[পার্ট 03, শেষ অংশ হতে.....]
বিবাহের পর প্রথম কিশোরী তাহার স্ত্রীর নিকট বটতলার আরব্য উপন্যাস হইতে নানা গল্প বলিত। রাত্রির পর রাত্রি তখন এসব গল্প শুনিয়া সুশীলা মুগ্ধ হইয়া যাইত। জনহীন দেশের মধ্যে যেখানে শুধু জিন-পরিদের জগৎ… খেজুর বনের মধ্যে ঠান্ডা জলের ফোয়ারা হইতে মণিমুক্তা উৎক্ষিপ্ত হইতেছে…পথহীন দুরন্ত মরুপ্রান্তরে মৃত্যু যেখানে শিকার সন্ধানে ওঁত পাতিয়া বসিয়া আছে, সমুদ্রের ঝড়…তরুণ শাহজাদাগণের দৈত্যসংকুল অরণ্যের মাঝখান দিয়া নির্ভীক শিকারযাত্রা—এসব শুনিতে শুনিতে তাহার গা শিহরিয়া উঠিত, ঘুম ভাঙিলে ঘরের মধ্যে অর্ধরাত্রির অন্ধকার বিকটাকার জীবদেহের ভিড়ে ভরিয়া গিয়াছে মনে করিয়া ভয়ে সে স্বামীকে জড়াইয়া ধরিত।
প্রাচীন যুগের তরুণ শাহজাদাদের কল্পনা করিতে গিয়া অজ্ঞাতসারে সে নিজের স্বামীকে যাত্রার দলের রাজার পোশাক পরাইয়া দূরদেশে বিপদের মুখে পাঠাইত, শাহজাদাদিগের দুঃখে তাহার নিজের স্বামীর উপর সহানুভূতিতেই তাহার চোখে জল আসিত। এইরকমে গল্প শুনিতে শুনিতে অদৃশ্য নায়ক-নায়িকাদের গুণ দৃশ্যমান গল্পাকারের উপরে প্রয়োগ করিয়া সে স্বামীকে প্রথম ভালোবাসে। সে আজ পাঁচ-ছয় বৎসরের কথা, কিন্তু সুশীলার এখনও সে ঘোর কাটে নাই।
কিশোরী স্ত্রীর কথা উড়াইয়া দিল—হ্যাঁ, এখন গল্প বলো! সমস্ত দিন খেটেখুটে এলাম, এখন রাতদুপুরে বকবক করি আর কি। তোমাদের কী? বাড়ি বসে’ সব পোষায়।
অন্য মেয়ে হইলে চুপ করিয়া যাইত। সুশীলার মেজাজ ছিল একগুঁয়ে। সে আবার বলিল, তা হোক, একটা বলো, রাত এখন তো বেশি নয়…
—না বেশি নয়—তোমার তো রাত কম-বেশির জ্ঞান কত! নাও, চুপচাপ শুয়ে পড়ো এখন…
সুশীলা এইবার জিদ ধরিল—বলো না একটা, ছোটো দেখেই না-হয় বলো— এত করে বলছি একটা কথা রাখতে পারো না?
কিশোরী বিরক্ত হইয়া বলিল—আ :! এ তো বড়ো জ্বালা হল! রাতেও একটু ঘুমুবার জো নেই—সমস্ত দিন তো গলাবাজিতে বাড়ি সরগরম রাখবে, রাত্তিরটাও একটু শান্তি নেই?
এইটাই ছিল সুশীলার ব্যথার স্থান। স্বামীর মুখে এ কথা শুনিয়া সে ক্ষেপিয়া গেল—বেশ করি গলাবাজি করি, তাতে অসুবিধা হয় আমাকে পাঠিয়ে দাও এখান থেকে—রাতদুপুর করলে কে! নিজে আসবেন রাতদুপুরের সময় আড্ডা দিয়ে কে এত রাত পর্যন্ত ভাত নিয়ে বসে থাকে? নিজেরই দেহ, পরের আর তো দেহ না! খেটেখুটে এসে একেবারে রাজা করেছেন আর কি? নিজের খাটুনিটাই কেবল…
কিশোরী ঘুমাইবার চেষ্টা পাইতেছিল, স্ত্রীর উত্তরোত্তর চড়া সুরে তাহার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল—উঠিয়া বসিয়া প্রথমে সে স্ত্রীর পিঠে সজোরে ঘা-কতক পাখার বাঁট বসাইল, তাহার পর তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া বিছানার উপর হইতে নামাইয়া ধাক্কা মারিয়া ঘরের বাহির করিয়া দিল, বলিল—বেরো, ঘর থেকে বেরো, আপদ
—দূর হ—রাতদুপুরেও একটু শান্তি নেই—যা বেরো—যেখানে খুশি যা…