হযরত মোহাম্মদ সাঃ নাম করন ও খাৎনা

নিয়ম নিতি মেনে হযরত মোহাম্মদ সাঃয়ের নামমকরন করা হয় ও খাৎনা।

আব্দু মানাফ, হাশেম ও আব্দুল মুত্ত্বালিবঃ কুছাই-পুত্র আব্দু মানাফের প্রকৃত নাম ছিল মুগীরাহ। তাঁর ৪টি পুত্র সন্তান ছিল : হাশেম, প্রকৃত নাম আমর। আব্দু শাম্স, মুত্ত্বালিব ও নওফাল। হাশেম ও মুত্ত্বালিবকে সৌন্দর্যের কারণে ‘দুই পূর্ণচন্দ্র’ (الْبَدْرَان) বলা হ’ত (ইবনুল আছীর)।

 

  হাশেমের ৪ পুত্র ছিল : আব্দুল মুত্ত্বালিব, আসাদ, আবু ছায়ফী ও নাযলাহ। আব্দুল মুত্ত্বালিবের ছিল ১০টি পুত্র ও ৬টি কন্যা।

 

  পুত্রগণের মধ্যে আববাস, হামযাহ, আব্দুল্লাহ, আবু ত্বালিব, যুবায়ের, হারেছ, হাজলা, মুক্বাউভিম, যেরার ও আবু লাহাব। কন্যাদের মধ্যে ছাফিয়া, বায়যা, আতেকাহ, উমাইমাহ, আরওয়া ও বার্রাহ’। ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, যুবায়ের ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর বড় চাচা। তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ছাহাবী ছিলেন। তাঁর সমর্থনেই নবুঅত লাভের ২০ বছর পূর্বে ‘হিলফুল ফুযূল’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে’ (ইবনু হিশাম ১/১০৬-০৮, ১/১৩৩ টীকা-১)।

 

  তবে ইবনু ইসহাক বলেন, স্বপ্নে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে যমযম কূপ খননের সময় আব্দুল মুত্ত্বালিবের সাথে তাঁর পুত্র হারেছ ছিলেন। কারণ তিনি ব্যতীত তখন তাঁর অন্য কোন পুত্র সন্তান ছিল না’ (ইবনু হিশাম ১/১৪৩)। এতে বুঝা যায় যে, হারেছ-ই আব্দুল মুত্ত্বালিবের প্রথম পুত্র ছিলেন।

আবু ত্বালিবঃ আবু ত্বালিবের নাম ছিল আব্দু মানাফ। কিন্তু তিনি আবু ত্বালিব নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ৪ পুত্র ও ২ কন্যা ছিল : ত্বালিব, ‘আক্বীল, জা‘ফর ও আলী। ত্বালিব ‘আক্বীলের চাইতে দশ বছরের বড় ছিলেন।[1] তাঁর মৃত্যুর অবস্থা জানা যায় না। বাকী সকলেই ছাহাবী ছিলেন। দুই কন্যা উম্মে হানী ও জুমানাহ দু’জনেই ইসলাম কবুল করেন’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৭৫-৮৩ পৃঃ)।

 

  আব্দুল মুত্ত্বালিবের পরে আবু ত্বালিব বনু হাশিমের নেতা হন। তিনি আমৃত্যু রাসূল (ছাঃ)-এর অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বয়কটকালের তিন বছরসহ সর্বদা বনু মুত্ত্বালিব ও বনু হাশিম রাসূল (ছাঃ)-এর সহযোগী ছিলেন। যদিও আবু ত্বালিব ও অন্য অনেকে ইসলাম কবুল করেন নি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ ছিলেন।

 

  ১. যারা তাঁর উপরে ঈমান এনেছিলেন ও তাঁর সাথে জিহাদ করেছিলেন। যেমন হামযাহ ও আববাস (রাঃ)।

 

  ২. যারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন আবু ত্বালিব।

 

  ৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু অবধি শত্রুতা করেন। যেমন আবু লাহাব। উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান ছিলেন বনু ‘আব্দে শামস গোত্রের, আবু জাহল ছিলেন বনু মাখযূম গোত্রের এবং উমাইয়া বিন খালাফ ছিলেন বনু জুমাহ গোত্রের। যদিও সকলেই ছিলেন কুরায়েশ বংশের অন্তর্ভুক্ত এবং সবাই ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর সম্পর্কীয় চাচা।

 

