তিন গুটির গল্প

মানুষের জীবনে কত ধরনের লোক বসবাস করে।তারা কত ভাবে গিরগিটির মত রং বদলায়।

এই_গল্পের_নাম_নেই ৩

 

খালুর কথা শুনে আমার বুক থেকে যেন একশো মন ওজনের পাথর নেমে গেলেো। নিজেকে অনেক ফুরফুরে লাগছিলো। আমি চোখ মুখ মুছে আমার কাজে মন দিলাম। কিন্তু ঘরে একটা থমথমে ভাব। এত আলো চারিদিকে তবু যেন ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে। 

 

আজ শুক্রবার। ছুটির দিন, সবাই বাসায়। আমি সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতই রান্না ঘরে ঢুকলাম। শুক্রবার দিনটাই আমি টুকটাক রান্না করি। অনান্য দিন তো কলেজে থাকতে হয় তখন খালা আর বুয়া দুজনেই সামলান। 

 

নানান কথা চিন্তা করতে করতে নাস্তা বানাচ্ছিলাম। এখন সবাই ঘুমে। ছুটির দিনে খালিদ ভাই ১০ টা ১১ টা পর্যন্ত ঘুমায়। সবার খাওয়ার শেষে উনি খায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই এসে যাবে খাবার টেবিলে। খালিদ ভাই এর সাথে খালু এখনো কথা বলেননি। তবে আমি জানি খালুজানের কথা খালিদ ভাই অমান্য করবেন না।

 

নানার ভাবনার মধ্যেই সকালের নাস্তার পর্ব শেষ হলো। একজন এখনো খায়নি। উনি আসতে আসতে ১১ টা বাজবে। আমি খালিদ ভাই এর খাবার টেবিলে রেখে দুপুরের রান্নায় মন দিলাম। 

 

খালিদ ভাই আসলেন। উনি খাচ্ছেন আর পাশে ঝিনি আপা বসে কথা বলছিলেন নিচু স্বরে। মনে হয় খালুর কথা গুলোই বলছিলেন। আমি চুপচাপ রান্না ঘরে কাজ করছি। উনাদের কথা আমার কান পর্যন্ত আসছেনা।

 

হঠাৎ কাচের কিছু ভাঙ্গার শব্দ দৌড়ে গিয়ে রান্না ঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালাম। দেখি খালিদ ভাই উনার চায়ের কাপ আছড়ে ভেঙ্গেছেন। সারা মেঝে ছড়িয়ে গেছে কাঁচে। আমাকে দাড়াতে দেখে হিসহিসিয়ে বললেন, মগের মুল্লুক নাকি??

 

আমি ভয়ে একটু পিছিয়ে গেলাম। কাচ ভাঙ্গার শব্দে খালা খালু দুজনেই ডাইনিং এসে দাড়িয়েছেন।

খালু -- এসব কি খালিদ?? 

খালিদ ভাই কোন উত্তর দিলেন না। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ছিলেন। 

 

খালু-- জানো তো ঝিনির দেবর আশফাকের সাথে তুলির বিয়ের কথা চলছে। আমি চাই এই ব্যাপারটি যেন তারাতাড়ি এগোয়। আর তুমি দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে সমস্ত কাজ করবে। কোথাও যেন কোন ত্রুটি না থাকে। 

খালিদ -- কিন্তু বাবা আমি...

 

খালু -- আমি জানি তুমি কি বলবে। দেখ খালিদ , তুলি দোকানে সাজিয়ে রাখা কোন খেলনা সামগ্রী নয় যে তুমি জেদ করবে আর আমি তোমায় এনে দিবো। তুলি আমার কন্যাসম। ওর সুখে থাকা খুশি থাকা আমার কাছে আগে প্রাধান্য পাবে।

 

খালিদ - আর তোমার ছেলের ভালো থাকা?? 

খালু কিছুক্ষন চুপ করে খালিদ ভাই এর দিকে তাকালেন তারপর ধীরে ধীরে বললেন, একটা কথা কি জানো খালিদ। যে তোমার সাথে ভালো থাকবে না তুমি ও তার সাথে ভালো থাকবে না। তোমার ভালো থাকাও আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমার জন্য এমন জীবনসঙ্গী চাই যে সাবলীলভাবে তোমার সংগে সংসার করবে তোমার ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকবেনা। এ ব্যপারে আর কথা হবেনা। আমি চাই দায়িত্ব নিয়ে তুমি সব কিছু কর। আর মনে রাখবে এটা মগের মুল্লুক না।

 

