রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর মক্কা জীবনী ১৮তম অংশ

নাজাশীর দরবারে কুরায়েশ প্রতিনিধি দল

হাবশায় গিয়ে যাতে মুসলমানগণ শান্তিতে থাকতে না পারে, সেজন্য কুরায়েশ নেতারা তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র করল। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা কুশাগ্রবুদ্ধি কুটনীতিবিদ আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহকে দায়িত্ব দিল। এ দু’জন পরে মুসলমান হন। ১ম জন ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে এবং ২য় জন ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর। আব্দুল্লাহ ছিলেন আবু জাহলের বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই। নাম ছিল বুহায়রা (بُحَيرى)। ইসলাম গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তার নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ’ (ইবনু হিশাম ১/৩৩৩, টীকা-১)।

তারা মহামূল্য উপঢৌকনাদি নিয়ে হাবশা যাত্রা করেন এবং সেখানে গিয়ে প্রথমে খ্রিষ্টানদের নেতৃস্থানীয় ধর্মনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের ক্ষুরধার যুক্তি এবং মূল্যবান উপঢৌকনাদিতে ভুলে দরবারের পাদ্রী নেতারা একমত হয়ে যান। পরের দিন আমর ইবনুল ‘আছ উপঢৌকনাদি নিয়ে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে উপস্থিত হলেন। অতঃপর তারা বললেন, হে বাদশাহ! আপনার দেশে আমাদের কিছু অজ্ঞ-মূর্খ ছেলে-ছোকরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যারা তাদের কওমের দ্বীন পরিত্যাগ করেছে এবং তারা আপনাদের ধর্মেও প্রবেশ করেনি। তারা এমন এক নতুন দ্বীন নিয়ে এসেছে, যা আমরা কখনো শুনিনি বা আপনিও জানেন না। আমাদের কওমের নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে আপনার নিকটে পাঠিয়েছেন, যাতে আপনি তাদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফেরৎ পাঠান’। তাদের কথা শেষ হলে উপস্থিত পাদ্রীনেতাগণ কুরায়েশ দূতদ্বয়ের সমর্থনে মুহাজিরগণকে তাদের হাতে সোপর্দ করার জন্য বাদশাহকে অনুরোধ করেন। তখন বাদশাহ রাগতঃ স্বরে বলেন, আল্লাহর কসম! এটা কখনোই হতে পারে না। তারা আমার দেশে এসেছে এবং অন্যদের চাইতে আমাকে পসন্দ করেছে। অতএব তাদের বক্তব্য না শুনে কোনরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ফলে তাঁর নির্দেশক্রমে জা‘ফর বিন আবু তালিবের নেতৃত্বে মুসলিম প্রতিনিধি দল বাদশাহ্র দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম দিলেন। কিন্তু সিজদা করলেন না। বাদশাহ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা প্রথানুযায়ী আমাকে সিজদা করলে না কেন? যেমন ইতিপূর্বে তোমাদের কওমের প্রতিনিধিদ্বয় এসে করেছে? বাদশাহ আরও বললেন, বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে এমনকি আমাদের ধর্ম গ্রহণ না করে নতুন যে ধর্মে তোমরা দীক্ষা নিয়েছ, সেটা কী, আমাকে শোনাও!’

জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন, হে বাদশাহ! আমাদের ধর্মের নাম ‘ইসলাম’। আমরা স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না। বাদশাহ বললেন, কে তোমাদের এসব কথা শিখিয়েছেন? জা‘ফর বললেন, আমাদের মধ্যেরই একজন ব্যক্তি। ইতিপূর্বে আমরা মূর্তিপূজা ও অশ্লীলতা এবং অন্যায় ও অত্যাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা শক্তিশালীরা দুর্বলদের শোষণ করতাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদের মধ্যে তাঁর শেষনবীকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’। তিনি আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, সংযমশীলতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি গুণাবলী আমরা জানি। নবুঅত লাভের পর তিনি আমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে সর্বাবস্থায় এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছেন। সাথে সাথে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম হতে তওবা করে সৎকর্মশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং এক আল্লাহর ইবাদত করছি ও হালাল-হারাম মেনে চলছি। এতে আমাদের কওমের নেতারা আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আমাদের উপর প্রচন্ড নির্যাতন চালিয়েছেন। সেকারণ বাধ্য হয়ে আমরা সবকিছু ফেলে আপনার রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছি আপনার সুশাসনের খবর শুনে। আমরা অন্যস্থান বাদ দিয়ে আপনাকে পসন্দ করেছি এবং আপনার এখানেই আমরা থাকতে চাই। আশা করি আমরা আপনার নিকটে অত্যাচারিত হব না’।

