রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর মক্কা জীবনী ১৯তম অংশ

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ-৩

(১) আল্লাহ অনেক সময় শক্তিশালী অন্য কোন ব্যক্তিকে সত্যসেবীদের সহায়তার জন্য দাঁড় করিয়ে দেন। হাবশার খ্রিষ্টান বাদশা তার বাস্তব প্রমাণ।

 

(২) কুরআন যে নিঃসন্দেহে আল্লাহর কালাম এবং তার শব্দশৈলী ও ভাষালংকার যে অবিশ্বাসীদের হৃদয়কেও ছিন্ন করে, কা‘বা চত্বরে সূরা নাজম পাঠ শেষে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাথে কাফেরদের সিজদায় পড়ে যাওয়া তার অন্যতম প্রমাণ।

 

(৩) মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে কুরআনী সত্য প্রকাশ করায় যে আল্লাহর রহমত নেমে আসে, নাজাশীর সম্মুখে জাফর বিন আবু তালিবের ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত সত্যভাষণ তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ বহন করে।

 

(৪) রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও দরবারী আলেমরা যে ঘুষখোর ও দুনিয়াপূজারী হয়, নাজাশী দরবারের পোপ-পাদ্রীরা তার অন্যতম উদাহরণ।

 

(৫) মিথ্যাচার যে অবশেষে ব্যর্থ হয়, কুরায়েশ দূত আমর ইবনুল ‘আছের কূটনীতির ব্যর্থতা তার বাস্তব প্রমাণ।

 

(৬) দুনিয়াপূজারী নেতারা নির্লোভ সংস্কারকদের নিজেদের মত করে ভাবতে চায়। তারা একে ক্ষমতা ও নেতৃত্ব হাছিলের আন্দোলন বলে ধারণা করে। যেমন তারা রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াত সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল- ‘নিশ্চয়ই মুহাম্মাদের এ দাওয়াত বিশেষ কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ (ছোয়াদ ৩৮/৬)। আর সেকারণ তারা লোভনীয় প্রস্তাব সমূহের ডালি নিয়ে সংস্কারকের সম্মুখে হাযির হয়। যাতে তার ফাঁদে পড়ে সংস্কার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় অথবা তাতে ভাটা পড়ে। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনে যেমনটি ঘটেছে, তাঁর সনিষ্ঠ অনুসারী সংস্কারকদের জীবনেও যুগে যুগে তেমনটি ঘটবে এবং এটাই স্বাভাবিক।

 

(৭) বাতিলপন্থী নেতারা হক-এর দাওয়াতের যথার্থতা স্বীকার করে। তারা কুরআনকে সত্য কিতাব হিসাবে মানে। কিন্তু দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে অন্ধ করে রাখে। যেমন বিশেষভাবে ওৎবা বিন রাবী‘আহ্র ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

 

(৮) কায়েমী স্বার্থবাদী নেতারা সংস্কারকের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ ২টি অভিযোগ দাঁড় করিয়ে থাকে। এক- পিতৃধর্ম ও রেওয়াজের বিরোধিতা এবং দুই- সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করা। যেমন কুরায়েশ নেতারা এসে আবু তালেবের নিকটে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে উক্ত অভিযোগগুলি করেছিল।

 

(৯) নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাসের মাধ্যমে দুনিয়া জয় করা সম্ভব, তার ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছিল রাসূল (সাঃ)-এর পবিত্র যবানে আবু জাহলদের সম্মুখে ১০ম নববী বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে এবং তার সফল বাস্তবায়ন ঘটেছিল তার ১১ বছর পরে ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে। অতঃপর খলীফাদের যুগে আরব-আজমের সর্বত্র ইসলামী খেলাফতের একচ্ছত্র বিজয় সাধনের মাধ্যমে।

 

(১০) তাওহীদের কালেমা চির বিজয়ী শক্তি। যা কখনোই পরাজিত হয় না। প্রয়োজন কেবল দক্ষ ও সাহসী নেতা এবং আনুগত্যশীল সাহসী অনুসারী দল।

উমরের ইসলাম গ্রহণ

(৬ষ্ঠ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাস)