আমি চকিতে খালিদ ভাই এর দিকে তাকালাম । উনার গালের দিকে লক্ষ্য করতেই বুজলাম উনি দাঁত কিড়মিড় করছেন। কিন্তু খালুর উপরে কথা বলার মত দু:সাহস নেই।

 

খালু উনার কথা বলে বাইরে চলে গেলেন। আমি ঝাড়ু নিয়ে ভাঙ্গা কাচ পরিস্কার করতে লাগলাম। খালিদ ভাই দেয়ালে একটা লাথি মেরে চলে গেলেন। খালা উনার উদ্দেশ্য বললেন, তোর এই বদমেজাজী স্বভাবের জন্য তুলি কেন অন্য কোন মেয়ের সাথেও তোর বিয়ে দিবোনা।

  

খালিদ ভাই পিছন ফিরে বললেন, অন্য কোন মেয়েকে এই খালিদ বিয়ে ও করবেনা। ওর এই তুলিকেই লাগবে।

 

উনার এই কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে ঝাড়ু দেয়া রেখে দাড়িয়ে রইলাম। খালা চেচিয়ে বললেন, বেহায়া, নির্লজ্জ ছেলে কোথাকার 

এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিও এভাবে দাড়িয়ে থেকো না। আসো দুপুরের রান্না একটু হাত লাগিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

 

আমি খালার সাথে রান্না ঘরে । খালা রান্না করছে আমি টুকটাক কাটা বাছা করে দিচ্ছি। খালা রান্না করতে করতে অনেক গল্প করলেন। তার বিয়েরগল্প, খালুর গল্প। খালু কতটা রাগী আর গম্ভীর ছিলেন। সে স্বামী হিসেবে কতটা বন্ধু সুলভ। কত ভালোবাসেন খালাকে।। এইসবই বলছিলেন। আমি বললাম খালা তুমি কি খালুকে ভয় পাওনা

খালা-- ধূর বোকা মেয়ে । বিয়ে দুইটা মানুষকেএক করে দেয়। তাদের সম্পর্ককে মুহূর্তে পরিবর্তন করে ফেলে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন তা বোঝানো যাবে না। বিয়ে অনেক দূরের একটা মানুষ কে অনেক কাছে এনে দেয়। 

এভাবেই কথা বলতে বলতে সময় টা কেটে যায়। দুপুরের খাবার টা সবাই একসাথেই খায়। কিন্তু কাউকে দেখে মনে হয় না সকালে কি ঘটে গেছে । সবই স্বাভাবিক। খালিদ ভাই এর দিকে তাকালে মনেই হয়না উনি এত ঘটনা ঘটিয়েছেন। কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে পারছিনা। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে আবার না জানি কি হয়।

 

দুপুরের খাবারের পর যে যার মত রুমে চলে গেলো। আমিও সব কিছু গোছগাছ শেষ করে আমার জন্য বরাদ্দ করা রুমে আসলাম। এই রুমটা আগে রিনি আপা ছিলো। রুমটাও খুব সুন্দর। এই রুমের সবচেয়ে বেশি সুন্দর রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায়। আমি বারান্দায় টুকটাক কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছি। হাসনাহেনা, বেলী, যখন ফুটে সমস্ত ঘর যেন অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণে ভরে থাকে। আমার বিয়ে পর আমাকে এই ঘর ছেড়ে যেতে হবে। অদ্ভুত ভাবে আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো। ঘরের দেয়ালটার জন্যও মায়া লাগতে শুরু করলো। আমি বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। বুকের ভিতরটা হু হু করছে। মনে হচ্ছে কি যেন নাই কি যেন হারিয়ে ফেলছি।  

 

বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খালিদ ভাই কোথায় যেন যাচ্ছেন। যতক্ষণ উনাকে দেখা যাচ্ছিলো ততক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। উনি চোখের আড়াল হতেই আমার মনে হলো আচ্ছা আমি যদি খালিদ ভাইকে বিয়ে করতে রাজি হই তাহলে এই ঘরটা আমার ই থাকবে। ইস আমার ঘরের কি লোভ। না তারপরেও খালা খালু রিনি আপা ঝিনি আপা সবাই আমার কত আপন। কত ভালো বাসে আমায়। খালা আর খালু দুজনে কি সুন্দর গুটুর গুটুর করে গল্প করে। আচ্ছা আমিও কি এভাবে উনার সাথে কখনো গল্প করতে পারবো। ধুর কি সব ভাবনা আমার।  

 

সেদিই সন্ধ্যায় চা বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো খালিদ ভাই আমার রুম থেকে বের হলেন। আমার রুমে উনার কি কাজ??

 

 


Salma Akter

108 Blog posts

Comments