রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার
১. ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা :
━━━━━━━━━━━━
সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর কুরায়েশ নেতারা এবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে সরাসরি অত্যাচারের সিদ্ধান্ত নিল। যেমন-
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিক থেকে লোকদের ফিরিয়ে আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা বিদ্রুপ করে বলে, আমরাও এরূপ বলতে পারি। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ ‘যখন তাদের নিকটে আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি। ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)।
উক্ত আয়াতে কাফেররা ‘কুরআনকে পুরাকালের কাহিনী এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ অনুরূপ একটি কুরআন বা তার মত দু’একটি সূরা বা আয়াত জিন-ইনসান সকলকে একত্রিত হয়ে রচনা করে আনার জন্য মক্কায় পাঁচবার[ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮] এবং মদীনায় একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) সহ মোট ছয়বার কাফেরদের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু সে যুগে ও এ যুগে কেউ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বরং দেখা গেছে যে, সে যুগে ঐসব নেতারাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের সালাতে রাসূল (সাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনত। আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শারীক্ব, আবু জাহল প্রমুখ নেতারা একে অপরকে না জানিয়ে গোপনে একাজ করত’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬)। কিন্তু যখন তারা তাদের জনগণের সামনে যেত, তখন তাদের মন্তব্য পাল্টে যেত। কারণ তখন দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে সত্যভাষণ থেকে ফিরিয়ে রাখত। একই অবস্থা আজকালকের মুসলিম-অমুসলিম নেতাদের। যাদের অধিকাংশ রাসূল (সাঃ) ও কুরআনের সত্যতাকে স্বীকার করে। কিন্তু বাস্তবে তা মানতে রাজি হয় না স্রেফ দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে।
এভাবে কাফেররা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত নানারূপ মানসিক কষ্ট দেয়। এ সময় আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, وَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُوْلُوْنَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيْلاً ‘তারা যেসব কথা বলে, তাতে তুমি ছবর কর এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চলো’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১০)।
২. প্রতিবেশীদের অত্যাচার :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটতম প্রতিবেশী ছিলেন তাঁর চাচা আবু লাহাব। তিনি ও তার স্ত্রী ছাড়াও কষ্টদানকারী অন্যান্য প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, ‘আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৪১৫-১৬)। ইনিই ছিলেন উমাইয়া বংশের অন্যতম খলীফা মারওয়ানের পিতা। বস্ত্ততঃ মু‘আবিয়া (রাঃ) ও ইয়াযীদ বাদে মারওয়ানের বংশধরগণই ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের পরপর খলীফা। অন্যান্য প্রতিবেশীরাও রাসূল (সাঃ)-এর উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়। তাতে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوْذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ ‘তোমার পূর্বের বহু রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে। কিন্তু এ মিথ্যারোপে তারা ছবর করেছেন এবং তারা নির্যাতিত হয়েছেন যতক্ষণ না তাদের কাছে আমাদের সাহায্য এসে পৌঁছেছে। আর আল্লাহর বাণীসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। এ বিষয়ে নবীগণের কিছু খবর তোমার নিকটে পৌঁছে গেছে (যার মধ্যে তোমার জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে)’ (আন‘আম ৬/৩৪)।[1]
৩. কা‘বাগৃহে সালাতরত অবস্থায় কষ্টদান :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (সাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসে বলাবলি করতে লাগল, কে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি এনে এই ব্যক্তির উপর চাপাতে পারে, যখন সে সিজদায় যাবে? তখন ওক্ববা বিন আবী মু‘আইত্ব উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুঁড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এতে শত্রুরা হেসে লুটোপুটি খেয়ে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ছিল না। এই সময় ফাতেমার কাছে খবর পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ইবনু হাজার বলেন, সম্ভবতঃ খবরটি রাবী নিজেই দিয়েছিলেন (বুখারী ফৎহসহ হা/৫২০-এর আলোচনা)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,
اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ- ثُمَّ سَمَّى- اللهُمَّ عَلَيْكَ بِعَمْرِو بْنِ هِشَامٍ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ، وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ، وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ، وَعُمَارَةَ بْنِ الْوَلِيدِ، قَالَ عَبْدُ اللهِ فَوَاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى يَوْمَ بَدْرٍ، ثُمَّ سُحِبُوا إِلَى الْقَلِيبِ قَلِيبِ بَدْرٍ- متفق عليه-
‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধর (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম (আবু জাহল)-কে ধর। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধর’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।[বুখারী হা/৫২০; মুসলিম হা/১৭৯৪; মিশকাত হা/৫৮৪৭] উটের ভুঁড়ি চাপানোর এই নির্দেশ আবু জাহলই দিয়েছিলেন এবং অন্যেরা তা মেনে নিয়েছিল। সেমতে তার আগের দিন উটসমূহ নহর করা হয়েছিল।[মুসলিম হা/১৭৯৪; বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০]
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দো‘আ বা বদ দো‘আ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হতে পারে অথবা আল্লাহ তার থেকে অনুরূপ একটি কষ্ট দূর করে দেন অথবা সেটি আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেন’ (আহমাদ হা/১১১৪৯)। কিন্তু আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো‘আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে। যেমন আবু জাহ্ল গং রাসূল (সাঃ)-এর বদ দো‘আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় এবং বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে। ফলে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে উক্ত বদ দো‘আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সব নেতা একত্রে নিহত হয়। আর বদর যুদ্ধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক নেতা আবু লাহাব গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় মক্কায় নিজ গৃহে মারা যায়। এভাবে মযলূম নবী বিজয়ী হন ও যালেম নেতারা ধ্বংস হয়।
উল্লেখ্য যে, রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) উক্ত হাদীছে বর্ণিত মুশরিক নেতাদের সবাইকে বদরের যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হতে দেখেছেন’ বলে যে কথা বর্ণনায় এসেছে, তার অর্থ হল তিনি এদের ‘অধিকাংশ’কে দেখেছেন। কেননা ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব বদরে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হননি। বরং তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার পথে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়। উমাইয়া বিন খালাফ বদরে নিহত হলেও উক্ত কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হননি। বরং অধিক স্থূলদেহী হওয়ায় ও ফুলে যাওয়ার কারণে কূয়ায় ফেলা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে কূয়ার অদূরে একটি গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেওয়া হয়।(বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৮১) অতঃপর ‘উমারাহ বিন অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী, যাকে কুরায়েশরা দূত হিসাবে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে জাদুর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হাবশার জঙ্গলে কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল।(বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০)
(খ) একদিন সালাতরত অবস্থায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এসে গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে রাসূল (সাঃ) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবুবকর (রাঃ) ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশগুলিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন,أَتَقْتُلُونَ رَجُلاً أَنْ يَقُولَ رَبِّىَ اللهُ؟ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ। অথচ তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ এ সময় তারা রাসূল (সাঃ)-কে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’ (বুখারী, হা/৬৩৭৮, ৪৮১৫)।
ওরওয়া বিন যুবায়ের বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সবচাইতে কষ্টদায়ক আচরণ কোনটি করেছিল, আমাকে বলুন। তখন তিনি ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের অত্র ঘটনাটি বর্ণনা করেন’ (বুখারী হা/৩৮৫৬)।
রাসূল (সাঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَقَالَ رَجُلٌ مُّؤْمِنٌ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيْمَانَهُ أَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَنْ يَّقُوْلَ رَبِّيَ اللهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَّبِّكُمْ- (مؤمن ২৮)-
‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ (গাফের/মুমিন ৪০/২৮)।
আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে? তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর। আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’। সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাঊন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর? লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’।[2]
