[পার্ট 04, শেষ অংশ হতে....]
ঘরের আলোর কাছে আসিয়া কিশোরী দেখিল স্ত্রী দুই হাতের নখ দিয়া আঁচড়াইয়া তাহার হাতের আঙুলগুলিতে রক্তপাত করিয়া দিয়াছে।
ইরানি শাহজাদাগণের নজির না-থাকিলেও কিশোরী মধ্যে মধ্যে দুরন্ত স্ত্রীর প্রতি এরূপ ঔষধি প্রয়োগ করিত।
শেষরাত্রে একাদশীর জ্যোৎস্নায় চারিদিক যখন ফুলের পাপড়ির মতো সাদা, ভোর রাত্রের বাতাস নেবু-ফুলের গন্ধে আর পাপিয়ার গানে মাখামাখি, সুশীলা তখন ঘরের দোরের বাহিরে আঁচল পাতিয়া অকাতরে ঘুমাইতেছিল।
সকাল হইলে যে-যার কাজে মন দিল। মোক্ষদা বলিলেন—বউমা, আজ চৌধুরীরা শিবতলায় পুজো দিতে যাবে, আমাদের যেতে বলেছে, সকাল-সকাল সেরে নাও।
এই চৌধুরীটি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে রামতনু মুখুয্যের প্রতিপালক, হঁহারাই গ্রামের জমিদার এবং ইহাদেরই জমিজমা সংক্রান্ত মোকদ্দমার তদবির ও সাহায্য করিয়া রামতনু অন্নসংস্থান করিতেন।
বেলা দশটার মধ্যে আহারাদি শেষ করিয়া ভালো কাপড় পরিয়া সকলে নৌকায় উঠিল— দুই ঘণ্টার পথ। চৌধুরী-বাড়িতে কলিকাতা হইতে একটি বউ আসিয়াছিল। তাহার স্বামী বড়োলোকের ছেলে এম-এ পাস করিয়া বছর-দুই হইল ডেপুটিগিরি চাকরি পাইয়াছে। বউটি কলিকাতার মেয়ে, চৌধুরীদের সহিত তাহার স্বামীর কীরূপ সম্পর্ক আছে, এজন্য চৌধুরীগৃহিণী রাসপূর্ণিমার সময় তাহাকে আনাইয়াছিলেন।
ইতিপূর্বে সে কখনো পাড়াগাঁয়ে আসে নাই। নৌকায় খানিকটা বসিয়া থাকিবার পর বউটি দেখিল, নীলাম্বরী কাপড় পরনে তাহারই সমবয়সি আর-একটি বউ নৌকায় উঠিল। নৌকা ছাড়িয়া দিল, নৌকায় সমবয়সি সঙ্গিনী পাইয়া কলিকাতার বউটি খুব সন্তুষ্ট হইলেও প্রথমে আলাপ করিতে বাধ-বাধ ঠেকিতে লাগিল। সঙ্গিনীর কাপড়চোপড় পরিবার আগোছাল ধরন দেখিয়া বউটি বুঝিয়াছিল তাহার সঙ্গিনী নিতান্ত পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, অবস্থাও খুব ভালো নয়। নৌকার ওধারে চৌধুরীগৃহিণী মোক্ষদার সহিত সাবিত্রী-ব্রত প্রতিষ্ঠার কী আয়োজন করিয়াছেন, তাহারই বিস্তৃত বড়োমানুষি ফর্দ আবৃত্তি করিতেছিলেন।
নৌকায় কোনো পরিচিত মেয়েও নাই, কাজেই বউটি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বউটি লেখাপড়া জানিত এবং দেশ-বিদেশের খবরাখবরও কিছু কিছু রাখিত— চৌধুরীগৃহিণীর একঘেয়ে বড়োমানুষি চালের কথাবার্তায় সে বড়ো বিরক্ত হইয়া উঠিল। খানিকক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর সে লক্ষ করিল তাহার সঙ্গিনী ঘোমটার ভিতর হইতে কালো-কালো ডাগর চোখে তাহার দিকে সকৌতুকে চাহিতেছে। বউটির হাসি পাইল, জিজ্ঞাসা করিল—তোমার নাম কী ভাই?
সুশীলা সন্দিগ্ধ সুরে বলিল—শ্রীমতী সুশীলাসুন্দরী দেবী।