মৌরীফুল 3

বড়দের রোম্যান্টিক গল্প, ধারাবাহিক/ পার্ট-০৩

[পার্ট০২, শেষ অংশ হতে....]

 

বেলা নয়টার সময় ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন—সুশীলা স্নান করিয়া আসিয়া রৌদ্রে কাপড় মেলিয়া দিতেছে, গৃহিণী মোক্ষদাসুন্দরী রান্নাঘরে বসিয়া রাঁধিতেছেন। স্বামীকে দেখিয়াই মোক্ষদা চৌকিদার হাঁকার সুরে বলিতে লাগিলেন—হয় আমি একদিকে বেরিয়ে যাই, না-হয় বাপু এর বিহিত করো। সেই সকাল থেকে ঘুরপাক দিয়ে দিয়ে বেড়াচ্ছে, বলছি—ও বউমা, দুটো ভাত চড়িয়ে দাও, ওগো যা হয় দুটো-কিছু রাঁধো—হাতে-পায়ে ধরতে কেবল বাকি রেখেছি। কার কথা কে শোনে?—এই বেলা-দুপুরের সময় রানি এখন এলেন নেয়ে…

সুশীলা রক হইতেই সমান গলায় উত্তর দিল—মাইনে করা দাসী তো নই, আমি যখন পারব রান্না চড়াব—সকাল থেকে বসে আছি নাকি? এত খাটুনি সেরে আবার আটটার মধ্যে ভাত দেব—মানুষের তো আর শরীর নয়—যার না-চলবে সে নিজে গিয়ে বেঁধে নিক।…

একথার উত্তরে মোক্ষদা খুন্তি হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় আসিয়া নটরাজ শিবের তাণ্ডব নর্তনের একটা আধুনিক সংস্করণ শুরু করিতে যাইতেছিলেন—একটা ঘটনায় তাহা বন্ধ হইয়া গেল।

একটা দশ-বারো বৎসরের ছেলে, রংটা বড়োই কালো, ম্যালেরিয়ায় শরীর জীর্ণ শীর্ণ, পরনে অতিময়লা এক গামছা, শীতের দিনেও তাহার গায়ে কিছু নাই, হাতে ছোটো একটা বাখারির ছড়ি লইয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিল। ছেলেটি পাশের গ্রামের আতর আলি ঘরামির ছেলে, গতবৎসর তার বাপ মারা গিয়াছে, দুটি ছোটো ছোটো বোন আর মা ছাড়া তার আর কেহ নাই।

অবস্থা খুব খারাপ, সবদিন খাওয়া জোটে না, ছেলেটা পিঠে ছড়ি বাজাইয়া হাপু গাহিয়া মা ও বোন দুটিকে প্রতিপালন করে। সে এ-গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে আসিত কিন্তু মুখুয্যে-বাড়ি আর কখনো আসে নাই। তাহার একটা কারণ এই যে, দানশীলতার জন্য রামতনু মুখুয্যে গ্রামের মধ্যে আদৌ প্রসিদ্ধ ছিলেন না।

ছেলেটি উঠোনে দাঁড়াইয়া বগল বাজাইয়া নানারূপ সুর করিয়া উচ্চৈ:সুরে হাপু গাহিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে পিঠে জোর করিয়া লাঠির বাড়ি মারিতে লাগিল।

তিনটি নেহাত গোবেচারি সাক্ষীর তালিম দিতে অনেক ধস্তাধস্তি করিয়া রামতনুর মেজাজ ভালো ছিল না, ফিরিয়া চাহিয়া দেখিয়া মুখ খিঁচাইয়া বলিলেন— থাম—থাম ও-সব রাখ—এখন ও-সব দেখবার শখ নেই—যা অন্য বাড়ি দেখগে যা—যা…

সুশীলা কাপড় মেলিয়া দিতে দিতে অবাক হইয়া হাপু গাওয়া দেখিতেছিল— ছেলেটি সংকুচিত হইয়া বাহিরে যাইতেই সে তাড়াতাড়ি বাহিরের রকে গিয়া তাহাকে ডাকিয়া বলিল— শোন, তোর বাড়ি কোথায় রে?

—হরিপুর মা-ঠাকরুন।

—তোর বাড়িতে কে আছে আর?

—মোর বাপ মারা গিয়েছে আর-বছর মা-ঠাকরুন—মোদের আর কেউ নাই, মুই বড়ো, ছোটো দুটো বোন আছে…

–তাই বুঝি তুই হাপু গাস? হ্যাঁ রে, এতে চলে?