হামযার ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিন দিন পরেই আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আরেকজন কুরায়েশ বীর উমর ইবনুল খাত্ত্বাব আকস্মিকভাবে মুসলমান হয়ে যান। ওয়াক্বেদীর হিসাব মতে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর এবং তখন মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৫৬ জন। যাদের মধ্যে ১০ বা ১১ জন ছিলেন নারী। এটি ছিল হাবশায় প্রথম হিজরতের পরের ঘটনা।[ইবনু হিশাম ১/৩৪২; সীরাহ সহীহাহ ১/১৭৭ পৃঃ] ইবনু কাছীর বলেন, উমরকে দিয়ে মুসলমানের সংখ্যা ৪০ পূর্ণ হয়, কথাটি সঠিক নয়। কেননা তার পূর্বে ৮০ জনের উপরে মুসলমান হাবশায় হিজরত করেছিল। তবে এটি হতে পারে যে, দারুল আরক্বামে গিয়ে ইসলাম কবুল করার সময়ে সেখানে মুসলিম নারী-পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪০-এর কাছাকাছি (আল-বিদায়াহ ৩/৭৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে ৩৯ জন (ঐ, ৩০ পৃঃ)। ফলে সেদিন উমরকে দিয়ে ৪০ পূর্ণ হয়।

তিনি যে আগে থেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তার প্রমাণ হিসাবে বলা যায় যে, হাবশা যাত্রী মহিলা মুহাজির উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে আবু হাছমাহ (أبو حَثْمَة) বলেন, আমরা হাবশা যাত্রার প্রস্তুততি নিচ্ছিলাম। আমার স্বামী ‘আমের তখন প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে ছিলেন। এমন সময় উমর ইবনুল খাত্ত্বাব এলেন। তখন তিনি মুশরিক ছিলেন। বললেন, এগুলি মনে হয় চলে যাওয়ার প্রস্তুততি? বললাম, হ্যাঁ। আমরা অবশ্যই আল্লাহর যমীনে বেরিয়ে যাব। তোমরা আমাদের কষ্ট দিচ্ছ ও নির্যাতন করছ। নিশ্চয়ই আল্লাহ একটা পথ বের করে দিবেন’। তখন উমর বললেন, صَحِبَكُمُ اللهُ ‘আল্লাহ তোমাদের সাথী হৌন’! এদিন আমি তাকে অত্যন্ত দুঃখিত ও সংবেদনশীল দেখতে পাই’।[ইবনু হিশাম ১/৩৪২-৪৩; আল-বিদায়াহ ৩/৭৭; সীরাহ সহীহাহ ১/১৭৭ পৃঃ] রাবী আব্দুল্লাহ বিন ‘আমের জ্যেষ্ঠ তাবেঈ ছিলেন। যিনি প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তার মায়ের সূত্রে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী তার সমালোচনা করেননি। ইবনু হিববান তার বিশুদ্ধতার সাক্ষ্য দিয়েছেন’।[সীরাহ সহীহাহ, টীকা-১, ১/১৭৮ পৃঃ] তবে হাফেয ইবনু হাজার বলেন, বোন ফাতেমার গৃহে প্রবেশ ও তার নিকট থেকে কুরআন শ্রবণ তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রত্যক্ষ কারণ হতে পারে।[বুখারী, ফাৎহসহ হা/৩৮৬২] কিন্তু উক্ত বিষয়ে বর্ণিত প্রসিদ্ধ ঘটনাটির সনদ ‘যঈফ’।[1]

এছাড়াও মতনে বৈপরিত্য আছে। যেমন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কুরায়েশ নেতারা তাকে পাঠিয়েছিলেন। কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি নিজ থেকে গিয়েছিলেন’ (ইবনু সা‘দ, দারাকুৎনী)। কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি বোনের ঘরে সূরা ত্বোয়াহা ও সূরা তাকভীর ১৪ আয়াত পর্যন্ত পড়েছিলেন’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৫)। কোন বর্ণনায় এসেছে সূরা হাদীদ’ পড়েছিলেন (বায়হাক্বী, দালায়েল হা/৫১৮)। অথচ সূরা হাদীদ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে বায়তুল্লাহতে রাসূল (সাঃ)-এর সালাত অবস্থায় সূরা হা-ক্কাহ শুনে তার অন্তরে ইসলাম দৃঢ় হয়’ (আহমাদ হা/১০৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি রাতের বেলা কা‘বার গেলাফের মধ্যে লুকিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সালাতের ক্বিরাআত শুনছিলেন। তিনি বলেন, এমন কথা আমি কখনো শুনিনি। অতঃপর রাসূল (সাঃ) বেরিয়ে গেলে আমি তাঁর পিছু নেই। তখন তিনি বললেন, কে? আমি বললাম, উমর। তিনি বললেন, হে উমর! দিনে-রাতে কখনোই তুমি আমার পিছু নিতে ছাড়ো না’। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে, উনি আমাকে বদ দো‘আ করতে পারেন। তখন আমি কালেমা শাহাদাত পাঠ করলাম। রাসূল (সাঃ) বললেন, يَا عُمَرُ، اُسْتُرْهُ ‘হে উমর! এটি গোপন রাখ’। আমি বললাম, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই প্রকাশ করব, যেভাবে শিরক প্রকাশ করতাম’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৭৭৫৪)। বর্ণনাগুলি সবই যঈফ’ (মা শা-‘আ ৫৭ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, দুর্বল সূত্র সমূহের আধিক্য সবসময় কোন বর্ণনার শক্তি বৃদ্ধি করেনা। বরং অনেক সময় তার দুর্বলতাই বৃদ্ধি করে। মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন’ (মা শা-‘আ ৫৯ পৃঃ)।