অতঃপর জাফর বললেন, হে বাদশাহ! অভিবাদন সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের জানিয়েছেন যে, জান্নাতবাসীদের পরস্পরে অভিবাদন হল ‘সালাম’ এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে পরস্পরে ‘সালাম’ করার নির্দেশ দিয়েছেন’।

বাদশাহ বললেন, ঈসা ও তাঁর দ্বীন সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও?

উত্তরে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব সূরা মারিয়ামের শুরু থেকে ৩৬ পর্যন্ত আয়াতগুলি পাঠ করে শুনান। যেখানে হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আঃ)-এর বিবরণ, মারিয়ামের প্রতিপালন, ঈসার জন্মগ্রহণ ও লালন-পালন, মাতৃক্রোড়ে কথোপকথন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। বাদশাহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং তাওরাত-ইনজীলে পন্ডিত ব্যক্তি। কুরআনের অপূর্ব বাকভঙ্গি, শব্দশৈলী ও ভাষালংকার এবং ঘটনার সারবত্তা উপলব্ধি করে বাদশাহ অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকলেন। সাথে উপস্থিত পাদ্রীগণও কাঁদতে লাগলেন। তাদের চোখের পানিতে তাদের হাতে ধরা ধর্মগ্রন্থগুলি ভিজে গেল। অতঃপর নাজাশী বলে উঠলেন, إنَّ هَذَا وَالَّذِي جَاءَ بِهِ عِيسَى لَيَخْرُجُ مِنْ مِشْكَاةٍ وَاحِدَةٍ ‘নিশ্চয়ই এই কালাম এবং ঈসার নিকটে যা নাযিল হয়েছিল দু’টি একই আলোর উৎস থেকে নির্গত’। বলেই তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের দিকে ফিরে বললেন, انْطَلِقَا فَلاَ وَاللهِ لاَ أُسْلِمَهُمْ ‘তোমরা চলে যাও! আল্লাহর কসম! আমি কখনোই এদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না’।

আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহ দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমর বললেন, কালকে এসে এমন কিছু কথা বাদশাহকে শুনাবো, যাতে এদের মূলোৎপাটন হয়ে যাবে এবং এরা ধ্বংস হবে। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বললেন, না, না এমন নিষ্ঠুর কিছু করবেন না। ওরা আমাদের স্বগোত্রীয় এবং নিকটাত্মীয়। কিন্তু আমর ওসব কথায় কর্ণপাত করলেন না।

