আমার ৫৩ বছর বয়সী স্ত্রী যখন আমার কাছে ডির্ভোস চাইলো অবাক হলাম না। কৌতুক করে বললাম, ‘প্রেমে পড়েছ নাকি?’
হাতের কাছে টিভির রিমোট ছিলো তাই ছুঁড়ে মেরে বললো,
- 'ইর্য়াকি মারার জায়গা পাও না? তুমি আর তোমার ছেলে কোনো ব্যাপারে সিরিয়াস হও না।'
বাংলাভিশনে নিউজ চলছিল। প্রত্যুত্তর না করে টিভির দিকে মনোযোগী হলাম। ‘একজন পুরুষের জন্যে চোখ-কান খোলা রেখে জিহ্বাতে যথাসম্ভব নাগাল টেনে স্ত্রীর চাওয়া-পাওয়া বুঝেও না বোঝার ভান করার নাম হচ্ছে সংসার।’
আমার স্ত্রী অর্থাৎ সুজাতা কিছুদিন ধরে তার ছেলের জন্যে পাত্রী দেখছে। স্ত্রীর প্ররোচনায় আমিও কয়েকদিন সঙ্গে গিয়েছিলাম। আজকালকার মেয়েরা চমৎকার। একমাথা ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকার পাত্রী নয়। সব প্রশ্নের উত্তর সাবলীল ভঙ্গীতে দেয়। ভদ্রঘরের শিক্ষিতা কোনো মেয়েই দেখতে অসুন্দর নয়। তাদের কথাবার্তা, চোখের চাহনিতে যে ব্যক্তিত্বের আভা ফুটে উঠে এরচেয়ে মোহনীয় রুপ থাকার প্রয়োজন নেই।
সুজাতা এসবের ধার ধারে না।
- 'কলাবাগানের মেয়েটা দেখতে খারাপ না তবে গলার স্বর ফ্যাকাশে। হাঁসের মত প্যাকপ্যাক করে।'
- 'কণ্ঠস্বরের আল্লাহ পাকের দান। ওর কি দোষ!'
- 'মামী যে মেয়েটার সন্ধান দিয়েছিল, দেখতে গিয়েছিলাম।'
- 'তারপর?'
- 'চাড়ালের গোষ্ঠী। জিজ্ঞেস করে আপনার ছেলে স্যালারি পায় কত? আসলাম সাহেবের মেয়েটাকে পছন্দ হইছিল কিন্তু হাইট কম। ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি।'
- 'আমার কাছে তো লম্বাই লাগলো।'
- 'তুমি বুঝো কি! হিল পড়ে দেখাইছিল। ভাবছিল আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে।'
সুজাতা বিগলিত ভঙ্গীতে হাসে।
সারাদিনের আমাদের এমন কথপোকথন চলতেই থাকে। শুরুটা সে করে, শেষটাও সে। আমার কাজ হচ্ছে তার কথামত হ্যা বা না করা। এ কাহিনী কত মাস বা কত বছর চলত তা স্বয়ং বিধাতাই জানেন। কিন্তু আমার ছেলে শুক্রবারে নাস্তার টেবিলে ঘোষনা দিলো, ‘তার পছন্দের একটা মেয়ে আছে।’
সুজাতা পরোটা ভাজা রেখে দৌঁড়ে এলেন।
- 'কি বলছিস! মেয়ের নাম কি? কি করে?'
- 'তিসা আমার ব্যাচমেট ছিল। গার্লসে পড়তো। একসাথে কোচিং করতাম। এস.এস.সির পর কন্ট্রাক্ট ছিল না। ইদানীং স্যেশাল মিডিয়ায় আবার পরিচয় হয়। কথাবার্তা বলার পর শুনি ও ঢাকাতেই আছে। একটা হাইস্কুলে পড়ায়। এই তো।'
- 'মেয়ের তোর সাথে পড়তো মানে কি? এখনও বিয়ে হয় নি?' সুজাতার চোখ কপালে উঠল।
আতিফ না শোনার ভান করে বললো,
- 'মা, আরেকটা পরোটা ভেজে দাও। তেল কম দিবা প্লিজ।'
শুরু হল সুজাতার কান্নাকাটি। কথা শোনানোে জন্যে ছেলেকে পায় না। পেনশন নেবার পর সকাল-বিকাল দুইঘণ্টার হাঁটার বাইরে আমার আর কোনো কাজ নাই।
অতএব ছেলের উপর যত ক্ষোভ আমার উপর পড়ে। ছেলের বয়স ২৮। সে হিসেবে মেয়ের বয়সও ২৭-২৮ হবার কথা। ছেলে একটা বুড়িকে পছন্দ করে এসেছে।
সেদিন আর সহ্য না করতে পেরে বললাম,
- 'কাউকে না দেখে এভাবে মন্তব্য করা ঠিক নয়।'
- 'আর্শ্চয। আমার বিয়ের সময় বয়স ছিল ২২। এনিয়ে তোমার আত্মীয়াদের কাছে কম শুনতে হয় নি। সবাই বলেছে আইবুড়ো মেয়ে ঘরে এনেছে। আর এমেয়ের বয়স ২৮। তুমি ভাবতে পারো?'
