ পৃঃ)।
(২) ‘যদি আল্লাহ জানতেন যে, আমার বংশের চাইতে উত্তম কোন বংশ আছে, তাহ’লে আমাকে সেখান থেকেই ভূমিষ্ট করাতেন’।
(৩) ‘জিব্রীল আমার উপরে অবতীর্ণ হ’য়ে বললেন, আল্লাহ জাহান্নামকে হারাম করেছেন ঐ ব্যক্তির জন্য, যার ঔরসে আপনাকে পাঠান হয়েছে এবং ঐ গর্ভকে, যা আপনাকে ধারণ করেছে এবং ঐ ক্রোড়কে, যা আপনাকে প্রতিপালন করেছে’ (ইবনুল জাওযী, মাওযূ‘আত ১/২৮১-৮৩)। এগুলি সবই ‘জাল’ এবং অতিশয়োক্তি ছাড়া কিছুই নয়।
[1]. বুখারী হা/৪৫৫৩; মুসলিম হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬১।
[2]. মুসলিম হা/২২৭৬; ওয়াছেলাহ ইবনুল আসক্বা‘ হ’তে; মিশকাত হা/৫৭৪০ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল অধ্যায়।
[3]. আহমাদ, ছহীহ ইবনু হিববান, আবু উমামাহ হ’তে; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫৪৫।
আব্দুল্লাহ্`র মৃত্যুঃ পিতা আব্দুল্লাহ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তদীয় পিতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের হুকুমে ইয়াছরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তিনি নাবেগা জা‘দীর গোত্রে সমাধিস্থ হন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, মদীনার বনু নাজ্জার গোত্রে আব্দুল মুত্ত্বালিবের পিতা হাশেম বিবাহ করেন। ফলে তারা ছিলেন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নানার গোষ্ঠী।
মৃত্যুকালে আব্দুল্লাহ যেসব সহায়-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল যথাক্রমে পাঁচটি উট, এক পাল ছাগল এবং একটি নাবালিকা হাবশী দাসী বারাকাহ ওরফে উম্মে আয়মান। যিনি রাসূল (ছাঃ)-কে শিশুকালে লালন-পালন করেন। ইনি পরে যায়েদ বিন হারেছার সাথে বিবাহিতা হন এবং উসামা বিন যায়েদ তাঁর পুত্র ছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে মৃত্যুবরণ করেন’।[1]
[1]. আর-রাহীক্ব ৫৩ পৃঃ; আল-ইস্তী‘আব; মুসলিম হা/১৭৭১।
হাশেম ও হাশেমী বংশঃ নবী (ছাঃ)-এর বংশ হাশেমী বংশ হিসাবে পরিচিত। যা তাঁর দাদা হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফের দিকে সম্পর্কিত। হাশেম পূর্ব থেকেই ‘সিক্বায়াহ’ ও ‘রিফাদাহ’ অর্থাৎ হাজীদের পানি পান করানো ও মেহমানদারীর দায়িত্বে ছিলেন। হাশেম ছিলেন ধনী ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনিই প্রথম কুরায়েশদের জন্য শীতকালে ইয়ামানে ও গ্রীষ্মকালে শামে দু’টি ব্যবসায়িক সফরের নিয়ম চালু করেন। তিনি এক ব্যবসায়িক সফরে শাম যাওয়ার পথে মদীনায় যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখানে বনু ‘আদী বিন নাজ্জার গোত্রে সালমা বিনতে আমরকে বিবাহ করেন।
অতঃপর সেখানে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে ফিলিস্তীনের গাযায় চলে যান এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে তার স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন ৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে (আর-রাহীক্ব ৪৯ পৃঃ)। সাদা চুল নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার কারণে মা তার নাম রাখেন শায়বাহ (شَيْبَةٌ)। এভাবে তিনি ইয়াছরিবে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন। মক্কায় তার পরিবারের লোকেরা যা জানতে পারেনি। যৌবনে পদার্পণের কাছাকাছি বয়সে উপনীত হ’লে তার জন্মের খবর জানতে পেরে চাচা কুরায়েশ নেতা মুত্ত্বালিব বিন ‘আব্দে মানাফ তাকে মক্কায় নিয়ে আসেন।
লোকেরা তাকে মুত্ত্বালিবের ক্রীতদাস মনে করে তাকে ‘আব্দুল মুত্ত্বালিব’ বলেছিল। সেই থেকে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। যদিও তাঁর আসল নাম ছিল ‘শায়বাহ’ অর্থ ‘সাদা চুল ওয়ালা’ (ইবনু হিশাম ১/১৩৭-৩৮)।