রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর মদিনা জীবনী অংশ ১০

সাফা পাহাড়ের দাওয়াত

নিকটাত্মীয়দের প্রতি প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রকে একত্রিত করে তাদের সামনে দাওয়াত দেবার মনস্থ করলেন। তৎকালীন সময়ে নিয়ম ছিল যে, বিপদসূচক কোন খবর থাকলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে আহবান করতে হত। আসন্ন কোন বিপদের আশংকা করে তখন সবাই সেখানে ছুটে আসত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেমতে একদিন সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে ডাক দিলেন,يَا صَبَاحَاه (প্রত্যুষে সবাই সমবেত হও!)। কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রের লোক দ্রুত সেখানে জমা হয়ে গেল। অতঃপর তিনি বললেন, হে কুরায়েশগণ! আমি যদি বলি, এই পাহাড়ের অপর পার্শ্বে একদল শক্তিশালী শত্রুসৈন্য তোমাদের উপরে হামলার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলে কি তোমরা সে কথা বিশ্বাস করবে? সকলে সমস্বরে বলে উঠল, অবশ্যই করব। কেননা مَا جَرَّبْنَا عَلَيْكَ إِلاَّ صِدْقًا ‘আমরা এযাবৎ তোমার কাছ থেকে সত্য ব্যতীত কিছুই পাইনি’। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, فَإِنِّىْ نَذِيْرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍ شَدِيْدٍ ‘আমি ক্বিয়ামতের কঠিন আযাবের প্রাক্কালে তোমাদের নিকটে সতর্ককারী রূপে আগমন করেছি’।[বুখারী হা/৪৭৭০; মুসলিম হা/২০৮; মিশকাত হা/৫৩৭২, ৫৮৪৬]

অতঃপর তিনি আবেগময় কণ্ঠে এক একটি গোত্রের নাম ধরে ধরে ডেকে বলতে থাকলেন,يَامَعْشَرَ قُرَيْشٍ! أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ ‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুওয়াই! হে বনু ‘আব্দে মানাফ!... হে বনু ‘আব্দে শাম্স!.. হে বনু হাশেম!... হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। অতঃপর ব্যক্তির নাম ধরে ধরে বলেন, হে (চাচা) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে (ফুফু) ছাফিইয়াহ! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। অবশেষেيَا فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ! أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ، وَاللهِ لاَ أُغْنِيْ عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا ‘হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! তুমি আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী নাও! কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে আল্লাহর পাকড়াও হতে রক্ষা করতে পারব না’।

এই মর্মস্পর্শী আবেদন গর্বোদ্ধত চাচা আবু লাহাবের অন্তরে দাগ কাটেনি। তিনি মুখের উপর বলে দিলেন-تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ، أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا؟ ‘সকল দিনে তোমার উপরে ধ্বংস আপতিত হৌক! এজন্য তুমি আমাদের জমা করেছ?’ অতঃপর সূরা লাহাব নাযিল হয়تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ ‘ধ্বংস হৌক আবু লাহাবের দু’হাত এবং ধ্বংস হৌক সে নিজে’।[বুখারী হা/২৭৫৩, মুসলিম হা/২০৮; মিশকাত হা/৫৩৭২-৭৩]

এভাবে নিজ সম্প্রদায়কে এবং বাজারে-ঘাটে সর্বত্র বিশেষ করে হজ্জের মৌসুমে সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতে থাকেন এই মর্মে যে,قُوْلُوْا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا ‘তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে’।[1]

 

 

 

 

[1]. আহমাদ হা/১৬০৬৬, সনদ হাসান; হাকেম হা/৩৯, ৪২১৯ সনদ সহীহ। উল্লেখ্য যে, নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়ার আদেশ পালন করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) প্রথমে বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের ৪৫জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে বাড়িতে দাওয়াত দেন। কিন্তু আবু লাহাবের বিরোধিতার কারণে উক্ত দাওয়াত ব্যর্থ হলে পুনরায় দ্বিতীয়বার তাদেরকে দাওয়াত দেন। তখন আবু লাহাব প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন এবং আবু ত্বালেব তাঁকে আমৃত্যু সাহায্য করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন (আর-রাহীক্ব ৭৮-৭৯ পৃঃ) মর্মে বক্তব্যগুলির কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই (সীরাহ সহীহাহ ১/১৪২-৪৩)।