পরের দিন বাদশাহ্র দরবারে এসে তিনি বললেন, أَيُّهَا الْمَلِكُ إِنَّهُمْ يَقُولُونَ فِى عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ قَوْلاً عَظِيماً ‘হে সম্রাট! এরা ঈসা ইবনে মারিয়াম সম্পর্কে ভয়ংকর সব কথা বলে থাকে’। একথা শুনে বাদশাহ মুসলমানদের ডাকালেন। মুসলমানেরা একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা নাছারারা ঈসাকে উপাস্য মানে। কিন্তু মুসলমানরা তাকে ‘আল্লাহর বান্দা’ (عَبْدُ الله) বলে থাকে। যাই হোক কোনরূপ দ্বৈততার আশ্রয় না নিয়ে তারা সত্য বলার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সত্য প্রকাশ করে দিয়ে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন, هُوَ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ وَرُوحُهُ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إلَى مَرْيَمَ الْعَذْرَاءِ الْبَتُولِ ولم يَمَسُّها بَشَرٌ ‘তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রেরিত রূহ এবং তাঁর নির্দেশ। যা তিনি মহীয়সী কুমারী মাতা মারিয়ামের উপরে ফুঁকে দিয়েছিলেন। কোন পুরুষ লোক তাকে স্পর্শ করেনি’। তখন নাজাশী মাটি থেকে একটা কাঠের টুকরা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, وَاللهِ مَا عَدَا عِيسَى بن مَرْيَمَ مَا قُلْتَ هَذَا الْعُودَ ‘আল্লাহর কসম! তুমি যা বলেছ, ঈসা ইবনে মারিয়াম তার চাইতে এই কাষ্ঠখন্ড পরিমাণও বেশী ছিলেন না’। তিনি জাফর ও তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেন, اذْهَبُوا فَأَنْتُمْ سُيُومٌ بِأَرْضِى- وَالسُّيُومُ الآمِنُونَ، مَنْ سَبَّكُمْ غَرِمَ (ثلاث مرات). مَا أُحِبُّ أَنَّ لِيْ دَبَرًا مِنْ ذَهَبٍ وَأَنِّي آذَيْتُ رَجُلاً مِنْكُمْ ‘যাও! তোমরা আমার দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যে ব্যক্তি তোমাদের গালি দিবে, তার জরিমানা হবে (৩বার)। তোমাদের কাউকে কষ্ট দেওয়ার বিনিময়ে যদি কেউ আমাকে স্বর্ণের পাহাড় এনে দেয়, আমি তা পসন্দ করব না’। অতঃপর তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের প্রদত্ত উপঢৌকনাদি ফেরৎ দানের নির্দেশ দিলেন।

ঘটনার বর্ণনাদানকারিণী প্রত্যক্ষ সাক্ষী হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ) (পরবর্তীকালে উম্মুল মুমেনীন) বলেন, فَخَرَجَا مِنْ عِنْدِهِ مَقْبُوحَيْنِ ...وَأَقَمْنَا عِنْدَهُ بِخَيْرِ دَارٍ، مَعَ خَيْرِ جَارٍ ‘অতঃপর ঐ দু’জন ব্যক্তি চরম বেইযযতির সাথে দরবার থেকে বেরিয়ে গেল... এবং আমরা উত্তম প্রতিবেশীর সাথে উত্তম গৃহবাসীরূপে বসবাস করতে থাকলাম’।[1] ফালিল্লাহিল হাম্দ।

আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, তারা শেষনবীর আবির্ভাবের খবর শুনে ৫০-এর অধিক লোক নিয়ে ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে ইয়ামন থেকে নৌকায় মদীনা রওয়ানা হন। কিন্তু ঝড়ে তাদের নৌকা হাবশায় গিয়ে নোঙর করে। ফলে তারা সেখানে অবতরণ করেন এবং জাফর ও তার সাথীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তারা সেখানেই থেকে যান। পরে জাফরের সাথে তারা ৭ম হিজরীতে খায়বরে এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট হাযির হন। রাবী আবু বুরদাহ বলেন, قال وأبو مُوسَى شَهِدَ مَا جَرَى بَيْنَ جَعْفَرٍ وَبَيْنَ النَّجَاشِيِّ ‘আবু মূসা আশ‘আরী জা‘ফর ও নাজাশীর মধ্যকার আলোচনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন’।[বুখারী হা/৩১৩৬; মুসলিম হা/২৫০২; আবুদাঊদ হা/২৭২৫]

 

 

দ্বিতীয়বার আগমন :