[1]. ইবনু সা‘দ ১/৯৭। উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ)-এর বড় ভাই ত্বালিব বিন আবু ত্বালিব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও জনৈক কুরায়েশ নেতার সাথে বাদানুবাদের প্রেক্ষিতে প্রত্যাবর্তনকারীদের সাথে মক্কায় ফিরে যান (ইবনু হিশাম ১/৬১৯)। তিনি বদরের যুদ্ধে বিজয় লাভে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসা করে এবং নিহত নেতাদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে কবিতা বলেন’ (ইবনু হিশাম ২/২৬)। ইবনু সা‘দ বলেন, অন্যান্যদের সাথে তিনিও বদর যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর যখন কুরায়েশরা পরাজিত হয়, তখন তাঁকে নিহত বা বন্দীদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। তিনি মক্কায়ও ফিরে যাননি। তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁর কোন সন্তানাদিও ছিল না’ (ইবনু সা‘দ ১/৯৭)। অতএব তিনি ঈমান এনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না

খাৎনা ও নামকরণঃ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়।[1] পিতৃহীন নবজাতককে কোলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বাগৃহে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দো‘আ করেন।

 

  আকীকার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, ‘মুহাম্মাদ’। এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা বিস্ময়ভরে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে, আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হৌক (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৪১)।

 

  ওদিকে স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৩৯)। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং ‘সর্বাধিক প্রশংসিত’।[2]

 

[1]. যাদুল মা‘আদ ১/৮০-৮১। খাৎনা ও আক্বীক্বা করার বিষয়টি যে আরবদের মাঝে পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল, তা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত (বুখারী হা/৭, আবুদাঊদ হা/২৮৪৩)। তবে রাসূল (ছাঃ)-এর খাৎনা যে সপ্তম দিনেই হয়েছিল (আর-রাহীক্ব ৫৪ পৃঃ) একথার কোন প্রমাণ নেই (ঐ, তা‘লীক্ব ৩৯-৪৪ পৃঃ)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর খাৎনা সম্পর্কে তিনটি কথা চালু আছে। ১. তিনি খাৎনা ও নাড়ি কাটা অবস্থায় ভূমিষ্ট হয়েছিলেন। ইবনুল জাওযী এটাকে মওযূ‘ বা জাল বলেছেন। ২. হালীমার গৃহে থাকার সময় প্রথম বক্ষবিদারণকালে ফেরেশতা জিব্রীল তাঁর খাৎনা করেন। ৩. দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁকে সপ্তম দিনে খাৎনা করান ও নাম রাখেন এবং লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়ান। এগুলি সম্পর্কে যেসব বর্ণনা এসেছে, তার কোনটিই ছহীহ নয়। এ বিষয়ে বিপরীতমুখী দু’জন মুহাক্কিকের একজন কামালুদ্দীন বিন ‘আদীম বলেন, আরবদের রীতি অনুযায়ী তাঁকে খাৎনা করা হয়েছিল। এটি এমন একটি রীতি, যা প্রমাণের জন্য কোন নির্দিষ্ট বর্ণনার প্রয়োজন নেই’ (যাদুল মা‘আদ ১/৮০-৮১)।

 

[2]. উভয় নামই কুরআনে এসেছে। যেমন ‘মুহাম্মাদ’ নাম এসেছে চার জায়গায়। যথাক্রমে- সূরা আলে ইমরান ৩/১৪৪, আহযাব ৩৩/৪০; মুহাম্মাদ ৪৭/২ এবং ফাৎহ ৪৮/২৯। তাছাড়া ‘মুহাম্মাদ’ নামেই একটি সূরা নাযিল হয়েছে সূরা মুহাম্মাদ (৪৭ নং সূরা)।

 

অনুরূপভাবে ‘আহমাদ’ নাম এসেছে এক জায়গায় (ছফ ৬১/৬)। সীরাতে ইবনু হিশামের ভাষ্যকার সুহায়লী (মৃ. ৫৮১ হি.) বলেন, ঐ সময় সারা আরবে মাত্র তিনজন ব্যতীত অন্য কারু নাম ‘মুহাম্মাদ’ ছিল বলে জানা যায় না। যাদের প্রত্যেকের পিতা তার পুত্র আখেরী নবী হবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। যাদের একজন হ’লেন বিখ্যাত উমাইয়া কবি ফারাযদাক্ব (৩৮-১১০ হি.)-এর প্রপিতামহ মুহাম্মাদ বিন সুফিয়ান বিন মুজাশি‘। অন্যজন হলেন মুহাম্মাদ বিন উহাইহাহ বিন জুলাহ। আরেকজন হলেন মুহাম্মাদ বিন হুমরান বিন রাবী‘আহ। এদের পিতারা বিভিন্ন সম্রাটের দরবারে গিয়ে জানতে পারেন যে, আখেরী নবী হেজাযে জন্মগ্রহণ করবেন। ফলে তারা মানত করে যান যে, তাদের পুত্র সন্তান হ’লে যেন তার নাম ‘মুহাম্মাদ’ রাখা হয় (ইবনু হিশাম ১/১৫৮ -টীকা-১)।


Salma Akter

233 Blog posts

Comments