- 'অবশ্যই পারি। তোমার ছেলের পড়াশোনা শেষ করে জব নিয়ে সেটল হতে যদি ২৮ বছর লাগে মেয়েটারও তাই লাগার কথা। এতে অবাক হবার কিছু নাই।'
- 'বুড়ি মহিলা। এখন বাপ-মা আমার ছেলের ঘাড়ে পার করে দিতে চায়।'
- 'বাজে কথা বলো না। তুমি আমি ঠিক যতটা কষ্ট করে আতিফকে মানুষ করেছি, মেয়েটির বাবামারও ঠিক একই কষ্ট হয়েছে। কষ্ট বরং আরো বেশি হয়েছে। বার বার বিয়ের ঘর এসেছে। তোমার মত কিছু লোক্লাস আত্মীয়স্বজন মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে বলে চেঁচিয়েছে তারপরও মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড়া করাতে পিছপা হয় নি। হেটস অফ।'
- 'কি বললা? আমি লোক্লাস মহিলা?'
- 'না মানে সেটা বলতে চাই নি। জাস্ট উদাহরণ দিলাম আর কি!'
তার ঠিক পর থেকে সুজাতা ডির্ভোস চাইছে। এরমাঝে ভায়ের বৌ, বড় খালা আরো কয়েকজনকে ফোন করা হয়ে গিয়েছে। ডির্ভোস কিভাবে নেয়, ডির্ভোস কত প্রকার সব জানা হয়ে গেছে। স্বামীর কাছে মূল্য নাই, ছেলে কথা শোনে না, এ সংসার সে করবে না।
.
সুজাতা শুনলে রাগ করবে। তারপরও ছেলের সাথে তিসাকে দেখতে গেলাম। চমৎকার মেয়ে। দেখলেই বোঝা যায় পরিচ্ছন্ন পরিবার থেকে বড় হয়েছে। মেয়ে বাবাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল। ভদ্রলোক আমাদের পরিবার সম্বন্ধে ততটুকুই কৌতুহল দেখাল যতটুকু না দেখালেই নয়। আমি মোটামুটি পাকা কথা সেরে এলাম।
সুজাতার রিএক্ট ছিল দেখার মত। সব কথা শুনে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠল। সকাল বিকাল ফোন করে হুমকি দেয়, ‘আমার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের কেইস করবে’ এইসব আর কি।
মেয়েপক্ষ বাড়িতে আসার আগের দিন কল করলাম,
- 'শুনছ, কালাভুনা কিভাবে রাঁধে বলতে পারো?'
- 'মানে?'
- 'তিসার বাড়ি থেকে লোকজন আসবে কাল।'
- 'মেন্যু কি?'
- 'বিফ, ডিমভুনা,ভাত আর ডাল। এরচেয়ে বেশি কিছু রাঁধতে পারি না তুমিই জানো।'
ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল।
গিন্নি বিকেলে এসে হাজির। ঘরদোর গুছাতে গুছাতে গজগজ করতে লাগলো, বাপছেলে বাড়িঘরের যে অবস্থা করে রেখেছি মেয়েপক্ষ বস্তি মনে করে পালিয়ে যেত। নেহাত বাড়ির মানসম্মানেরর প্রশ্ন নয়ত সে কখনই ফিরতো না।
.
বিয়ে হলো, বউবরণ হল না। সুজাতা দরজায় খিল দিয়ে চোখের জলে বালিশ ভিজাচ্ছে। এমনভাবে কাঁদছে যেন বাড়িতে বউ নয় আজরাইল এসেছে। কাছে গিয়ে বসতে ককিয়ে উঠলো,
- 'এত কষ্ট করে ছেলে বড় করলাম। তার এই প্রতিদান।'
বলতে ইচ্ছা হলো, ‘ছেলে পেটে ধরেছ মানুষ করেছ তার বদলে তুমি মাতৃত্বের সুখ পেয়েছ, এরচেয়ে বেশি আশা করাটা অন্যায়। একটা বয়সের পর ছেলে হোক মেয়ে হোক প্রত্যেকের নিজেদের একটা করে জগৎ সৃষ্টি হয়। সেই জগৎ দূর থেকে বাবা-মা অনুভব করতে পারে কিন্তু প্রবেশ দৃষ্টিকটু।’
বলতে চাইলেও বলতে পারলাম না। মায়েদের আবেগ হয় বাঁধনহারা। সন্তানের শত ভালোর মাঝেও সূক্ষ্ম ত্রুটি চোখে পড়ে। সন্তান সুখে থাকলেও সে যেন আরো সুখ পায় এবোধের নাম মাতৃত্ব।