প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মক্কা জীবনী

যুবক ও ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ

১২ বছর বয়সে পিতৃব্য আবু ত্বালিবের সাথে সর্বপ্রথম ব্যবসা উপলক্ষে শাম বা সিরিয়া সফর করেছিলেন। কিন্তু ‘বাহীরা’ রাহেবের কথা শুনে চাচা তাকে সাথে সাথেই মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন।[হাকেম হা/৪২২৯; তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮] এখন তিনি পঁচিশ বছরের পরিণত যুবক। কুরায়েশ বংশে অনেকে ছিলেন, যারা নির্দিষ্ট লভ্যাংশের বিনিময়ে ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু নিজেরা সরাসরি ব্যবসায়িক সফরে যেতেন না। এজন্য তারা সর্বদা বিশ্বস্ত ও আমানতদার লোক তালাশ করতেন। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন এমনই একজন বিদুষী ব্যবসায়ী মহিলা। মুহাম্মাদের সততা ও আমানতদারীর কথা শুনে তিনি তার নিকটে অন্যদের চেয়ে অধিক লভ্যাংশ দেওয়ার অঙ্গীকারে ব্যবসায়ের প্রস্তাব পাঠান। চাচার সাথে পরামর্শক্রমে তিনি এতে রাজি হয়ে যান। অতঃপর খাদীজার গোলাম মায়সারাকে সাথে নিয়ে প্রথম ব্যবসায়িক সফরে তিনি সিরিয়া গমন করেন। ব্যবসা শেষে মক্কায় ফিরে আসার পরে হিসাব-নিকাশ করে মূল পুঁজি সহ এত বেশী লাভ হস্তগত হয় যে, খাদীজা ইতিপূর্বে কারু কাছ থেকে এত লাভ পাননি।

 

বিবাহ

ব্যবসায়ে অভাবিত সাফল্যে খাদীজা দারুণ খুশী হন। অন্যদিকে গোলাম মায়সারার কাছে মুহাম্মাদের মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী এবং উন্নত চিন্তা-চেতনার কথা শুনে বিধবা খাদীজা মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে পরপর দু’জন স্বামী মৃত্যুবরণ করায় মক্কার সেরা নেতৃবৃন্দ তাঁর নিকটে বিয়ের পয়গাম পাঠান। কিন্তু তিনি কোনটাই গ্রহণ করেননি। এবার তিনি নিজেই বান্ধবী নাফীসার মাধ্যমে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন যুবক মুহাম্মাদ-এর কাছে। তখন উভয় পক্ষের মুরববীদের সম্মতিক্রমে শাম থেকে ফিরে আসার মাত্র দু’মাসের মাথায় সমাজনেতাদের উপস্থিতিতে ধুমধামের সাথে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মুহাম্মাদ স্বীয় বিবাহের মোহরানা স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। এ সময় খাদীজা ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারিণী হিসাবে ‘ত্বাহেরা’ (পবিত্রা) নামে খ্যাত। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ এবং মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। মুহাম্মাদ ছিলেন খাদীজার তৃতীয় স্বামী। অন্যদিকে খাদীজা ছিলেন মুহাম্মাদের প্রথমা স্ত্রী।[ইবনু হিশাম ১/১৮৭-৮৯; আল-বিদায়াহ ২/২৯৩-৯৪] উভয়ের দাম্পত্য জীবন পঁচিশ বছর স্থায়ী হয়। মৃত্যুকালে খাদীজার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তবে উভয়ের বয়স নিয়ে মতভেদ আছে।

 

 

সন্তান-সন্ততি :

