রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর মক্কা জীবনী ১৭ তম

হাবশায় হিজরত

১ম হিজরত : (الهجرة الأولى إلى الحبشة রজব ৫ম নববী বর্ষ)

━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━

চতুর্থ নববী বর্ষের মাঝামাঝি থেকে মুসলমানদের উপরে যে নির্যাতন শুরু হয় ৫ম নববী বর্ষের মাঝামাঝি নাগাদ তা চরম আকার ধারণ করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই মযলূম মুসলমানদের রক্ষার জন্য উপায় খুঁজতে থাকেন। তিনি আগে থেকেই পার্শ্ববর্তী হাবশার ন্যায়নিষ্ঠ খ্রিষ্টান রাজা আছহামা নাজাশী(أَصْحَمَةُ النَّجَاشِىُّ)-র সুনাম শুনে আসছিলেন যে, তার রাজ্যে মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে দেওয়া হয়। অতএব তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ শেষে হাবশায় হিজরতের নির্দেশ দানের সিদ্ধান্ত নেন। সেমতে নবুঅতের পঞ্চম বর্ষের রজব মাসে হযরত উসমান (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ১২ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলার প্রথম দলটি রাতের অন্ধকারে অতি সঙ্গোপনে হাবশার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। এই দলে রাসূল (সাঃ)-এর কন্যা ‘রুক্বাইয়া’ ছিলেন।[1] ভাগ্যক্রমে ঐ সময় লোহিত সাগরের বন্দর শো‘আইবাহ(ميناء شعيبة) তে দু’টো ব্যবসায়ী জাহায নোঙর করা ছিল। ফলে তারা খুব সহজে তাতে সওয়ার হয়ে হাবশায় পৌঁছে যান। কুরায়েশ নেতারা পরে জানতে পেরে দ্রুত পিছু নিয়ে বন্দর পর্যন্ত গমন করে। কিন্তু তারা নাগাল পায়নি।[আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/৯৫]

 

 

২য় হিজরত : (الهجرة الثانية إلى الحبشة সম্ভবতঃ যুলক্বা‘দাহ ৫ম নববী বর্ষ)

━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━

হাবশার বাদশাহ কর্তৃক সদাচরণের খবর শুনে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের উপরে যুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল এবং কেউ যাতে আর হাবশায় যেতে না পারে, সেদিকে কড়া নযর রাখতে লাগল। কারণ এর ফলে তাদের দু’টি ক্ষতি ছিল। এক- বিদেশের মাটিতে কুরায়েশ নেতাদের যুলুমের খবর পৌঁছে গেলে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। দুই- সেখানে গিয়ে মুসলমানেরা সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পাবে। কিন্তু তাদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি এবং কড়া নযরদারী সত্ত্বেও জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৮২ বা ৮৩ জন পুরুষ এবং ১৮ বা ১৯জন মহিলা দ্বিতীয়বারের মত হাবশায় হিজরত করতে সমর্থ হন। এই দলে ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) ছিলেন কি-না সন্দেহ আছে’।[আর-রাহীক্ব ৯৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৩৩০]

তাফসীরবিদগণের আলোচনায় আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হয় যে, ৫ম নববী বর্ষে মুহাজিরগণের দ্বিতীয় যে দলটি হাবশায় হিজরত করেন, তাদের সাথে হযরত জা‘ফর বিন আবু তালেব সম্ভবতঃ দু’বছর হাবশায় অবস্থান করেন। তিনি নাজাশী ও তাঁর সভাসদমন্ডলী এবং পোপ-পাদ্রী-বিশপসহ রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। এ সময় নাজাশীর দরবারে জা‘ফরের দেওয়া ভাষণ নাজাশী ও তার সভাসদগণের অন্তর কেড়ে নেয়। ইসলামের সত্যতা ও শেষনবীর উপরে তাদের বিশ্বাস তখনই বদ্ধমূল হয়ে যায়। অতঃপর হাবশার মুহাজিরগণ যখন মদীনায় যাওয়ার সংকল্প করেন, তখন সম্রাট নাজাশী তাদের সাথে ৭০ জনের একটি ওলামা প্রতিনিধি দল মদীনায় প্রেরণ করেন। যাদের মধ্যে ৬২ জন ছিলেন আবিসিনীয় এবং ৮ জন ছিলেন সিরীয়। এরা ছিলেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সেরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। সংসার বিরাগী দরবেশ সূলভ পোষাকে এই প্রতিনিধিদলটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে শুনান। এ সময় তাদের দু’চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। তারা বলে ওঠেন ইনজীলের বাণীর সাথে কুরআনের বাণীর কি অদ্ভূত মিল! অতঃপর তারা সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে রাসূল (সাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন।

প্রতিনিধি দলটির প্রত্যাবর্তনের পর সম্রাট নাজাশী প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেন। যদিও প্রথম থেকেই তিনি শেষনবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু ধর্মনেতাদের ভয়ে প্রকাশ করেননি। অতঃপর তিনি একটি পত্র লিখে স্বীয় পুত্রের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধি দল মদীনায় পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ জাহাযটি পথিমধ্যে ডুবে গেলে আরোহী সকলের মর্মান্তিক সলিল সমাধি ঘটে।

উক্ত খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদলের মদীনায় গমন ও ইসলাম গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত করেই সূরা মায়েদাহ ৮২ হতে ৮৫ চারটি আয়াত নাযিল হয়।[2]

 

 

 

 

[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ তাহকীক : শু‘আইব ও আব্দুল কাদের আরনাঊত্ব (বৈরূত : মুওয়াসসাতুর রিসালাহ ২৯তম মুদ্রণ ১৪১৬/১৯৯৬) ৩/২১ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে রাসূল (সাঃ) থেকে একটি বর্ণনা এনেছেন, إِنَّهُمَا أَوَّلُ بَيْتٍ هَاجَرَ فِي سَبِيْلِ اللهِ بَعْدَ إبراهيمَ ولوطٍ عليهما السلام ‘তারা দু’জন ছিলেন ইবরাহীম ও লূত (আঃ)-এর পরে আল্লাহর রাস্তায় প্রথম হিজরতকারী পরিবার’ (ইবনু ‘আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব ৩৯/২১, আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ)। এর সনদ মুনকার ও ‘খুবই দুর্বল’ (আবু ইসহাক্ব আল-হুওয়াইনী, আন-নাফেলাহ ফিল আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল বাত্বেলাহ হা/৩৩, ১/৫৮ পৃঃ)।

[2]. আলোচনা দ্রষ্টব্য : কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মায়েদাহ ৮২-৮৫ আয়াত; ক্বাছাছ ৫২-৫৪ আয়াত।


Bonolota

106 Blog posts

Comments