পাশের বাসার ব্যালকনিতে ঝুলে থাকা মাইশা ভাবির লাল টুকটুকে শাড়িটার দিকে রাহিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি অবাক হলাম। আমি বাসায় থাকলে সাধারণত রাহি আমাকেই বেশি সময় দেয়ার চেষ্টা করে। সময় দেয়া মানে আমার পাশে ঘুরঘুর করে, এটা সেটা বলে আমার মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে। আজ এর ব্যতিক্রম দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না।
তাই চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠে এসে তার ঘাড়ের কাছে ভারি নিশ্বাস ফেলে বললাম,
" কী ব্যাপার! উদাস কেন দৃষ্টি?"
আমার গরম নিশ্বাসেও রাহির কোনো ভাবান্তর হলো না। সে শান্ত দীঘির মতো টলটলে দুচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ,
" না, তেমন কিছু না, শাড়িটা দেখছি।"
" দারুণ তো শাড়িটা! লাল রঙের। "
রাহি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল,
" লাল না, মেরুন। তুমি কালার ব্লাইন্ড। আজ পর্যন্ত কোনো কিছুর সঠিক রংটা বলতে পারলে না।"
রাহির কথা শুনে মনে হলো তাইতো! কোনটা কালো, কোনটা শ্যামলা আর কোনটা ফর্সা সেটা যেমন চিনতে পারিনি। কোনটা পর্দা, কোনটা প্রতারণা সেটাও তো বুঝতে পারিনি।
" যাই হোক তোমাকে ভীষণ মানাবে, নিবে না-কি একটা?'
" কে কিনে দেবে?"
রাহির কথায় গভীর আক্ষেপ লুকিয়ে আছে। "কে কিনে দিবে?"
তাই তো! রাহিকে তো আমি কোনোদিন নিজ পছন্দে কিছু কিনে দেইনি। বিয়ের পর একটা মেয়ের স্বামী ছাড়া আর আপন কে থাকে? রাহিরও সে হিসাবে আর কেউ নেই।
আমাদের বিবাহিত জীবনের ছয়মাসে আমি রাহিকে একটা শাড়ি থাক দূরের কথা, একটা চুলের ব্যান্ডও কিনে দেইনি। ভেবেছি দেবও না। নিজের পছন্দেই রাহি সব কেনাকাটা করে। টাকা অবশ্য আমার।
রাহিকে বিয়ে করে আমি প্রতারিত হয়েছি। প্রতারনার শাস্তি হিসাবে আমার এই নিরব পদক্ষেপ। আমার নিকট আত্মীয় কেউ না থাকায়, নিজের বিয়ের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছি।
এক জীবনে প্রেম করিনি। মেয়েদের সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারনাও নেই। এক বন্ধুকে দায়িত্ব দিয়েছি একটা পাত্রী খুঁজে দিতে। আমাদের বিয়েটা সেই বন্ধুর মাধ্যমেই হয়েছে। সে সম্পর্কে রাহীর আত্মীয়। বিয়ের কনে হিসাবে একটা সুশ্রী, সুন্দরী মেয়েই আমার প্রথম প্রায়োরিটি ছিল।
বন্ধুকে বলেছিও সেটা খুলে। মেয়ের শিক্ষা, অর্থ, সামাজিক মর্যাদা সব শিথিল হলেও সৌন্দর্যে কোনো ঘাটতি থাকতে পারবে না। বন্ধু নিশ্চয়তা দিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এক সুন্দরী নারীর ফেসবুক আইডির সাথে। ফেসবুকে হিজাব পরা, শাড়ি পরা, কামিজ পরা রাহিকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে তার পরিবারে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই।
আমাদের বিয়েটাও একসপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। বিয়ের আগের দিন আমি রাহিকে সরাসরি দেখতে চাই। রাহি হাত মোজা, পা মোজা বোরকা পরে শুধু মুখ খুলে আমার সাথে দেখা করতে আসে।
ধবধবে ফর্সা, টিকালে নাক আর সুন্দর মুখশ্রীর রাহিকে প্রথম দেখে আমি প্রেমে পড়ে যাই। পূর্বের সিদ্ধান্ত মতো আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের দিন সকালেই আমার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। শাওয়ার শেষে গতকাল পার্লার থেকে সেজে আসা সব প্রসাধনী ধুয়ে মুছে একেবারে পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে আসা ভেজা চুলের মেয়েটাকে দেখে আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম।
ও রাহি! আমার বিবাহিত স্ত্রী, যার সাথে পুরোটা রাত আদরে, সোহাগে, মিলনে কাটিয়ে দিয়েছি। আমার বিশ্বাস করতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল।
হুট করে এক সপ্তাহের পরিচয়ে বিয়ে করলাম। ভালো করি দেখিনি। যাচাই-বাচাই করিনি। বন্ধুর কথায় আর ফেসবুকে দেয়া ছবির উপর বিশ্বাস করে বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ জীবন ঘনিষ্ঠ কাজ করে ফেলেছি।
আমি বাম হাতের পিঠ দিয়ে ভালো করে চোখ রগড়িয়ে নিশ্চিত হতে চাইলাম আমি ভুল দেখছি না তো!