━━━━━━━━━

তাঁর মোট ৩ পুত্র ও ৪ কন্যা ছিল। ইবরাহীম ব্যতীত বাকী ৬ সন্তানের সবাই ছিলেন খাদীজার গর্ভজাত। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ করেননি।[ইবনু হিশাম ১/১৯০; মুসলিম হা/২৪৩৬] মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে বিয়ের সময় খাদীজা পূর্ব স্বামীদ্বয়ের কয়েকজন জীবিত সন্তানের মা ছিলেন। তাঁর গর্ভজাত ও পূর্বস্বামীর সন্তানেরা সকলে ইসলাম কবুল করেন ও সকলে সাহাবী ছিলেন। খাদীজার গর্ভে রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম সন্তান ছিল ক্বাসেম। তার নামেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। অতঃপর কন্যা যয়নব, পুত্র আব্দুল্লাহ; যার লকব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের। কারণ তিনি নবুঅত লাভের পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর রুক্বাইয়া, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা। ক্বাসেম ছিলেন সন্তানদের মধ্যে সবার বড়। যিনি ১৭ মাস বয়সে মারা যান। নবুঅত লাভের পর আব্দুল্লাহ জন্ম গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করায় ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা রাসূল (সাঃ)-কে ‘আবতার’ বা নির্বংশ বলে অভিহিত করেন। কেননা সে যুগে কারু পুত্র সন্তান মারা গেলে এবং পরে পুত্র সন্তান হতে দেরী হলে আরবরা ঐ ব্যক্তিকে ‘আবতার’ বলত। অতঃপর চার কন্যার মধ্যে কে সবার বড় ও কে সবার ছোট এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে প্রসিদ্ধ মতে যয়নব বড় ও ফাতেমা ছিলেন ছোট।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মোট সাত সন্তানের ছয় জনই তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মধ্যে পুত্রগণ শৈশবে মারা যান। কন্যাগণ সকলে বিবাহিতা হন ও হিজরত করেন। কিন্তু ফাতেমা ব্যতীত বাকী তিন কন্যা রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ছয় মাস পরে ফাতেমা (রাঃ) মারা যান। রাসূল (সাঃ)-এর সর্বশেষ সন্তান ছিলেন পুত্র ‘ইবরাহীম’। তিনি ছিলেন মিসরীয় দাসী মারিয়া ক্বিবতীয়ার গর্ভজাত। যিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং দুধ ছাড়ার আগেই মাত্র ১৮ মাস বয়সে ১০ম হিজরীর ২৯শে শাওয়াল মোতাবেক ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ২৭ অথবা ৩০শে জানুয়ারী সূর্য গ্রহণের দিন সোমবার মদীনায় ইন্তেকাল করেন।[বুখারী হা/১০৬০; মুসলিম হা/৯০৬]

 

 

জামাতাগণ :

━━━━━━━

(১) আবুল ‘আছ বিন রাবী‘ : ইনি খাদীজার আপন বোন হালার পুত্র ছিলেন। কন্যা যয়নবকে তিনি এই ভাগিনার সাথে বিবাহ দেন। আলী ও উমামাহ নামে তাঁদের একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান হয়। যয়নব (রাঃ) ৮ম হিজরীতে এবং আবুল ‘আছ (রাঃ) ১২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (২-৩) উৎবা ও উতাইবাহ : আবু লাহাবের এই দুই পুত্রের সাথে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। কিন্তু সূরা লাহাব নাযিলের পর তাদেরকে তালাক দিতে আবু লাহাব বাধ্য করেন। এদের ঔরসে কোন সন্তানাদি হয়নি। পরে রুক্বাইয়া হযরত উসমান (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। হাবশায় হিজরতকালীন সময়ে ‘আব্দুল্লাহ’ নামে তাঁর একটি পুত্র সন্তান হয়। যিনি ১ম হিজরীতে মদীনায় ৬ বছর বয়সে মারা যান। তার পরের বছর ২য় হিজরীতে বদরের যুদ্ধ থেকে ফেরার দিন রুক্বাইয়া মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর উম্মে কুলছূমকে উসমানের সাথে বিবাহ দেওয়া হয়। রাসূল (সাঃ)-এর দুই মেয়ের স্বামী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করায় উসমানকে ‘যুন-নূরাইন’(ذُوْ النُّورَين) বলা হয়।[1] উম্মে কুলছূম নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি ৯ম হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (৪) আলী ইবনু আবী ত্বালেব : ২য় হিজরীর ছফর মাসে তাঁর সাথে ফাতেমা (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। হাসান, হোসায়েন, উম্মে কুলছূম ও যয়নব নামে তাঁর গর্ভজাত চারটি সন্তান ছিল। অনেকে মুহসিন ও রুক্বাইয়া নামে আরও দু’টি সন্তানের কথা বলেছেন। যারা শিশু অবস্থায় মারা যায়। ১১ হিজরীর ৩রা রামাযান মঙ্গলবার রাতে ৩০ অথবা ৩৫ বছর বয়সে ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন।[2]

