মৌরীফুল 8

বড়দের রোম্যান্টিক গল্প, ধারাবাহিক/ পার্ট-০৮

[পার্ট ০৭, শেষ অংশ হতে........]

 

তাহার হাতে একটি সোনার আংটি ছিল, ইহা তাহার মায়ের দেওয়া আংটি, বিবাহের পর প্রথম তাহার মা তাহার হাতে এটি পরাইয়া দিয়াছিলেন। সেটি হাত হইতে খুলিয়া সে সঙ্গিনীর হাত ধরিয়া বলিল—দেখি ভাই তোমার আঙুল, তুমি হলে মৌরীফুল, তোমায় খাওয়াবার কথা, কাপড় দেওয়ার কথা—এই আংটিটা আমার মায়ের দেওয়া, তোমায় দিলাম, তবু এটা দেখে তুমি গরিব মৌরীফুলকে ভুলে যাবে না।

সুশীলা আংটিটা সঙ্গিনীর হাতে পরাইয়া দিতে গেল,—বউটি চট করিয়া হাত টানিয়া লইয়া বলিল—দূর পাগল! না ভাই এ রাখখা—তোমার মায়ের দেওয়া

আংটি—এ কেন আমায় দিতে যাবে? না ভাই…

সুশীলা জোর করিতে গেল—হোক ভাই, দেখি—মায়ের দেওয়া বলেই… বউটি বলিল—দূর! না ভাই ও-সব রাখখা—সে বরং…

সুশীলা খুব হতাশ হইল। মুখটি তাহার অন্ধকার হইয়া গেল—সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। গ্রামের ঘাটে নৌকা লাগিল। বউটি সুশীলার হাত ধরিয়া বলিল— পায়ে পড়ি ভাই মৌরীফুল, রাগ কোরো না। আচ্ছা, কেন তুমি শুধু শুধু তোমার মায়ের দেওয়া আংটি আমায় দিতে যাবে ভাই? আচ্ছা, তুমি যদি দিতেই চাও, এই পুজোর সময় আসব—অন্য কিছু বরং দিয়ো—একদিন না-হয় খাইয়ো—আংটি কেন দেবে ভাই!—আর আমায় ভুলবে না তো ভাই?

সুশীলা ব্যগ্রভাবে বলিল—তোমায় ভুলব না ভাই মৌরীফুল! কখখোনন না— তুমি কোন জন্মে যে আমার মায়ের পেটের বোন ছিলে ভাই মৌরীফুল…

তাহার পরে সে একটু আনাড়ি ধরনে হাসিয়া উঠিল—হিঃ হিঃ হিঃ! কেমন সুন্দর কথাটি—মৌরীফুল—মৌরীফুল—মৌরীফুল—তুমি যে হলে গিয়ে আমার নদীর ধারের মৌরীফুল—তোমায় কি ভুলতে পারি?…

কথা শেষ না-করিয়াই সে দুই হাতে সঙ্গিনীর গলা জড়াইয়া ধরিল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার কালো চোখ দুটি জলে ভরিয়া গেল।

কলিকাতার বড়ো এই অদ্ভুত প্রকৃতির সঙ্গিনীর অশ্রুপ্লাবিত সুন্দর মুখখানা বার বার সস্নেহে চুম্বন করিল—তারপর দুজনেই চোখের জলে ঝাপসাদৃষ্টি লইয়া দুজনের কাছে বিদায় লইল।…

দিন কতক কাটিয়া গেল। কিশোরী বাটী নাই, কী-একটা কাজে অন্য গ্রামে। গিয়াছে, ফিরিতে দু-একদিন দেরি হইবে। মোক্ষদা সকালে উঠিয়া জমিদার-গৃহিণীর আহ্বানে তাঁহার সাবিত্রী-ব্ৰত-প্রতিষ্ঠার আয়োজনে সাহায্য করিতে চৌধুরী-বাড়ি চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন—বউমা আমার ফেরবার কোনো ঠিক নেই, রান্না-বান্না করে রেখো, আমি আজ আর কিছু দেখতে পারব না, চৌধুরী-বাড়ির কাজ—কখন মেটে বলা যায় না।

এ কথা মোক্ষদার না-বলিলেও চলিত। কারণ ভোরে উঠিয়া বাসন-মাজা, জল তোলা হইতে আরম্ভ করিয়া এ সংসারের সমস্ত কাজের ভারই ছিল সুশীলার উপর। এ সংসারে কিশোরীর বিবাহের পর কোনোদিন ঝি-চাকর প্রবেশ করে নাই —যদিও পূর্বে বাড়িতে বরাবরই একজন করিয়া ঝি থাকিত। সুশীলার খাটুনিতে কোনো ক্লান্তি ছিল না, খাটিবার ক্ষমতা তাহার যথেষ্ট ছিল—যখন মেজাজ ভালো থাকিত, তখন সমস্ত দিন নীরবে ভূতের মতো খাটিয়াও সে বিরক্ত হইত না।

শাশুড়ি চলিয়া গেলে অন্যান্য কাজকর্ম সারিয়া সুশীলা রান্নাঘরে গিয়া দেখিল একখানিও কাঠ নাই। কাঠ অনেক দিনই ফুরাইয়া গিয়াছে, এ কথা সুশীলা বহুবার শ্বশুরকে জানাইয়াছে। রামতনু মধ্যে মধ্যে মজুর ডাকাইয়া কাঠ কাটাইয়া লইতেন, এবার কিন্তু অনেক দিন হইল তিনি আর এদিকে দৃষ্টি দেন নাই, কিশোরীর দোষ নাই, কেননা সে বড়ো একটা বাড়িতে থাকিত না, সংসারের সংবাদ তেমন রাখিতও না।

আসল কথা হইতেছে এই যে রান্নাঘরের পিছনে খিড়কির বাহিরে অনেক শুকনা বাঁশ ও ডালপালা পড়িয়া আছে—সুশীলা রান্না চড়ানোর পূর্বে বা রান্না করিতে করিতে প্রয়োজন মতো এগুলি দা দিয়া কাটিয়া লইয়া কাজ চালাইত। রামতনু দেখিলেন, কাজ যখন চলিয়া যাইতেছে তখন কেন অনর্থক কাঠ কাটিবার লোক ডাকিয়া আনা—আনিলেই এখনই একটা টাকা খরচ তো? পুত্রবধূ বকিতেছে বকুক, কারণ বকুনিই উহার স্বভাব।


Fahad Alim

19 Blog posts

Comments