━━━━━━━━━━━━

মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নির্যাতনের ভয়ে সকলে পার্শ্ববতী খ্রিষ্টান রাজ্য হাবশায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়ায় নেতারা প্রমাদ গুণলেন। অতঃপর বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এবং হিজরতকারীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমর ইবনুল ‘আছ ও আবু জাহলের বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহকে নাজাশীর দরবারে প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুহাম্মাদের দাওয়াত একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাকে হত্যা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যেকোন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথে সবচাইতে বড় বাধা হলেন তার চাচা বর্ষীয়ান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় গোত্রনেতা আবু ত্বালিব। ফলে নেতারা পুনরায় আবু তালেবের কাছে এলেন এবং বললেন, আমাদের মধ্যে বয়সে, সম্মানে ও পদমর্যাদায় আপনি বিশেষ স্থানের অধিকারী। আমরা চেয়েছিলাম যে, আপনি আপনার ভাতিজাকে বিরত রাখবেন। কিন্তু আপনি তাকে বিরত রাখেননি। আল্লাহর কসম! আমরা আর এ ব্যক্তির ব্যাপারে ধৈর্য রাখতে পারছি না। কেননা এ ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দিচ্ছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা বলছে, আমাদের উপাস্যদের দোষারোপ করছে’। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন, নয়তো আমরা তাকে ও আপনাকে এ ব্যাপারে একই পর্যায়ে নামাবো। যতক্ষণ না আমাদের দু’পক্ষের একটি পক্ষ ধ্বংস হয়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, الَّذِي قَدْ خَالَفَ دِينَكَ وَدِينَ آبَائِكَ، وَفَرَّقَ جَمَاعَةَ قَوْمِكَ، وَسَفَّهُ أَحْلاَمَهُمْ، فَنَقْتُلَهُ ‘সে আপনার ও আপনার বাপ-দাদাদের দ্বীনের বিরোধিতা করেছে, আপনার সম্প্রদায়ের ঐক্যকে বিভক্ত করেছে এবং তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছে। অতএব আমরা তাকে হত্যা করব’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৭)।

গোত্রনেতাদের এই চূড়ান্ত হুমকি শুনে আবু তালেব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-কে ডেকে এনে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي إنّ قَوْمَك قَدْ جَاءُوْنِي فَقَالُوا لِي كَذَا وَكَذَا ... وَلاَ تُحَمِّلْنِي مِنَ الْأَمْرِ مَا لاَ أُطِيْقُ ‘হে ভাতিজা! তোমার বংশের নেতারা আমার কাছে এসেছিলেন এবং তারা এই এই কথা বলেছেন।... অতএব তুমি আমার উপরে এমন বোঝা চাপিয়ো না, যা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই’। চাচার এই কথা শুনে তিনি তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন ধারণা করে সাময়িকভাবে বিহবল নবী আল্লাহর উপরে গভীর আস্থা রেখে বলে উঠলেন, يَا عَمِّ، وَاللهِ لَوْ وَضَعُوا الشَّمْسَ فِي يَمِينِي، وَالْقَمَرَ فِي يَسَارِي عَلَى أَنْ أَتْرُكَ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يُظْهِرَهُ اللهُ، أَوْ أَهْلِكَ فِيْهِ، مَا تَرَكْتُه ‘হে চাচাজী! যদি তারা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় তাওহীদের এই দাওয়াত বন্ধ করার বিনিময়ে, আমি তা কখনোই পরিত্যাগ করব না। যতক্ষণ না আল্লাহ এই দাওয়াতকে বিজয়ী করেন অথবা আমি তাতে ধ্বংস হয়ে যাই’ বলেই তিনি অশ্রুভরা নয়নে চলে যেতে উদ্যত হলেন। পরম স্নেহের ভাতিজার এই অসহায় দৃশ্য দেখে বয়োবৃদ্ধ চাচা তাকে পিছন থেকে ডাকলেন। তিনি তার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই চাচা বলে উঠলেন, إِذْهَبْ يَا بْنَ أَخِي، فَقُلْ مَا أَحْبَبْتَ، فَوَاللهِ لاَ أُسْلِمُكَ لِشَيْءٍ أَبَدًا ‘যাও ভাতিজা! তুমি যা খুশী প্রচার কর। আল্লাহর কসম! কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে ওদের হাতে তুলে দেব না’।[2] এ সময় তিনি পাঁচ লাইন কবিতার মাধ্যমে স্বীয় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যেমন,

وَاللهِ لَنْ يَصِلُوا إِلَيْكَ بِجَمْعِهِمْ * حَتَّى أُوَسَّدَ فِي التُّرَابِ دَفِينَا

فَامْضِيْ لِأَمْرِكَ مَا عَلَيْكَ غَضَاضَةٌ * أَبْشِرْ وَقَرَّ بِذَاكَ مِنْكَ عُيُونَا

‘আল্লাহর কসম! তারা কখনোই তাদের সম্মিলিত শক্তি নিয়েও তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি মাটিতে সমাহিত হব’। ‘অতএব তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। তোমার উপরে কোন বাধা আসবে না। তুমি খুশী হও এবং এর ফলে তোমার থেকে চক্ষুসমূহ শীতল হৌক’ (আল-বিদায়াহ ৩/৪২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে তাঁর চাচার মাধ্যমে শত্রুদের হাত থেকে হেফাযত করেন। আল্লাহর এই বিধান সকল যুগের নিষ্ঠাবান মুমিনের জন্য সর্বদা কার্যকর।

