রেনু আর তার স্বামীর মনে হচ্ছে, এই মেয়েগুলো এত বড় হয়ে গেল কি করে? এরা কি কি সব বলছে? ছোট খালু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
___ " মেয়েগুলো এসব কি বলতেছে রেনু? এসব কথা মেঝো আপাকে জানানো উচিত!"
___ " এরা নিজেরা তো কখনোই এত ঝগড়া করে না, আজকে কি হইছে এদের? আর নুপুর আর রাসেলকে নিয়ে কি হইছে এদের মাঝে? "
রেনুও এক রাশ প্রশ্ন দিয়ে উত্তর শেষ করলো। পরী রুম থেকে বের হতেই দেখলো, সামনে তার ছোট খালা শাশুড়ী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে খালু শশুরও আছেন, আর সামনের রুম থেকে বেশ জোরে কথার শব্দ আসছে। ও কিছু না বলেই ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। সামনে আসতে আসতে মনে হলো , এরা বেশ মনোযোগ দিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। কিন্তু কি শুনতে এরা এত মনোযোগ দিয়ে?
___" নুপুরের বিয়ের মত না থাকলে, ও আমাকে বলবে। সেখানে এটা আপনি বলছেন, ব্যাপারটা একটু অন্যরকম না?"
কবির এবার একটু খাপছাড়া ভাবেই প্রশ্নটা করলো। কবিরের প্রশ্ন শুনে রাসেল কিছু বলতে চেয়েও, চুপ করে রইলো। তারপর আস্তে করে বললো,
___ " আমি বলার কে সেটা কিন্তু ফ্যাক্ট না, ফ্যাক্ট হলো আপনি নুপুরকে সরাসরি প্রশ্ন করেন। "
কবির কিছু না বলেই সোজা চলল বাসার দিকে। ওর মনে এখন উথাল পাথাল করে যাচ্ছে কিছু প্রশ্ন! বাইরের কোন লোকের কাছ থেকে নুপুর রাজি কি না, সেটা ওর শুনতে হবে। এটাই কেন জানি না মেনে নিতে পারছে না। কবির যত বারই নুপুরের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছে, সেটা নুপুর সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। ওর সব সময় মনে হয়েছে, প্রথম প্রথম তাই হয়তো নুপুর লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু এখন কবিরের মনে হচ্ছে, না এবার নুপুরকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে। ও এই বিয়ে নিয়ে কি ভাবছে!
___" খালা মনি খালু আপনারা এখানে? কখন আসলেন? "
পরীর কথায় রেনু আর ছোট খালু চমকে ঘুরে তাকালে। তাদের চোখ মুখ দেখেই পরীর মনে হলো নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। রেনু আস্তে করে বলল,
___ " এই তো মাত্রই আসলাম, মেয়েগুলো কি করছে সেটা দেখতে যাচ্ছিলাম।"
পরীর কেন জানি না মনে হলো, রেনু দায়সারা গোছের জবাব দিয়ে এড়িয়ে গেলো। পরী আর রেনু যখন বাইরে কথা বলছিলো, তখনই ভেতরের সবাই চুপ হয়ে গেলো। নুমা দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
___ " এবার হবে খেলা, তোরা সবাই ভার্সেস আমি। রেডি থাকিস।"
এটুকু বলেই ও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রেনু, পরী, ছোট খালু সবার সামনে দিয়ে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে আসলো।
কবির বাসায় ঢুকেই নুপুরের খোঁজ করলো। ওর বারবার মনে হচ্ছে নুপুরের সাথে কথা বলাটা খুব জরুরি। অসহ্য মাথা ব্যাথায় মাথাটা প্রায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ওর। রাসেলের কথাগুলো নিতেই পারছে না। নিজের হবু বউয়ের মতামত আছে কি না, সেটা অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হবে এটাই মানতে পারছে না। সামনেই মিলিকে দেখে কবির বলল,
___ " মিলি নুপুর কই? ওকে একটু আমার রুমে আসতে বলবে কথা ছিলো? "
___ " কি কথা??? আমাকে বলেন, আমি আপুকে বলে দেবো! "
মিলি বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল। কবিরের এবার আরও রাগ হতে লাগলো,