আমরা মনে করি উমরের ইসলাম গ্রহণ ছিল রাসূল (সাঃ)-এর বিশেষ দো‘আর ফল। কেননা তিনি তাঁর জন্য খাছভাবে দো‘আ করেছিলেন, اللهُمَّ أَعِزَّ الإِسْلاَمَ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ‘হে আল্লাহ! তুমি উমর ইবনুল খাত্ত্বাব-এর মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী কর’।[হাকেম হা/৪৪৮৫; আহমাদ হা/৫৬৯৬; ইবনু মাজাহ হা/১০৫] অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللهُمَّ أَعِزَّ الإِسْلاَمَ بِأَحَبِّ هَذَيْنِ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ بِأَبِى جَهْلٍ أَوْ بِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ‘হে আল্লাহ! আবু জাহল অথবা উমর ইবনুল খাত্ত্বাব এই দুই ব্যক্তির মধ্যে যিনি তোমার নিকট অধিক প্রিয়, তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর’।[তিরমিযী হা/৩৬৮১, হাদীছ সহীহ] পরের দিন সকালে উমর দারুল আরক্বামে এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে ইসলাম কবুল করেন এবং কা‘বাগৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে সালাত আদায় করেন’।[আহমাদ হা/৫৬৯৬; তিরমিযী হা/৩৬৮১; মিশকাত হা/৬০৩৬] এতে প্রমাণিত হয় যে, উমরই ছিলেন আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয় ব্যক্তি।[2]

তবে এটা নিশ্চিত যে, উমর ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং আরবী ভাষালংকারে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ফলে কুরআনের সারগর্ভ ও আকর্ষণীয় বাকভঙ্গি এবং ক্বিয়ামত ও জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনাসমূহ তাঁর হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। যা তাকে ইসলামের দিকে চুম্বকের মত টেনে আনে। সর্বোপরি রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আ তাঁর শানে কবুল হওয়ায় তিনি দ্রুত এসে ইসলাম কবুল করেন।

 

 

উমরের ইসলাম পরবর্তী ঘটনা :

━━━━━━━━━━━━━━━━━━━

ইসলাম কবুলের পরপরই তিনি ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহলের গৃহে গমন করেন এবং তার মুখের উপরে বলে দেন, جِئْتُ لِأُخْبِرَكَ أَنِّي قَدْ آمَنْتُ بِاللهِ وَبِرَسُولِهِ مُحَمَّدٍ، وَصَدَّقْتُ بِمَا جَاءَ بِهِ ‘আমি তোমার কাছে এসেছি এ খবর দেওয়ার জন্য যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের উপরে ঈমান এনেছি এবং তিনি যে শরী‘আত এনেছেন, আমি তা সত্য বলে জেনেছি’। একথা শুনেই আবু জাহল সরোষে তাকে গালি দিয়ে বলে ওঠেন, قَبَّحَكَ اللهُ، وَقَبَّحَ مَا جِئْتَ بِهِ ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যে খবর নিয়ে এসেছ, তার মন্দ করুন’। অতঃপর তার মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে যান।[3]