 

 

রাসূল (সাঃ)-কে দেওয়া আপোষ প্রস্তাবসমূহ : (الاقتراحات المصالحة যিলহজ্জ ৬ষ্ঠ নববী বর্ষ)

━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━

কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কুরায়েশ নেতারা রাসূল (সাঃ)-কে আপোষ প্রস্তাবের ফাঁদে আটকানোর চিন্তা করেন। সে মোতাবেক তারা মক্কার অন্যতম নেতা ওৎবা বিন রাবী‘আহকে সরাসরি রাসূল (সাঃ)-এর কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে পাঠান।

(১) একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কা‘বা চত্বরে একাকী বসেছিলেন। তখন কুরায়েশ নেতাদের অনুমতি নিয়ে ওৎবা তাঁর কাছে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, হে ভাতিজা! তুমি আমাদের গোত্রের মধ্যে কেমন সম্মান ও উচ্চ মর্যাদায় আছ, তা তুমি ভালভাবেই জান। وَإِنَّكَ قَدْ أَتَيْتَ قَوْمَكَ بِأَمْرِ عَظِيمٍ فَرَّقْتَ بِهِ جَمَاعَتَهُمْ وَسَفَّهْتَ بِهِ أَحْلاَمَهُمْ وَعِبْتَ بِهِ آلِهَتَهُمْ وَدِينَهُمْ وَكَفَّرْتَ بِهِ مَنْ مَضَى مِنْ آبَائِهِمْ ‘কিন্তু তুমি তোমার সম্প্রদায়ের নিকটে একটি ভয়ানক বিষয় নিয়ে এসেছ। তুমি তাদের জামা‘আতকে বিভক্ত করেছ। তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছ। তাদের উপাস্যদের ও তাদের দ্বীনকে তুমি মন্দ বলেছ। এই দ্বীনের উপর মৃত্যুবরণকারী তাদের বাপ-দাদাদের তুমি কাফের বলেছ’। অতএব আমি তোমার নিকটে কয়েকটি বিষয় পেশ করছি। এগুলি তুমি ভেবে দেখ, আশা করি তুমি সেগুলির কিছু হলেও মেনে নিবে। জওয়াবে রাসূল (সাঃ) বললেন, বলুন! হে আবু অলীদ, আমি শুনব। তখন তিনি বললেন, হে ভাতিজা! তোমার এই নতুন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য যদি সম্পদ উপার্জন হয়, তাহলে তুমি বললে আমরা তোমাকে সেরা ধনী বানিয়ে দেব। আর যদি তোমার উদ্দেশ্য নেতৃত্ব লাভ হয়, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে দেব। আর যদি আরবের বাদশাহ হতে চাও, তাহলে আমরা তোমাকে বাদশাহ বানিয়ে দেব। আর যদি মনে কর, তোমার মাথার জন্য জিনের চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহলে আমরাই তা আরোগ্যের জন্য সেরা চিকিৎসককে এনে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব এবং সব খরচ আমরাই বহন করব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এমনকি নেতারা এ প্রস্তাবও দিয়েছিল যে, তুমি নারীদের মধ্যে যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিব। আমাদের একটাই মাত্র দাবী, তুমি তোমার ঐ নতুন দ্বীনের দাওয়াত পরিত্যাগ কর’।[3]

জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ৫৪ আয়াত বিশিষ্ট সূরা হা-মীম সাজদাহ পাঠ করে শুনাতে লাগলেন। শুনতে শুনতে ওৎবা মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে গেলেন। এক বর্ণনায় এসেছে, যখন রাসূল (সাঃ) ১৩তম আয়াত পাঠ করলেন, তখন ওৎবা রাসূল (সাঃ)-এর মুখের উপরে হাত চেপে গজব নাযিলের ভয়ে বলে উঠলেন, أَنْشُدُكَ اللهَ وَالرَّحِمَ আল্লাহর দোহাই! তুমি তোমার বংশধরগণের উপরে দয়া কর’। অতঃপর ৩৮তম আয়াতের পর রাসূল (সাঃ) সিজদা করলেন এবং উঠে বললেন, قَدْ سَمِعْتَ يَا أَبَا الْوَلِيدِ مَا سَمِعْتَ فَأَنْت وَذَاكَ ‘আবুল অলীদ আপনি তো সবকিছু শুনলেন। এখন আপনার যা বিবেচনা হয় করুন’। এরপর ওৎবা উঠে গেলেন।