৪. সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়া :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
এ ব্যাপারে অন্যতম প্রতিবেশী উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করতেন। তাছাড়া রাসূল (সাঃ)-কে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে-তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করতেন এবং তাঁকে অভিশাপ দিতেন। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক সম্মুখে নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য’ (হুমাযাহ ১০৪/১)।[3]
৫. রাসূল (সাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, তার সাথী ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূল (সাঃ)-এর কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্ববা তাই-ই করল’। এ প্রসঙ্গে নাযিল হয়,وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً (27) يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً (28) لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً- (الفرقان 27-29) ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’। ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)।[4]
(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতাইবা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (সাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত(وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى...ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি, বলেই সে হেঁচকা টানে রাসূল (সাঃ)-এর গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। অথচ এই হতভাগা ছিল রাসূল (সাঃ)-এর জামাতা। যে তার পিতার কথা মত রাসূল (সাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছূমকে তালাক দেয়। তার ভাই উৎবা একইভাবে রাসূল (সাঃ)-এর অপর কন্যা রুক্বাইয়াকে তালাক দেয়। পরে যার বিয়ে হযরত উসমান (রাঃ)-এর সাথে হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে উম্মে কুলছূমের সাথে উসমান (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন,اللهُمَّ سَلِّطْ عَلَيْهِ كَلْبًا مِنْ كِلاَبِكَ ‘হে আল্লাহ! তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’।[আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৮; হাকেম হা/৩৯৮৪]
উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কবি হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) কবিতা রচনা করেন। কিছুদিন পরে উতাইবা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠে,هَذَا وَاللهِ آكِلِي كَمَا قَالَ مُحَمَّدٌ، قَاتِلِي ابْنُ أَبِي كَبْشَةَ وَهُوَ بِمَكَّةَ وَأَنَا بِالشَّامِ ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে বদ দোআ করেছিল। সে আমাকে হত্যাকারী। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’। অতঃপর বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল’।[5]
৬. তাঁর সামনে এসে মিথ্যা শপথ করা এবং পরে চোগলখুরী করা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম সেরা একজন ব্যক্তি ছিল, যে ছিল জারজ সন্তান। সে ভাল মানুষ সেজে রাসূল (সাঃ)-এর সামনে মিথ্যা শপথ করে কথা বলত এবং পরে লোকদের কাছে গিয়ে চোগলখুরী করত। ঐ নেতার নাম সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন, আখনাস বিন শারীক্ব ছাক্বাফী, কেউ বলেছেন, অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী ইত্যাদি (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। তবে শেষোক্ত নামটিই অধিক প্রসিদ্ধ। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব ও ইকরিমা বলেন, এই ব্যক্তি ছিল ব্যভিচারের সন্তান। সে কুরায়েশ বংশজাত ছিল না। ১৮ বছর পরে জনৈক ব্যক্তি তার পিতৃদাবী করে’ (কুরতুবী)। আল্লাহপাক তার নয়টি বদ স্বভাবের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন,
وَلاَ تُطِعْ كُلَّ حَلاَّفٍ مَّهِينٍ- هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ- مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيْمٍ- (القلم ১০-১৩)-
‘তুমি কথা শুনবে না ঐ ব্যক্তির, যে অধিক শপথকারী ও হীন স্বভাব বিশিষ্ট’। ‘যে সম্মুখে নিন্দা করে এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে’। ‘সে ভালকাজে অধিক বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’। ‘রুক্ষ স্বভাবী এবং এরপরেও সে একজন জারজ সন্তান’ (ক্বলম ৬৮/১০-১৩)।
তার এই বাড়াবাড়ির কারণ ছিল তার অতুল বিত্ত-বৈভবের অহংকার। যেমন আল্লাহ বলেন,
أَنْ كَانَ ذَا مَالٍ وَّ بَنِيْنَ- إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- سَنَسِمُهُ عَلَى الْخُرْطُوْمِ-