পুত্র আব্দুল্লাহ বিন উমর বালক অবস্থায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বলেন, এরপর উমর গেলেন সে সময়ের সেরা মাউথ মিডিয়া জামীল বিন মা‘মার আল-জুমাহীর (جميل بن معمر الجمحي) কাছে এবং তাকে বললেন যে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি’। সে ছিল কুরায়েশ বংশের সেরা ঘোষক এবং অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী। গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ তার মাধ্যমেই সর্বত্র প্রচার করা হত। উমর (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর শোনামাত্র সে বেরিয়ে পড়ল। আর চিৎকার দিয়ে সবাইকে শুনাতে থাকল, أَلاَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ قَدْ صَبَأَ ‘শুনে রাখো, খাত্ত্বাবের পুত্র উমর ধর্মত্যাগী হয়ে গেছে’। উমর (রাঃ) তার পিছনেই ছিলেন। তিনি বললেন, كَذَبَ، وَلَكِنِّي قَدْ أَسْلَمْتُ ‘সে মিথ্যা বলেছে। বরং আমি মুসলমান হয়েছি’। একথা শোনা মাত্র চারিদিক থেকে লোক জমা হয়ে গেল এবং সকলে উমরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণপিটুনী শুরু করল। এই মারপিট দুপুর পর্যন্ত চলল। এ সময় কাফিরদের উদ্দেশ্যে উমর (রাঃ) আল্লাহর কসম দিয়ে বলেন, لَوْ قَدْ كُنَّا ثَلاَثَ ماِئَةِ رَجُلٍ لَقَدْ تَرَكْنَاهَا لَكُمْ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا لَنَا ‘যদি আমরা আজ সংখ্যায় তিনশ’ পুরুষ হতাম, তবে দেখতাম মক্কায় তোমরা থাকতে, না আমরা থাকতাম’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৯)।

এই ঘটনার পর নেতারা উমরকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাড়ী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। উমর (রাঃ) ঘরের মধ্যেই ছিলেন। এমন সময় তাদের গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ বনু সাহম গোত্রের জনৈক নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল সাহ্মী সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। উমর (রাঃ) তাকে বললেন, আমি মুসলমান হয়েছি বিধায় আপনার সম্প্রদায় আমাকে হত্যা করতে চায়’। তিনি বলে উঠলেন, لاَ سَبِيلَ إِلَيْكَ ‘কখনোই তা হবার নয়’। বলেই তিনি সোজা চলে গেলেন জনতার সামনে। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে জটলা করছ কেন? তারা বলল, هَذَا ابْنَ الْخَطَّابِ الَّذِى صَبَأَ ‘ইবনুল খাত্ত্বাব ধর্মত্যাগী হয়ে গেছে’। তিনি বললেন, لاَ سَبِيلَ إِلَيْهِ ‘যাও! সেখানে যাবার কোন প্রয়োজন নেই’। তার কাছে একথা শুনে লোকেরা ফিরে গেল।(বুখারী হা/৩৮৬৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, مَا كُنَّا نَقْدِرُ عَلَى أَنْ نُصَلِّيَ عِنْدَ الْكَعْبَةِ، حَتَّى أَسْلَمَ عُمَرُ، فَلَمَّا أَسْلَمَ قَاتَلَ قُرَيْشًا حَتَّى صَلَّى عِنْدَ الْكَعْبَةِ، وَصَلَّيْنَا مَعَهُ- ‘উমর ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত আমরা কা‘বাগৃহে সালাত আদায়ে সক্ষম হইনি। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর কুরায়েশদের সাথে লড়াই করেন ও কা‘বাগৃহে সালাত আদায় করেন এবং আমরা তাঁর সাথে সালাত আদায় করি’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪২)। তিনি আরও বলেন, مَا زِلْنَا أَعِزَّةً مُنْذُ أَسْلَمَ عُمَرُ ‘উমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমরা সর্বদা শক্তিশালী ছিলাম’ (বুখারী হা/৩৬৮৪)। উমর (রাঃ) যখন আততায়ীর দ্বারা আহত হন, তখন ইবনু আববাস (রাঃ) তাঁর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যখন আপনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তখন আপনার ইসলাম ছিল শক্তিশালী। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে ইসলামকে, আল্লাহর রাসূলকে ও তাঁর সাথীদেরকে বিজয়ী করেন’।[ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৫৭৯, হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৪৬৩]

 

 

বনু হাশিম ও বনু মুত্ত্বালিব গোত্রের প্রতি আবু ত্বালিবের আহবান :

━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━

হামযা ও উমর (রাঃ)-এর পরপর মুসলমান হয়ে যাওয়ায় কুরায়েশরা দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে এতে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দ ও সাহসের সঞ্চার হলেও দূরদর্শী ও স্নেহশীল চাচা আবু ত্বালিবের বুকটা ভয়ে সব সময় দুরু দুরু করত কখন কোন মুহূর্তে শয়তানেরা আকস্মিকভাবে মুহাম্মাদকে হামলা করে মেরে ফেলে। সবদিক ভেবে তিনি একদিন স্বীয় প্রপিতামহ ‘আব্দে মানাফের দুই পুত্র হাশেম ও মুত্ত্বালিবের বংশধরগণকে একত্রিত করলেন। অতঃপর তাদের সামনে বললেন, এতদিন আমি এককভাবে ভাতিজা মুহাম্মাদের তত্ত্বাবধান করেছি। কিন্তু এখন এই চরম বার্ধক্যে ও প্রচন্ড বৈরী পরিবেশে আমার পক্ষে এককভাবে আর মুহাম্মাদের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব নয়। সেকারণ আমি তোমাদের সকলের সহযোগিতা চাই’।