 

আবু লাহাবের পরিচয়

১) আবু লাহাব ছিলেন আব্দুল মুত্ত্বালিবের অন্যতম পুত্র। তার নাম ছিল আব্দুল ‘উযযা। গৌর-লাল বর্ণ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ার কারণে তাকে ‘আবু লাহাব’ অর্থাৎ ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ওয়ালা’ বলা হত। আল্লাহ তার জন্য এই নামই পসন্দ করেছেন। কেননা এর মধ্যে তার জাহান্নামী হওয়ার দুঃসংবাদটিও লুকিয়ে ছিল। তাছাড়া আব্দুল ‘উযযা নাম কুরআনে থাকাটা তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। আবু লাহাব ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর আপন চাচা এবং নিকটতম প্রতিবেশী। (২) তার দুই ছেলে উৎবা ও উতাইবার সাথে নবুঅত-পূর্বকালে রাসূল (সাঃ)-এর দুই মেয়ে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। কিন্তু নবী হওয়ার পরে তিনি তার ছেলেদেরকে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করেন। এই দুই মেয়েই পরবর্তীতে একের পর এক হযরত উসমান (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। (৩) নবুঅত লাভের পর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ (যার লকব ছিল ত্বাইয়েব ও ত্বাহের) মারা গেলে তিনি খুশীতে বাগবাগ হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলেন, মুহাম্মাদ এখন লেজকাটা নির্বংশ (الْأَبْتَرُ) হয়ে গেল। যার প্রেক্ষিতে সূরা কাওছার নাযিল হয়। কেননা সেযুগে কারু ছেলে সন্তান না থাকলে তাকে উক্ত নামে অভিহিত করা হত।[কুরতুবী, তাফসীর সূরা কাওছার ৩ আয়াত] (৪) হজ্জের মৌসুমে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর পিছে লেগে থাকতেন। যেখানেই রাসূল (সাঃ) দাওয়াত দিতেন, সেখানেই তিনি তাঁকে গালি দিয়ে লোকদের ভাগিয়ে দিতেন।[আহমাদ হা/১৬০৬৬; হাকেম হা/৪২১৯, ২/৬১১]

 

 

আবু লাহাবের স্ত্রী :

━━━━━━━━━━━

তার স্ত্রী ছিলেন আবু সুফিয়ানের বোন আরওয়া (أروى) অথবা ‘আওরা’ (العوراء) ওরফে উম্মে জামীল বা ‘সুন্দরের উৎস’। তবে একচক্ষু দৃষ্টিহীন হওয়ায় ইবনুল ‘আরাবী উক্ত মহিলাকে ‘আওরা উম্মে ক্বাবীহ’(عوراء ام قبيح) ‘এক চক্ষু সকল নষ্টের মূল’ বলেন’ (কুরতুবী)। তিনিও স্বামীর অকপট সহযোগী ছিলেন এবং সর্বদা রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকতেন। চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায়حَمَّالَةُ الْحَطَبِ ইন্ধন বহনকারী বা ‘খড়িবাহক’ বলা হত। অর্থাৎ ঐ শুষ্ককাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করতেন পিছনে থেকে। সেকারণ আল্লাহ তাকেও স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে হেন অপপ্রচার নেই, যা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী করতেন না।

তার স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ দুষ্কর্মে পটু ছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর যাতায়াতের পথে বা তাঁর বাড়ীর দরজার মুখে কাঁটা বিছিয়ে বা পুঁতে রাখতেন। যাতে রাসূল (সাঃ) কষ্ট পান। তিনি ছিলেন কবি। ফলে নানা ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ করে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন। সূরা লাহাব নাযিল হলে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল (সাঃ) সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে দেখতে পাননি’।[1] তাই পাশে দাঁড়ানো আবু বকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসাপূর্ণ কবিতা বলে ফিরে আসেন। উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন। যেমন-مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا ‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।[2]