___ " তোমার সাথে তো বিয়ে করছি না আমি, যদি তেমন হতো তাহলে তো তোমাকেই কোলে বসিয়ে আলাপ করতাম।"
___ " আমাকে বিয়ে করার যোগ্যতা আপনার আছে নি? সবাইরে কি নুপুর পাইছেন নাকি! "
মিলি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল। কবির ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি টেনে বলল,
___ " না নুপুরের মতন কাউকে পাই নি দেখেই তো, শুধুই ওরে বিয়ে করতেছি৷ তোমার মতন মেয়েরা খুব বেশিই এভেইলেবল, তাই এসব মেয়েদের প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। এবার খুশি.... যাও যেয়ে নুপুরকে ডেকে নিয়ে আসো।"
কবিরের কথা শুনে মিলির কেন জানি না হাড় সহ জ্বলে উঠলো। হঠাৎই পেছন থেকে হাসির শব্দে ঘাড় ঘুরিয়েই দেখলো, জিমি ডাইনিং রুমের কোনায় দাঁড়িয়ে হেসেই যাচ্ছে। বোঝা গেলো, ওর আর কবিরের সব কথা জিমি শুনেছে। কি যে এক অপমান কবির ওকে করেছে, তারপর আবার জিমির হাসি। সব মিলিয়ে ও ছুটলো জিমির দিকে। আগ থেকে আঁচ পেয়ে জিমিও দিলো ভোঁ দৌড়। জয় হঠাৎ টের পেলো, সে দাঁড়ানো থেকে কিছুর সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। শুধু তাই না বিশাল কিছু একটা তার শরীরের উপরে পড়ে আছে। মাথার পেছনে তো ব্যাথা পেয়েছেই, পরে আবার ভারি কিছু পেটের উপরে পড়ার কারণে, হুক করে মুখ দিয়ে সব বাতাস বেরিয়ে গেলো। জয় কোন রকমে তাকিয়ে দেখলো, জিমি মুচড়ে মুচড়ে ওঠার ট্রাই করছে।
___ " কি রে আজকে কি প্লান করেছিস, আমার চল্লিশার দাওয়াত কনফার্ম করে, তারপর দম নিবি।"
কোনমতে জিমিরে ঠেলে নামিয়ে উঠে বসতে বসতে বলল জয়৷ জিমিও এবার খেঁকিয়ে উঠে বলল,
___ " তুমি কি কানা ভাইয়া, দেখো নাই যে আমি দৌড়ে আসতেছি। "
___ " এটা তো বাসা, রাজপথ তো না। এমন ভাবে আসলি, মনে হচ্ছে রাজপথে আন্দোলন করতেছিস। আর ছাত্রলীগের পোলাপান তোরে ধাওয়া দিছে। "
জয়ের কথা শুনতে শুনতে জিমি চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো মিলি কোথাও নেই। " বজ্জাতের কাঁদিটা নির্ঘাত ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খাওয়ার পরেই ভেগেছে " জিমি ফোঁস করে নি:শ্বাস ছাড়লো।
___ " জিমি তুই ঠিক আছিস তো, আমি তোর ভাইয়া চিনতে পারতেছিস? ইয়া আল্লাহ ধাক্কা খেয়ে কি তোর স্মৃতি চলে গেলো নাকি? "
জয়ের কথায় কেন জানি না জিমির আরো রাগ হতে লাগলো। বেশ রাগি স্বরেই বলল,
___ " ভাইয়া তুমি কি নিজেরে মান্দার গাছ মনে করো? যাতে ধাক্কা খেয়ে আমি পিছনের সব কথা ভুলে যাবো। স্মৃতি ভুলে যাওয়া তো দূরের কথা, উলটো নুমা আপু আরো ভয়াবহ ভাবে সব মনে রেখেছে৷ নুপাপুকে চড় মেরেছে আজকে। "
জয় এবার চুপ হয়ে গেলো। এই নুমাকে ছোট বেলা থেকে ও কোলে কপিঠে করে মানুষ করেছে। সেই নুমার সাথে এই নুমার যেন কোন মিলই নেই। এযেন প্রতিহিংসার চাদরে ঘিরে থাকা এক নারী। যার কাছে ভালোবাসা, মায়া, মমতার কোন লেশই নেই। এই নুমাকে তো জয় চেনে না। শুধু জয়ই না, তার অন্যকোন বোনেরাই নুমাকে চিনতে পারছে না।
নুপুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। মানহা বারবার স্বান্তনা দিচ্ছে, কিন্তু কেন জানি না ওর কষ্টটা কিছুতেই কমছে না৷ গালের বাঁ পাশে লাল হয়ে আছে চড় খেয়ে। কিন্তু এই ব্যাথা ওকে ছুঁতেই পারছে না। আসলে কষ্টটা পেয়েছে নুপুর মনে, শরীরে ব্যাথা ওকে যেন ছুঁতেই পারছে না। ফোনের শব্দে নুপুরের ঘোর ভাঙ্গে, হাতে নিয়ে দেখে রাসেল কল করেছে। এই মানুষটা ওকে পাবার জন্য, পাগলের মতন যা পারছে করে যাচ্ছে। আর ও কি করছে?