 

 

 

 

[1]. এ লকবটি তাঁর সম্পর্কে আবুবকর (রাঃ)-এর মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত (আলবানী, যিলালুল জান্নাহ হা/১১৫৩, সনদ সহীহ)।

[2]. সন্তান-সন্ততি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন : আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/২৬৭-৭০; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৯৫-১১১ পৃঃ; আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন উসমান ক্রমিক সংখ্যা ৬১৮৯।

 

কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণ ও মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা

আল-আমীন মুহাম্মাদ-এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরায়েশ নেতাগণ কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে গড়া ন্যূনাধিক আড়াই হাযার বছরের স্মৃতিধন্য এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনর্নির্মাণের পবিত্র কাজে সকলে অংশীদার হতে চায়।

ইবরাহীমী যুগ থেকেই কা‘বাগৃহ ৯ হাত উঁচু চার দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর ছিল, যার কোন ছাদ ছিল না। কা‘বা অর্থই হল চতুর্দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উঁচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির স্রোতের আঘাতে কা‘বার দেওয়াল ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সে বছরের তীব্র বন্যায় কা‘বা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। অধিকন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঐ সময় ঘটে যায়, যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি এবং যা কা‘বা পুনর্নির্মাণে প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে কাজ করে। ঘটনাটি ছিল এই যে, কিছু চোর দেওয়াল টপকে কা‘বা গৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়।

কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে স্থির করেন যে, এর নির্মাণ কাজে কারু কোনরূপ হারাম মাল ব্যয় করা হবে না। তারা বলেন, হে কুরায়েশগণ! তোমরা এর নির্মাণ কাজে তোমাদের পবিত্র উপার্জন থেকে ব্যয় কর। এর মধ্যে ব্যভিচারের অর্থ, সূদের অর্থ, কারু প্রতি যুলুমের অর্থ মিশ্রিত করোনা’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৪)। অতঃপর কোন কোন গোত্র মিলে কোন পাশের দেওয়াল নির্মাণ করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা ইতিপূর্বে ছিল না। কিন্তু কে আগে দেওয়াল ভাঙ্গার সূচনা করবে? অবশেষে অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী সাহস করে প্রথম ভাঙ্গা শুরু করেন। তারপর সকলে মিলে দেওয়াল ভাঙ্গা শেষ করে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙ্গা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে ‘বাকূম’ (باقوم بنّاء رومى) নামক জনৈক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকার্য শুরু হয়। কিন্তু গোল বাঁধে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গড়াবার আশংকা দেখা দিল। তখন প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযূমী প্রস্তাব করলেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ‘হারামে’ প্রবেশ করবেন, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল।

আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, বনু শায়বাহ ফটক দিয়ে সকালে সবার আগে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সকলের প্রিয় ‘আল-আমীন’। কা‘বা নির্মাণে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী রাবী আব্দুল্লাহ বিন সায়েব আল-মাখযূমীর বর্ণনা মতে তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো- هَذَا الْأَمِينُ، رَضِينَا، هَذَا مُحَمَّدٌ ‘এই যে আল-আমীন। আমরা তাঁর উপর সন্তুষ্ট। এই যে মুহাম্মাদ’। অতঃপর তিনি ঘটনা শুনে একটা চাদর চাইলেন এবং সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ উঠিয়ে তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সকলে মিলে চাদরের চারপাশ ধরে নিয়ে চলুন। তাই করা হল। কা‘বার নিকটে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন।[ইবনু হিশাম ১/১৯৭; আহমাদ হা/১৫৫৪৩; হাকেম হা/১৬৮৩] এই দ্রুত ও সহজ সমাধানে সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মাদের তারীফ করতে করতে চলে গেল। আরবরা এমন এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল, যা ২০ বছরেও শেষ হত কি-না সন্দেহ। এ ঘটনায় সমগ্র আরবে তাঁর প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো। নেতাদের মধ্যে তাঁর প্রতি একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রমবোধ সৃষ্টি হল।