গোত্রনেতা আবু ত্বালিবের এই আহবানে ও গোত্রীয় আকর্ষণে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন এবং মুহাম্মাদের হেফাযতের ব্যাপারে সবাই একযোগে তাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। একমাত্র চাচা আবু লাহাব বিরোধিতা করল এবং সে মুহাম্মাদের বিপক্ষ দলের প্রতি সমর্থন দানের ঘোষণা দিল’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৯; আর-রাহীক্ব ১০৮ পৃঃ)।

 

 

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :

━━━━━━━━━━━━━

(১) সংস্কার আন্দোলনে অগ্রগতির জন্য শক্তিশালী ও সাহসী পুরুষের অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী আন্দোলনে এজন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রয়োজন হয়। হামযা ও উমরের ইসলাম গ্রহণ ছিল রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আ ও আল্লাহর বিশেষ রহমতের প্রতিফলন।

(২) মানুষের ইচ্ছার বাইরে আল্লাহর ইচ্ছাই যে বাস্তবায়িত হয়, হামযা ও উমরের ইসলাম গ্রহণ তার বাস্তব প্রমাণ। তাদের দু’জনের কেউই ইসলাম গ্রহণের জন্য বের হননি। ঘটনাক্রমে দু’জনেই আকস্মিকভাবে মুসলমান হয়ে যান।

(৩) দল শক্তিশালী হলে বিরোধিতাও শক্তিশালী হবে এবং মূল নেতার উপরে চূড়ান্ত হামলা হবে- এটা সর্বদা উপলব্ধি করতে হবে দলের সহযোগী নেতৃবৃন্দকে। আবু তালিবের দূরদর্শী সিদ্ধান্তে আমরা সেটাই দেখতে পাই।

 

 

 

 

[1]. মা শা-‘আ ৫৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৩৪৩-৪৮; বোনের ঘটনাটি বর্ণনা শেষে রাবী ইবনু ইসহাক বলেন, فَهَذَا حَدِيثُ الرُّوَاةِ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ عَنْ إسْلاَمِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ حِينَ أَسْلَمَ ‘এটিই হল উমরের ইসলাম গ্রহণকালের ঘটনা সম্পর্কে মদীনাবাসী বর্ণনাকারীদের বক্তব্য’। অতঃপর কা‘বাগৃহে রাত্রিবেলায় সালাতরত অবস্থায় গোপনে রাসূল (সাঃ)-এর ক্বিরাআত শুনে বিগলিত উমর সাথে সাথে ইসলাম কবুল করেন এবং রাসূল (সাঃ) তার বুকে হাত মেরে ঈমানের উপর তার দৃঢ় থাকার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন’ বলে ঘটনাটি বর্ণনা শেষে রাবী ইবনু ইসহাক বলেন, وَاللهُ أَعْلَمُ أَيَّ ذَلِكَ كَانَ ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত কোন্টি ঘটেছিল’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৮)।

[2]. এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে, لَمَّا أَسْلَمَ عُمَرُ نَزَلَ جِبْرِيلُ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ لَقَدِ اسْتَبْشَرَ أَهْلُ السَّمَاءِ بِإِسْلاَمِ عُمَرَ ‘যখন উমর ইসলাম কবুল করেন, তখন জিব্রীল অবতরণ করেন এবং বলেন, হে মুহাম্মাদ! উমরের ইসলাম গ্রহণে আসমানবাসীগণ খুবই খুশী হয়েছেন’ (ইবনু মাজাহ হা/১০৩)। আলবানী বলেন, হাদীছটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল (ضَعِيْفٌ جِدًّا)। উল্লেখ্য যে, উমরের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তার কোনটিও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়’ (মা শা-‘আ ৫৪ পৃঃ)। ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) উমরের ইসলাম গ্রহণের আকর্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা শেষে বলেন, هذا حديث حسن الألفاظ، ضعيف السند ‘এটি সুন্দর শব্দময় বর্ণনা, কিন্তু সনদ দুর্বল’ (মা শা-‘আ ৫৯ পৃঃ, গৃহীত : আত-তামহীদ ২৪/৩৪৭)।

[3]. ইবনু হিশাম ১/৩৫০। উমরের পরিবারের কোন এক ব্যক্তির সূত্রে ইবনু ইসহাক এটি বর্ণনা করেছেন, তার নাম উল্লেখ না করায় বর্ণনাটি যঈফ।


Bonolota

106 Blog posts

Comments