কুরায়েশ নেতারা সাগ্রহে ওৎবার কাছে জমা হলে তিনি বললেন, নেতারা শুনুন! আমি মুহাম্মাদের মুখ থেকে এমন বাণী শুনে এসেছি, যেরূপ বাণী আমি কখনো শুনিনি। যা কোন কবিতা নয় বা জাদুমন্ত্র নয়। সে এক অলৌকিক বাণী। আপনারা আমার কথা শুনুন! মুহাম্মাদকে বাধা দিবেন না। তাকে তার পথে ছেড়ে দিন’। লোকেরা হতবাক হয়ে বলে উঠলো سَحَرَكَ وَاللهِ يَا أَبَا الْوَلِيدِ بِلِسَانِهِ ‘আল্লাহর কসম হে আবুল অলীদ! মুহাম্মাদ তার কথা দিয়ে আপনাকে জাদু করে ফেলেছে’।[4]

(২) একদিন যখন রাসূল (সাঃ) কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফ করছিলেন, তখন আসওয়াদ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এসে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রস্তাব দেন,يَا مُحَمَّدُ، هَلُمَّ فَلْنَعْبُدْ مَا تَعْبُدُ، وَتَعْبُدُ مَا نَعْبُدُ، فَنَشْتَرِكُ نَحْنُ وَأَنْتَ فِي الْأَمْرِ ‘হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা ইবাদত করি, যার তুমি ইবাদত কর এবং তুমি ইবাদত কর, যার আমরা ইবাদত করি। তাতে আমরা ও তুমি আমাদের উপাসনার কাজে পরস্পরে অংশীদার হব’। তখন আল্লাহ সূরা কাফেরূন নাযিল করেন।[5] যাতে কাফেরদের সঙ্গে পুরাপুরি বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করা হয়।

 

 

তৃতীয়বার আবু তালিবের নিকট আগমন : (المرة الثالثة ১০ম নববী বর্ষ)

━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━

হুমকি, লোভনীয় প্রস্তাব ও বয়কট কোনটাতে কাজ না হওয়ায় এবং ইতিমধ্যে আবু তালিবের স্বাস্থ্যহানির খবর শুনে মক্কার নেতারা তৃতীয়বার তাঁর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেন। সেমতে আবু জাহল, আবু সুফিয়ান, উমাইয়া বিন খালাফ, ওৎবা ও শায়বা বিন রাবী‘আহ সহ প্রায় ২৫ জন নেতা আবু তালেবের কাছে আসেন এবং বলেন, হে আবু তালেব! আপনি যে মর্যাদার আসনে আছেন, তা আপনি জানেন। আপনার বর্তমান অবস্থাও আপনি বুঝতে পারছেন। আমরা আপনার জীবনাশংকা করছি। এমতাবস্থায় আপনি ভালভাবে জানেন যা আমাদের ও আপনার ভাতিজার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এক্ষণে আপনি তাকে ডাকুন এবং উভয় পক্ষে অঙ্গীকার নিন যে, সে আমাদের ও আমাদের দ্বীন থেকে বিরত থাকবে এবং আমরাও তার থেকে বিরত থাকব। তখন আবু তালেব রাসূল (সাঃ)-কে ডাকালেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাদের সম্মুখে এসে বললেন, نَعَمْ كَلِمَةٌ وَاحِدَةٌ تُعْطُونِيهَا تَمْلِكُونَ بِهَا الْعَرَبَ، وَتَدِينُ لَكُمْ بِهَا الْعَجَمُ ‘হ্যাঁ, একটি কালেমার ওয়াদা আপনারা আমাকে দিন। তাতে আপনারা আরবের বাদশাহী পাবেন এবং অনারবরা আপনাদের অনুগত হবে’। আবু জাহ্ল খুশী হয়ে বলে উঠল, তোমার পিতার কসম, এমন হলে একটা কেন দশটা কালেমা পাঠ করতে রাজি আছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, تَقُولُونَ: لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ، وَتَخْلَعُونَ مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ- ‘আপনারা বলুন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। আর তাঁকে ছাড়া অন্য যাদের পূজা করেন, সব পরিত্যাগ করুন’।