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় কৃষ্ণবর্ণের, ফিনফিনে পাতলা চুলের মেয়েটার সাথে আমি কোনোভাবেই ফেসবুকে দেখা, রেস্টুরেন্টে দেখা মেয়েটার শারিরীক গড়ন ছাড়া আর কোনোকিছুর চল্লিশ শতাংশও মিল করতে পারিনি।
সেই দিন ভীষণ রকমের ধাক্কা খেলাম আমি। বিশ্বাস উঠে গেছে আমার। না, না রাহির উপর না, আমার নিজের উপর, নিজের চোখের উপর।
আমি কি ভুল দেখেছি! অতি দ্রুত মোবাইল হাতে নিয়ে রাহির আইডিতে ঢুকে তার প্রোফাইল পিকচার, কাভার ফটো আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাহির মধ্যে মিল করতে বসে পড়লাম। আশ্চর্য আলাদাভাবে দেখলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না, এরা দুজন একই ব্যক্তি।
রাহি অসুন্দর আমি বলছি না। রাহি যথেষ্ট সুন্দরী। তবে তার গায়ের রঙ কৃষ্ণবর্ণের। গৌরবর্ণ পছন্দ করা আমি কৃষ্ণবর্ণের অপরাধে রাহিকে অভিযুক্ত করতে পারিনি। শুধু গায়ের রঙ নয় আমি চেহারায়ও বিশেষ কোনো মিল খুঁজে পাইনি শুধু চোখ দুটো ছাড়া।
আমার মনে হয়েছিল এটা একটা ঘোরতর প্রতারণা। নিরবে আমি প্রতারিত হওয়ার সবটুকু কষ্ট একা হজম করেছি। রাহিকেও বুঝতে দেইনি। যার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে, তাকে এসব বলে অপ্রস্তুত করে আর কি হবে?
আমি কিছু না বললেও ঐ মুহূর্ত থেকে কিভাবে যেন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল আমার আর রাহির সাথে আমি নিজেও জানি না। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই। আমাদের সংসারে আমি আর রাহি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই।
অফিস শেষে আমি ঠিক সময় মতো বাসায় ফিরে আসি। আমরা রোজ একসাথে নাস্তা করি, এক সাথে রাতের খাবার খাই। এক বিছানায় ঘুমাই। শরীরের প্রয়োজনে রোজ মিলিত হই। আমাদের মাঝে দূরত্ব বাড়ানোর কেউ নেই,তারপরও আমরা যোজন যোজন দূরত্বে থাকি।
কতদিন রাহির চোখের দিকে আমি অপ্রয়োজনে তাকাইনি। প্রয়োজনেও তাকাতে চাই না। আমি ছয়মাসেও জানতে চাইনি, রাহি তো বোরকা ছাড়াই বাহিরে যায়, আমার সাথে সেদিন কেন বোরকা পড়ে দেখা করেছিল। আমি আজও জানতে চাইনি কোন অ্যাপস ব্যাবহার করে একজন মানুষের গায়ের রঙ, চেহারার গড়ন পরিবর্তন করে ফেলা যায়। বরং নিজের অজ্ঞানতার জন্য নিজেকে তিরষ্কার করেছি বারবার।
ইদানিং অবশ্য একসাথে চলতে চলতে রাহির প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। মাঝেমধ্যে মন কেমনও করে তার জন্য। নতুন বিয়ে করা নবদম্পতি হওয়ার পরও আমাদের একটা কাপল ছবি নেই। ইচ্ছে করেই তুলিনি। রাহিও কোনোদিন আবদার করেনি।
রাহির চোখে মেরুন আর আমার চোখে লাল শাড়িটা বন্ধু বকুলের অনলাইন পেইজ "শাড়িতে নারী" তে অর্ডার করে দিলাম। রাহিকে এ ব্যাপারে আগ থেকে কিছুই জানাইনি। আসলে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছি।
যথাসময়ে শাড়ি এসে পৌঁছৈ গেছে আমার অফিসের ঠিকানায়। রাহিকে আজ এই শাড়ি পরিয়ে বিকেলে একসাথে রিকশায় ঘুরব সেই আশায় সময়ের একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। স্ত্রীর সাথে একান্তে সময় কাটাতে আমারও ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন জানি একটু গভীর বেদনাবোধের কারণে সেটা হয়ে উঠেনি।
আমি চারটার কিছু আগে এসে বাসায় পৌঁছে গেলাম। কলিংবেলের শব্দে ছুটে এসে রাহি দরজা খুলে দিল। আমার ডান হাতে অফিসের ব্যাগ ছাড়াও অন্য একটা ব্যাগ দেখতে পেয়ে রাহি প্রশ্ন করল,
" এখানে কী?"