‘আর এটা এ কারণে যে, সে ছিল বহু মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মালিক’। ‘যখন তার সম্মুখে আমাদের আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে বলে, এসব পুরাকালের কাহিনী’। ‘সত্বর আমরা তার নাসিকা দাগিয়ে দেব’ (ক্বলম ৬৮/১৪-১৬)। হাতী বা শূকরের শুঁড়কে আরবীতে ‘খুরতূম’ বলা হয়। এখানে ঐ ব্যক্তির নাম সম্পর্কে এই বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে তার হীনতা ও নিকৃষ্টতা প্রকাশ করার জন্য। ক্বিয়ামতের দিন তার নাকে খৎ দিয়ে নাসিকা দাগিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করা হবে এজন্য যে, অন্যের সামনে তার লাঞ্ছনা যেন পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। দুনিয়াতে সে রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াত থেকে নাক সিঁটকিয়েছিল। ফলে ক্বিয়ামতের দিন তার বদলা হিসাবে তার নাসিকা দাগানো হবে। একাজ অন্যেরা করলেও তার পাপ ছিল বেশী। কেননা সে ছিল নেতা। তাই তাকে সেদিন সর্বসমক্ষে চিহ্নিত করা হবে। نعوذ بالله من غضبه وقهره
৭. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে বসে কুরআন শোনার পর তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে যাওয়া :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
এ কাজটা প্রায়ই আবু জাহ্ল করত, আর ভাবত আমি মুহাম্মাদকে ও তার কুরআনকে গালি দিয়ে একটা দারুণ কাজ করলাম। অথচ তার এই কুরআন শোনাটা ছিল কপটতা এবং লোককে একথা বুঝানো যে, আমার মত আরবের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকটেই যখন কুরআনের কোন মূল্য নেই, তখন তোমরা কেন এর পিছনে ছুটবে? এ যুগের বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ পন্ডিত ও জ্ঞানপাপী মুসলমানদের অবস্থাও ঠিক অনুরূপ। যারা দিনরাত রাসূল (সাঃ) কুরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে মূলতঃ অন্যকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য। লোকেরা ভাবে, তারা বড় বড় জ্ঞানী। তারা কি কিছুই বুঝেন না? অথচ তারা এ ব্যাপারে একেবারেই গোমূর্খ। আবু জাহ্লের এই কপট ও উদ্ধত আচরণের কথা বর্ণনা করেন আল্লাহ এভাবে-فَلاَ صَدَّقَ وَلاَ صَلَّى- وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى أَهْلِهِ يَتَمَطَّى ‘সে বিশ্বাস করেনি এবং সালাত আদায় করেনি’। ‘পরন্তু সে মিথ্যারোপ করেছে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে’। ‘অতঃপর সে দম্ভভরে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩১-৩৩)। এক বর্ণনায় এসেছে যে, এক পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) আবু জাহ্লকে লক্ষ্য করে নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন,أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى- ثُمَّ أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى ‘তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’। ‘অতঃপর তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩৪-৩৫)।
৮. কা‘বাগৃহে সালাত আদায়ে বাধা সৃষ্টি :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) নবুঅত প্রাপ্তির পর থেকেই সালাত ফরয হয়। তবে তখন সালাত ছিল কেবল ফজরে ও আছরে দু’ দু’ রাক‘আত করে (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে (অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বে ও সূর্যোদয়ের পূর্বে)’।[গাফির/মুমিন ৪০/৫৫; মির‘আত ২/২৬৯] আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে সালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাক‘আত করে।[মুসলিম হা/৬৮৫; আবুদাঊদ হা/১১৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১১] এছাড়া রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’ (نَافِلَةً) ছিল তাহাজ্জুদের সালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল সালাত আদায় করতেন।[মুযযাম্মিল ৭৩/২০; তাফসীরে কুরতুবী]
প্রথম দিকে সবাই সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বাগৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি সালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহ্ল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল,يَا مُحَمَّدُ، أَلَمْ أَنْهَكَ عَنْ هَذَا؟ ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব থেকে নিষেধ করিনি?’
তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে,يَا مُحَمَّدُ بِأَيِّ شَيْءٍ تُهَدِّدُنِي؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّي لَأَكْثَرُ هَذَا الْوَادِي نَادِيًا ‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ হে মুহাম্মাদ? আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে ভারি। তখন আল্লাহ সূরা ‘আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াতগুলি নাযিল করেন।[সিলসিলা সহীহাহ হা/২৭৫; তিরমিযী হা/৩৩৪৯]
كَلاَّ إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللهَ يَرَى- كَلاَّ لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلاَّ لاَ تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ- (العلق ৬-১৯)-