রামতনুর ধমক খাইয়া ছেলেমানুষ অত্যন্ত দমিয়া গিয়াছিল, সুশীলার কথার ভিতর সহানুভূতির সুর চিনিয়া লইয়া হঠাৎ তাহার কান্না আসিল—চোখের জল হু হু করিয়া পড়িতেই ম্যালেরিয়া-শীর্ণ হাতটি তুলিয়া চোখ মুছিয়া বলিল—না মা ঠাকরুন, চলে না। এসব লোকে আর দেখতে চায় না। মুই যদি ভালো গান গাইতে পারতাম তো যাত্রার দলে যাতাম, বড়ো কষ্ট মোদের সংসারে—এই শীতি মা ঠাকরুন…

সুশীলা বাধা দিয়া বলিল—দাঁড়া, আমি আসছি।

ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া কান্নার বেগ অতিকষ্টে সামলাইয়া চাহিয়া দেখিল আলনায় একখানা নতুন মোটা বিছানার চাদর ঝুলিতেছে, হাতের গোড়ায় সেইখানা পাইয়া টানিয়া লইল। তারপর জানালা দিয়া বাড়ির মধ্যে চাহিয়া দেখিয়া চাদরখানা তাড়াতাড়ি ছেলেটির হাতে দিয়া চুপি চুপি বলিল—এইখানা নিয়ে যা, এতে শীত বেশ কাটবে। কাটবে না? খুব মোটা। শিগগির যা, কেউ যেন না-দেখে…

ছেলেটা চাদর হাতে হতবুদ্ধি হইয়া ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া সুশীলা বলিল— ওরে এক্ষুনি কে এসে পড়বে, শিগগির যা…

ছেলেটাকে বিদায় দিয়া সুশীলা ভিতর-বাড়িতে ঢুকিয়া দেখিল শ্বশুর আহার করিতে বসিয়াছেন। ছেলেটার দুঃখে সুশীলার মন খুব নরম হইয়া গিয়াছিল সে গিয়া রান্নাঘরে ঢুকিয়া কাজে মন দিল, শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করিল—আপনাকে কিছু দেব বাবা?

মোক্ষদা ঝংকার দিয়া উঠিলেন—তোমাকে আর কিছু দিতে হবে না, যে মিষ্টি বচন দিয়েছ তাতেই প্রাণ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, নাও এখন পারো তো এদিকে এসো একবার, হাঁড়িটা দেখো, নয় তো বলো নিজে মরি-বাঁচি একরকম করে সাঙ্গ করে তুলি।

রামতনু কোনো কথা বলিলেন না, আপন মনে খাইয়া উঠিয়া চলিয়া গেলেন। এইসব ব্যাপারেই সুশীলা অত্যন্ত চটিয়া যাইত, রামতনু পুত্রবধূর নিকট কোনো জিনিস চাহিয়া খাইলে তাহার রাগ গলিয়া জল হইয়া যাইত, কিন্তু লোকে তাহাকে জব্দ করিতেছে অপমান করিবার ফন্দি খুঁজিতেছে ভাবিলে তাহার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকিত না, সেও কোমর বাঁধিয়া রণে আগুয়ান হইত। সেই বা ছাড়িবে কেন?

মাস-দুই পরে।

ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি, কিন্তু বেশ গরম পড়িয়াছে। কিশোরী অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরিয়াছে। বাড়িতে যে-যাহার ঘরে ঘুমাইতেছে। সে নিজের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল সুশীলা ঘরের মেঝেয় বসিয়া একখানা চিঠি লিখিতেছে। কিশোরী সুশীলাকে জিজ্ঞাসা করিল—কাকে চিঠি লেখা হচ্ছে?

সুশীলা চিঠির কাগজখানা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়া চাপিয়া স্বামীর দিকে ফিরিয়া একটু দুষ্টামির হাসি হাসিল, বলিল—বলো কেন?

-–থাক, না বলো, ভাত দাও। রাত কম হয়নি। আবার সকাল থেকেই খাটুনি আরম্ভ হবে।

সুশীলা ভাবিয়াছিল স্বামী আসিয়া সে কি লিখিতেছে দেখিবার জন্য পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিবে। প্রকৃতপক্ষে সে চিঠি কাহাকেও লিখিতেছে না, স্বামীকে কথা বলাইবার এ তার একটা পুরোনো কৌশল মাত্র। অনেক দিন সে স্বামীর মুখে দুটো ভালো কথা শুনে নাই, তাহার নারীহৃদয় ইহারই জন্য তৃষিত ছিল এবং ইহারই জন্য সে ঘুমে ঢুলিতে ঢুলিতেও এই সামান্য ফাঁদটি পাতিয়া বসিয়া ছিল—কিন্তু কিশোরী ফাঁদে পা দেওয়া দূরে থাকুক, সেদিকে ঘেঁষিলও না দেখিয়া সুশীলা বড়ো নিরুৎসাহ হইয়া পড়িল।

কাগজ-কলম তুলিয়া রাখিয়া সে স্বামীর ভাত বাড়িয়া দিল। একপ্রকার চুপচাপ অবস্থায় আহারাদি শেষ করিয়া কিশোরী গিয়া শয্যা আশ্রয় করিবার পর, সে নিজে আহারাদি করিয়া শুইতে গিয়া দেখিল কিশোরী ঘুমায় নাই, গরমে এপাশ-ওপাশ করিতেছে। আশায় বুক বাঁধিয়া সে তাহার দ্বিতীয় ফাঁদটি পাতিল।

—একটা গল্প বলো না? অনেকদিন তো বলোনি, বলবে লক্ষ্মীটি…


Fahad Alim

19 Blog posts

Comments