___ " নুপুর কলটা ধর, কেটে যাবে! "
মানহার কথায় ও আবারও বাস্তবে ফিরে আসে। ফোন রিসিভ করে কানে রাখতেই ও পাশ থেকে রাসেল বলল,
___ " তুই ঠিক আছিস তো! "
রাসেলের কেন জানি না মনে হচ্ছিলো, ও যা বলেছে কবিরকে সেটার একটা চাপ পড়বে ওর উপরে।
___" হু!"
নুপুরের উত্তর শুনে রাসেলের মনে হলো, নুপুর কাঁদছে,
___ " তুই কাঁদছিস??? কিছু হয়েছে?
রাসেলের গলার নরম স্বর শুনে এবার নুপুরের চোখের পানি যেন বাঁধ ভাঙ্গলো। ধরা গলায় বললো,
___ " জানেন, না পেরেছে ভালো বোন হতে, না পেরেছি ভালো প্রেমিকা হতে। আস্ত একটা লুজার আমি। "
এই বলেই চুপ হয়ে গেলো নুপুর।
___ " তুই কেমন বোন সেটার সার্টিফিকেট না হয় তোর বোনদের থেকে নিস। কিন্তু প্রেমিকার সার্টিফিকেট তোরে আমি দেবো। আর যদি লেটার মার্ক সহ পাশ না করতিস, তাহলে এই রাসেল অন্তত তোর জন্য পাগল হতো না। আচ্ছা বাদ দে এসব ফাও আলাপ। তুই পারলে ছাদে আয়, তোর সাথে জরুরি কথা আছে।"
___ " বাসার পরিস্থিতি খুব খারাপ, নুমা আপু আমাকে বের হতে দেবে না হয়তো। "
___ " আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না, আমি দেখতেছি তোরে কি করে বাসা থেকে বের করা যায়। আর হ্যাঁ যা হয় হোক, তুই শুধুই আমার এটা মাথায় রাখবি।
হাওয়া বেগমের মুখে কেন জানি না মাছি আসছে আর যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, সে যা শুনেছে সেটা সত্যি না ভুল। রেনু আর ছোট খালু চুপ করে তাকিয়ে আছে হাওয়া বেগমের মুখের দিকে। অল্প পানিতে যেমন রুই মাছ খাবি খায়, ঠিক তেমন করে খাবি খাচ্ছেন হাওয়া বেগম।
___ " রেনু তুই যা বলছিস বুঝে বলছিস? "
হাওয়া বেগমের প্রশ্নে রেনু এবার বেশ বিরক্ত হলো। বিগত দশ মিনিটে এই প্রশ্নটা মিনিমাম ১৫ বার করেছে হাওয়া বেগম।
___ ' হ্যাঁ আপা বুঝেই বলছি। এখন তুমি কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার।"
___ " তবে আপা যেটাই করেন না কেন, ভেবে চিন্তা করে করবেন। একটা না, তিন তিনটা মানুষের জীবন আপনার এক সিদ্ধান্তের উপরে। '
ছোট খালু বেশ শক্ত করেই বলল কথাটা। এই জীবনে হাওয়া বেগম অনেক দোদুল্যমান পরিস্থিতিতেই পড়েছেন, কিন্তু এমন অবস্থা তার জীবনে খুব কমই এসেছে। কি যে এক অবস্থা, সে কি সিদ্ধান্ত নেবে? কাকে রেখে, কাকে বেঁচে নেবে হাওয়া বেগম......