‘কখনোই না। নিশ্চয়ই মানুষ সীমালংঘন করে’ (৬)। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (৭)। ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের নিকটেই প্রত্যাবর্তন স্থল’ (৮)। ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে (আবু জাহলকে) যে নিষেধ করে?’ (৯)। ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে), যখন সে সালাত আদায় করে’ (১০)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে সৎপথে থাকে’ (১১)। ‘অথবা আল্লাহভীতির আদেশ দেয়’ (১২)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (১৩)। ‘সে কি জানেনা যে, আল্লাহ তার সবকিছুই দেখেন’ (১৪)। ‘কখনোই না। যদি সে বিরত না হয়, তবে আমরা অবশ্যই তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে সজোরে টান দেব’(১৫)। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’ (১৬)। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’ (১৭)। ‘আমরাও অচিরে ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’ (১৮)। ‘কখনোই না। তুমি তার কথা শুনবে না। তুমি সিজদা কর এবং আল্লাহর নৈকট্য তালাশ কর’ (‘আলাক্ব ৯৬/৬-১৯)।
আবু জাহ্ল ও রাসূল (সাঃ)-এর মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে একটি সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।[মুসলিম হা/৫৭৮; বুখারী হা/১০৭৪; মিশকাত হা/১০২৪] আর এটাই হল কুরআনের ১৫তম ও সর্বশেষ সিজদার আয়াত’ (দারাকুৎনী হা/১৫০৭)। উল্লেখ্য যে, এই সিজদার জন্য ওযূ, কিবলা বা সালাম করা শর্ত নয়।
উপরোক্ত ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, দূরদর্শী কাফের-মুশরিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা মুসলমানদের ব্যক্তিগত ইবাদতকেই বেশী ভয় পায়। যদিও তারা মুখে বলে যে, ধর্মের ব্যাপারে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কেননা তাদের মতে ধর্ম হল আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। অথচ নেতারা ভালভাবেই জানেন যে, ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। ব্যক্তির রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু তার বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আবু জাহ্ল ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। তাই তিনি মূল জায়গাতেই বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কা‘বাতে একবার আল্লাহর জন্য সিজদা চালু হলে পাশেই রক্ষিত দেব-দেবীর সম্মুখে কেউ আর মাথা নীচু করবে না। তাদের অসীলায় কেউ আর মুক্তি চাইবে না এবং সেখানে কেউ আর নযর-নেয়ায দিবে না। অথচ অসীলাপূজার এই শিরকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের অর্থবল, জনবল, সামাজিক সম্মান সবকিছুর চাবিকাঠি। বর্তমান যুগের কবরপূজারী ও ওরস ব্যবসায়ী মুসলমানদের অবস্থা সেযুগের আবু জাহ্লদের চাইতে ভিন্ন কিছুই নয়। সেদিন যেমন কা‘বার পাশেই মূর্তিপূজা হত, এখন তেমনি মসজিদের পাশেই কবরপূজা হয় ও সেখানে নযর-নেয়ায দেওয়া হয়। ধর্মের নামে এইসব ধর্মনেতারা ধার্মিক মুসলমানদের তাওহীদ থেকে ফিরিয়ে শিরকমুখী করে। একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী নেতারা চাকুরী, ব্যবসা, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুকৌশলে দ্বীনদার মুসলিম নর-নারীকে তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করে থাকে।
(খ) সূরা ‘আলাক্ব-এর উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর আবু জাহ্ল মনে মনে ভীত হলেও বাইরে ঠাট বজায় রেখেই চলেন। একদিন তিনি কুরায়েশ নেতাদের সামনে বলে বসেন, লাত ও উয্যার কসম! যদি মুহাম্মাদকে পুনরায় সেখানে সালাতরত দেখি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমি তার ঘাড়ের উপরে পা দিয়ে তার নাকমুখ মাটিতে আচ্ছামত থেৎলে দেব’ (মুসলিম)। পরে একদিন তিনি রাসূল (সাঃ)-কে সেখানে সালাতরত অবস্থায় দেখলেন। তখন নেতারা তাকে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উসকে দিল। ফলে তিনি খুব আস্ফালন করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না। হঠাৎ দেখা গেল যে, তিনি ভয়ে পিছিয়ে আসছেন। আর দুই হাত শূন্যে উঁচু করে কি যেন এড়াতে চেষ্টা করছেন’। পিছিয়ে এসে তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমার ও তার মধ্যে একটা বিরাট অগ্নিকুন্ড দেখলাম, যা আমার দিকে ধেয়ে আসছিল’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,لَوْ دَنَا مِنِّى لاَخْتَطَفَتْهُ الْمَلاَئِكَةُ عُضْوًا عُضْوًا ‘যদি সে আমার কাছে পৌঁছত, তাহলে ফেরেশতারা তার এক একটা অঙ্গ ছিন্ন করে উঠিয়ে নিয়ে যেত’।[6] আশ্চর্যের বিষয়, এতবড় দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও এবং রাসূল (সাঃ)-এর উপর আল্লাহর সরাসরি সাহায্য প্রত্যক্ষ করেও আবু জাহ্ল তার হঠকারিতা থেকে পিছিয়ে আসেননি কেবলমাত্র নেতৃত্বের অহংকারে স্ফীত হওয়ার কারণে। নমরূদ, ফেরাঊন ও আবু জাহল সহ যুগে যুগে সকল হঠকারী নেতাদের চরিত্র একই।
(গ) শিস দেওয়া ও তালি বাজানো(المكاء والةصدية عند الصلاة فى الكعبة) : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কা‘বায় গিয়ে সালাত আদায় করতেন, তখন কাফের নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে কা‘বাগৃহে আসত। অতঃপর ইবাদতের নাম করে তারা সেখানে জোরে জোরে তালি বাজাত ও শিস্ দিত। যাতে রাসূল (সাঃ)-এর