" খুলে দেখো না!"
" মনে হচ্ছে শাড়ি।"
" হবে হয়তো।"
রাহি আমার সামনে বসে ব্যাগটা কাচি দিয়ে কেটে শাড়িটা বের করে আনল।
আমি সামনে থাকলেও আমার মনোযোগ ও দৃষ্টি ছিল অন্য দিকে। তাই ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পরা শাড়ির রঙের দিকে তাকাইনি।
" কী পছন্দ হয়েছে তোমার মেরুন কালারের শাড়ি?"
আমার কথা শেষ না হতেই রাহি চিৎকার দিয়ে উঠল,
" কী! এটা মেরুন কালার?"
রাহির চিৎকারে আমিও শাড়িটার দিকে তাকালাম। সত্যি কথা বলতে শাড়িটা পেইজ খুঁজে, খুঁজে আমিই অর্ডার করেছি। ওর পেইজে থাকা শাড়ির ছবি, মডেলের পরনে থাকা ছবির সাথে রাহির হাতে থাকা শাড়িটার বিশেষ একটা মিল খুঁজে পাইনি। শাড়ির রঙটা লালও নয়, খয়েরিও নয়, গোলাপিও নয়। এক ধরনের ফ্যাকাশে রঙের।
আমি ভীষণ আশাহত হলাম। সবাই যেভাবে অনলাইনে কেনাকাটা করছে। এটা কি সেই কেনাকাটার নমুনা!
বন্ধুর পেইজ, নিজে পছন্দ করে অর্ডার করলাম, তারপরও কেনোকিছুই মন মতো হয়নি।
শাড়ির রংটা যেমন আলাদা, কাপড়টাও কেমন যেন। ডিজাইনও ঠিক নেই। মনে হচ্ছে এটা আলাদা শাড়ি, আমার অর্ডার করা সেটা নয়।
তারপরও আমি রাহিকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম,
" দেখ তো পছন্দ হচ্ছে কি-না! ঠিক মাইশা ভাবির শাড়িটার মতো। কী বলো!"
আমার কথা শুনে রাহি রেগে গেলো,
" কী বলছ বোকার মতো! এটা মাইশা ভাবির শাড়িটার মতো হতে যাবে কেন?" রং, ডিজাইন, কাপড় কোনোটারই মিল নেই। "
" কী হবে থাক, পরলে তোমাকে মানাবে।"
" কিছু হবে না। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে কার পেইজ থেকে নিয়েছ, রিটার্নের অপশন থাকলে রিটার্ন কর। এটা তো এক ধরনের প্রতারনা। শাড়ি দেখাবে একটা, কাস্টমারকে দেবে আরেকটা।"
রাহির অগ্নিমূর্তি দেখে আমি মোবাইলের গ্যালারি থেকে রাহিকে শাড়িটা দেখিয়ে বললাম,
" একই তো মনে হচ্ছে,দেখ তো!"
রাহি আমার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেখে বলল,
" এটা একই শাড়ি! তোমার আসলে চোখটাই নষ্ট। কীভাবে দুটোকে তোমার একই শাড়ি মনে হচ্ছে? কার পেইজ থেকে নিয়েছ?"
" বন্ধু ইকবালের পেইজ"।
" তাহলে তো সমস্যা নেই। এটা রিটার্ন করে আরেকটা নাও।"
রাহি শাড়ির ব্যাপারে কথা বলার জন্য ইকবালকে ফোন দিতে প্রস্তুতি নিলো। আমি শান্ত ভঙ্গিতে রাহির হাত থেকে ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে বললাম,
" রাহি, সব কিছুর রিটার্ন অপশন থাকে না। আমরা চাইলেও সব কিছু রিটার্ন দিতে পারি না। অনেকসময় বিবেক নামক বিষয়টা সমনে এসে যায়। ইকবালের নতুন ব্যাবসা। এখন খারাপ রিভিউ পেয়ে শাড়ি রিটার্ন গেলে বেচারা কষ্ট পাবে। এটা তো একটা সামান্য শাড়ি। হয়তো একবার পরবে, নয়তো দুইবার। এমন কিছু জিনিস আজন্ম জীবনের সাথে মিশে জীবনের অংশ হয়ে যায় সেটাও পছন্দ অনুযায়ী না হলে আমরা ফেরৎ দিতে পারি না। মানিয়ে নেই।"
" রাহি কেমন যেন অপরাধীর মতো দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।"
আমি দ্রুত চোখ নামিয়ে বললাম,
" শাড়ি টা পরো তুমি। দেখবে ভালো লাগবে, আজ না লাগলে কাল লাগবে, না হয় তিনমাস পর লাগবে।