 

 

আবু লাহাবের পরিণতি :

━━━━━━━━━━━━━━

বদর যুদ্ধের এক সপ্তাহ পরে আবু লাহাবের গলায় প্লেগ মহামারীর ফোঁড়া দেখা দেয়। আজকের ভাষায় যাকে ‘গুটি বসন্ত’ (Small Pox) বলা যায়। যার প্রভাবে তার সারা দেহে পচন ধরে ও তাতেই তিনি মারা যান। সংক্রামক ব্যাধি হওয়ার কারণে তার পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনদিন সেখানে লাশ পড়ে থাকার পর দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্য কুরায়েশ-এর এক ব্যক্তির সহায়তায় আবু লাহাবের দুই ছেলে লাশটি মক্কার উচ্চ ভূমিতে নিয়ে যায় এবং সেখানেই একটি গর্তে লাঠি দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়। অতঃপর দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে গর্ত বন্ধ করে দেয়।[3] যিনি একদিন রাসূল (সাঃ)-কে পাথর ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাকেই আজ মরণের পর তার ছেলেরাই পাথর ছুঁড়ে মেরে অনাদরে পুঁতে দিল। তার বিপুল ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি তার কোনই কাজে আসল না। অহংকারের পরিণাম চিরদিন এরূপই হয়ে থাকে।

 

 

স্ত্রীর পরিণতি :

━━━━━━━━

মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিতেন। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, তিনি রাতের বেলায় একাজ করতেন। একদিন তিনি গলায় বোঝা বহন করে আনতে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়েন। তখন ফেরেশতা এসে তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে হালাক করে দেয়’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব)।

 

 

তার সন্তানাদি :

━━━━━━━━━

আবু লাহাবের উৎবা, উতাইবা ও মু‘আত্তাব নামে তিন পুত্র এবং দুর্রাহ, খালেদা ও ইযযাহ নামে তিন কন্যা ছিল। তন্মধ্যে উৎবা ও উতাইবা রাসূল (সাঃ) দুই কন্যা রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের স্বামী ছিল। সূরা লাহাব নাযিলের পর আবু লাহাবের নির্দেশে ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়। পরবর্তীতে তাঁরা উসমান (রাঃ)-এর সাথে পরপর বিবাহিতা হন। উম্মে কুলছূমের স্বামী উতাইবা রাসূল (সাঃ)-এর বদদো‘আ প্রাপ্ত হয়ে আবু লাহাবের জীবদ্দশায় কুফরী হালতে বাঘের হামলায় নিহত হয়। বাকী দু’জন পুত্র ও তিন কন্যা মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হন। পুত্রদ্বয় হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হোনায়েন যুদ্ধে সংকটকালে তারা রাসূল (সাঃ)-এর নিরাপত্তায় দৃঢ় ছিলেন। মু‘আত্তাব এই যুদ্ধে একটি চোখ হারান। মক্কা বিজয়ের পরে অন্যেরা মদীনায় হিজরত করলেও তারা দু’ভাই আমৃত্যু মক্কায় অবস্থান করেন।[4]

 

 

 

 

[1]. মুসনাদে বাযযার হা/১৫; বাযযার বলেন, এর চাইতে উত্তম সনদে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পারিনি; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১৫২৯।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ সহীহ; আলবানী, সহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ সহীহাহ ১/১৪৭।

[3]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৬; বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত ৩/১৪৫-১৪৬; আল-বিদায়াহ ৩/৩০৯; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২২৫-২৬; কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব।

[4]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ক্রমিক ৩৫৫, ৩৫৬ (৪/৪৪-৪৫ পৃঃ), ৪০৯৯-৪১০০ (৮/২৯-৩১ পৃঃ), ৪১২১-২৩ (৮/৪০ পৃঃ), হাকেম হা/৩৯৮৪; মুহিববুদ্দীন ত্বাবারী (মৃ. ৬৯৪ হি.), যাখায়েরুল ‘উক্ববা (কায়রো : ১৩৫৬ হি.) ২৪৯ পৃঃ।


Bonolota

106 Blog posts

Comments