উল্লেখ্য যে, নবুঅত লাভের পূর্ব পর্যন্ত কুরায়েশগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শ্রদ্ধাভরে আল-আমীন (الْأَمِينُ) বলেই ডাকত’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৮)।

কা‘বাগৃহ নির্মাণের এক পর্যায়ে উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু ‘আদী বিন কা‘ব বিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের কমতি থাকায় কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে মূল ভিতের ঐ অংশের প্রায় সাত হাত জায়গা বাদ রেখেই দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। যা হাত্বীম (الْحَطِيم) বা পরিত্যক্ত নামে আজও ঐভাবে আছে। সেকারণ হাতীমের বাহির দিয়েই ত্বাওয়াফ করতে হয়, ভিতর দিয়ে নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা বিজয়ের পরে ঐ অংশটুকু কা‘বার মধ্যে শামিল করে মূল ইবরাহীমী ভিতের উপর কা‘বা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নওমুসলিম কুরায়েশরা সেটা মেনে নিবে না ভেবে বিরত থাকেন’ (বুখারী হা/১৫৮৬)। একারণেই বলা হয়ে থাকে, دَرْءُ الْمَفَاسِدِ أَوْلَى مِنْ جَلْبِ الْمَصَالِحِ ‘মন্দ প্রতিরোধ অধিক উত্তম কল্যাণ আহরণের চাইতে’। উল্লেখ্য যে, হিজরতের ১৮ বছর পূর্বে কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত হয়’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৭-এর টীকা-৩)।

 

 

কা‘বার আকৃতি :

━━━━━━━━━━

কুরায়েশ নির্মিত চতুষ্কোণ বিশিষ্ট কা‘বা (যার রূপ বর্তমানে রয়েছে), তার দেওয়ালের উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়াল দশ দশ মিটার এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়াল বারো বারো মিটার করে প্রশস্ত। ৬টি খাম্বার উপরে নির্মিত ছাদ। মাত্বাফ থেকে দেড় মিটার উচ্চতায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ‘রুকনে ইয়ামানী’ অবস্থিত। দরজার নীচের চৌকাঠ ২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৬২)। অথচ রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছা ছিল, হাত্বীমকে অন্তর্ভুক্ত করে মূল ভিতের উপর কা‘বাগৃহ নির্মাণ করা, যা মাটি সমান হবে। যার পূর্ব দরজা দিয়ে মুছল্লী প্রবেশ করবে ও সালাত শেষে পশ্চিম দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে। যাতে তাদের ইচ্ছার বাইরে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে’।[বুখারী হা/১২৬; মুসলিম হা/১৩৩৩]

খালা আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট এ হাদীছ শোনার পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে (৬৪-৭৩ হিঃ) ৬৪ হিজরী সনে কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছানুযায়ী তা পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু ৭৩ হিজরী সনে তিনি যুদ্ধে নিহত হলে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তা পুনরায় ভেঙ্গে আগের মত হাত্বীমকে বাইরে রেখে নির্মাণ করেন। যা আজও রয়েছে। পরবর্তীতে আববাসীয় খলীফা মাহদী ও হারূণ এটি পুনর্নির্মাণ করে রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.) তাদের বলেন,لاَ تَجْعَلْ كَعْبَةَ اللهِ مَلْعَبَةً لِلْمُلُوْكِ ‘আপনারা কা‘বাগৃহকে রাজা-বাদশাহদের খেল-তামাশার বস্ত্ততে পরিণত করবেন না’।[1] ফলে কা‘বাগৃহ ঐ অবস্থায় রয়ে যায়। ইবরাহীমী ভিতে আজও ফিরে আসেনি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আকাংখাও পূর্ণ হয়নি।

 

 

 

 

[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১২৭-২৮ আয়াত; ঐ, আল-বিদায়াহ ৮/২৫৩; সুহায়লী, আর-রাউযুল উনুফ ২/১৭৩।

 


Bonolota

106 Blog posts

Comments