তখন তারা দু’হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠলো أَتُرِيدُ يَا مُحَمَّدُ أَنْ تَجْعَلَ الْآلِهَةَ إلَهًا وَاحِدًا، إنَّ أَمْرَكَ لَعَجَبٌ! ‘হে মুহাম্মাদ! সব উপাস্য বাদ দিয়ে তুমি একজন উপাস্য চাও? নিশ্চয়ই তোমার এ বিষয়টি বড়ই বিস্ময়কর!’ এরপর তারা পরস্পরে বলল, وَاللهِ مَا هَذَا الرَّجُلُ بِمُعْطِيْكُمْ شَيْئًا مِمَّا تُرِيدُوْنَ ‘আল্লাহর কসম! এই ব্যক্তি তোমাদের কিছুই দিবে না, যা তোমরা চাচ্ছ। অতএব فَانْطَلِقُوا وَامْضُوا عَلَى دِينِ آبَائِكُمْ، حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ- ‘চলো! তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার ধর্মের উপরে চলতে থাক, যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের ও তার মধ্যে একটা ফায়ছালা করে দেন’। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সূরা ছোয়াদের ১ হতে ৭ আয়াতগুলি নাযিল করেন।-

ص، وَالْقُرْآنِ ذِي الذِّكْرِ- بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ عِزَّةٍ وَّشِقَاقٍ- كَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِم مِّنْ قَرْنٍ فَنَادَوْا وَلاَتَ حِيْنَ مَنَاصٍ- وَعَجِبُوْا أَنْ جَاءَهُمْ مُّنْذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ- أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ- وَانْطَلَقَ الْمَلاَ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوْا وَاصْبِرُوْا عَلَى آلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ- مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِيْ الْمِلَّةِ الْآخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلاَّ اخْتِلاَقٌ- (ص 1-7)-

(১) ছোয়াদ- শপথ উপদেশপূর্ণ কুরআনের (২) বরং কাফেররা অহমিকা ও হঠকারিতায় লিপ্ত (৩) তাদের পূর্বেকার কত জনগোষ্ঠীকে আমরা ধ্বংস করেছি। তারা আর্তনাদ করেছে। কিন্তু বাঁচার কোন উপায় তাদের ছিল না (৪) তারা বিস্ময়বোধ করে যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী আগমন করেছেন। আর কাফেররা বলে এতো একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী (৫) সে কি বহু উপাস্যের বদলে একজন উপাস্যকে সাব্যস্ত করে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার (৬) তাদের নেতারা একথা বলে চলে যায় যে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের পূজায় অবিচল থাকো। নিশ্চয়ই (মুহাম্মাদের) এ বক্তব্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত (৭) আমরা তো পূর্বেকার ধর্মে এরূপ কোন কথা শুনিনি। এটা মনগড়া উক্তি বৈ কিছু নয়’ (ছোয়াদ ৩৮/১-৭)।[ইবনু হিশাম ১/৪১৭-১৮; তিরমিযী হা/৩২৩২]

 

 

সর্বশেষ মৃত্যুকালে আগমন : (المرة الأخيرة রজব ১০ম নববী বর্ষ)

━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━

চতুর্থ ও শেষবার নেতারা এসেছিলেন আবু তালিবের মৃত্যুকালে, যেন তিনি তাওহীদের কালেমা পাঠ না করেন ও বাপ-দাদার ধর্মে তথা শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্য। বস্ত্ততঃ একাজে তারা সফল হয়েছিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর শত আকুতি উপেক্ষা করে সেদিন আবু তালেব আবু জাহ্লের কথায় সায় দিয়ে শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যথাস্থানে তার আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ (দ্রঃ ১৮০ পৃঃ)।

 

 

 

 

[1]. ইবনু হিশাম ১/৩৩৩-৩৮; আহমাদ হা/১৭৪০; যাদুল মা‘আদ ৩/২৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১১৫, সনদ সহীহ। প্রাচ্যবিদ মার্গোলিয়থ (১৮৫৮-১৯৪০) নাজাশীর ইসলাম কবুল করায় খুবই অস্বস্তি বোধ করেছেন। ফলে ঘটনাটি সরাসরি অস্বীকার করতে না পেরে তাঁর লিখিত নবী জীবনী (১৫৮ পৃঃ)-তে অন্যতম জীবনীকার নোলডেক (১৮৩৬-১৯৩০)-এর দোহাই দিয়ে এই সংশয় ব্যক্ত করেছেন যে, আরব ও আবিসিনীয়গণ যে পরস্পরের কথা বুঝতে পারত, তার কোন প্রমাণ নেই’ (মোস্তফা চরিত ৩৬১ পৃঃ)। অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিতে ঘটনাটি অস্বীকার করতে চেয়েছেন। এটাই হল তথাকথিত বস্ত্তনিষ্ঠ (!) ইতিহাসের নমুনা।

[2]. ইবনু হিশাম ১/২৬৫-৬৬। (১) প্রসিদ্ধ এ বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২৬৬; যঈফাহ হা/৯০৯)। তবে উক্ত মর্মের অন্য বর্ণনাটি ‘হাসান’। যেখানে বলা হয়েছে, রাসূল (সাঃ) আকাশের দিকে চোখ উঠিয়ে চাচাদের উদ্দেশ্যে বললেন,أَتَرَوْنَ هَذِهِ الشَّمْسَ؟ قَالُوا: نَعَمْ، قَالَ: مَا أَنَا بَأَقْدَرِ عَلَى أَنْ أَدَعَ لَكُمْ ذَلِكَ أَنْ تَشتعِلُوا لِي مِنْهَا بِشُعْلَةٍ، فَقَالَ أَبُو طَالِبٍ: مَا كَذَبَنَا ابْنُ أَخِي فَارْجِعُوا- ‘আপনারা কি এই সূর্যকে দেখছেন? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি আপনাদের কারণে আমার দাওয়াত পরিত্যাগ করব না, যতক্ষণ না আপনারা ঐ সূর্য থেকে আমার জন্য একটা স্ফুলিঙ্গ এনে দিবেন’। তখন আবু ত্বালিব বললেন, আমার ভাতিজা কখনোই আমাদেরকে মিথ্যা বলে না। অতএব তোমরা ফিরে যাও’ (হাকেম হা/৬৪৬৭); সহীহাহ হা/৯২; মা শা-‘আ ৩০ পৃঃ। (২) ইবনু ইসহাক এখানে নেতাদের তৃতীয় আরেকটি প্রতিনিধি দলের আগমনের কথা বলেছেন। যা রীতিমত বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য। তিনি সূত্রবিহীনভাবে লিখেছেন যে, নেতারা মক্কার ধনীশ্রেষ্ঠ ও অন্যতম নেতা অলীদ বিন মুগীরাহ্র পুত্র উমারাহ বিন অলীদ (عُمارة)-কে সাথে নিয়ে গেলেন এবং আবু ত্বালিবকে বললেন, হে আবু ত্বালিব! এই ছেলেটি হল কুরায়েশদের সবচেয়ে সুন্দর ও ধীমান যুবক। আপনি একে পুত্ররূপে গ্রহণ করুন এবং মুহাম্মাদকে আমাদের হাতে সোপর্দ করুন’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৬-৬৭; আর-রাহীক্ব ৯৭-৯৮ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ’ (মা শা-‘আ ৩২ পৃঃ)। নিঃসন্দেহে এটি অবাস্তবও বটে।

[3]. ইবনু হিশাম ১/২৯৩-৯৪, সনদ ‘মুরসাল’ হাদীছ ‘হাসান’ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ২৮৩); ইবনু জারীর, তাফসীর সূরা কাফেরূন, ৩০/২১৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪-৫ আয়াত।

[4]. ইবনু হিশাম ১/২৯৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৫ আয়াত; ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১০৭; সনদ হাসান।

[5]. ইবনু হিশাম ১/৩৬২ ‘সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ’; আলবানী, ছহীহুস সীরাহ ২০১-২০২ পৃঃ।


Bonolota

106 Blog posts

Comments