বক্ষবিদারণ পর্যালোচনা

হযরত মোহাম্মদ সাঃ বক্ষবিদারণ পর্যালোচনা

বক্ষ বিদারণঃ দ্বিতীয় দফায় হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদের সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। ব্যাপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে কিছু দূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন। অতঃপর কলীজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দেন এবং বলেন, هَذَا حَظُّ الشَّيْطَانِ مِنْكَ ‘এটি তোমার মধ্যেকার শয়তানের অংশ’। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান।

 

  পুরা ব্যাপারটি খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালীমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। তিনি ছুটে এসে দেখেন যে, মুহাম্মাদ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে’।[1] হালীমা তাকে বুকে তুলে বাড়ীতে এনে সেবা-যত্ন করতে থাকেন। এই অলৌকিক ঘটনায় হালীমা ভীত হয়ে পড়েন এবং একদিন তাঁকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে যান। তখন তার বয়স ছিল ছয় বছর। তাঁর দ্বিতীয়বার বক্ষবিদারণ হয় মি‘রাজে গমনের পূর্বে মক্কায়।[2]

 

[1]. মুসলিম হা/১৬২, আনাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৫৮৫২ ‘নবুঅতের নিদর্শন সমূহ’ অনুচ্ছেদ।

 

[2]. বুখারী হা/৩৮৮৭, ৩৪৯; মুসলিম হা/১৬৪, ১৬৩; মিশকাত হা/৫৮৬২, ৫৮৬৪, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।

বক্ষবিদারণ পর্যালোচনাঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বক্ষবিদারণ সম্পর্কে শী‘আগণ ও অন্যান্য আপত্তিকারীগণ মূলতঃ তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। (১) বক্ষবিদারণের ঘটনাটি মানব প্রকৃতির বিরোধী (২) এটি জ্ঞান ও যুক্তি বিরোধী (৩) এটি আল্লাহর সৃষ্টিবিধান পরিবর্তনের শামিল।

 

  এর জবাবে বলা যায় :

 

  (১) শৈশবে বক্ষবিদারণের বিষয়টি ভবিষ্যত নবুঅতের আগাম নিদর্শন।

 

  (২) শৈশবে ও মি‘রাজ গমনের পূর্বে বক্ষবিদারণের ঘটনা অন্ততঃ ২৫ জন ছাহাবী কর্তৃক অবিরত ধারায় বর্ণিত ছহীহ হাদীছসমূহ দ্বারা প্রমাণিত (ইবনু কাছীর, তাফসীর ইসরা ১ আয়াত)। অতএব এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

 

  (৩) যাবতীয় মানবীয় কলুষ থেকে পরিচ্ছন্ন করা। যাকে ‘শয়তানের অংশ’ বলা হয়েছে। এটা তাঁর জন্য খাছ এবং পৃথক একটি বৈশিষ্ট্য।

 

  (৪) প্রত্যেক নবীরই কিছু মু‘জেযা থাকে। সে হিসাবে এটি শেষনবী (ছাঃ)-এর বিশেষ মু‘জেযা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে মানবীয় জ্ঞানের কোন প্রবেশাধিকার নেই।

 

  (৫) শেষনবী ও শ্রেষ্ঠনবী হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ও বিশেষ ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত ছিলেন। অতএব বক্ষবিদারণের ঘটনা সাধারণ মানবীয় রীতির বিরোধী হ’লেও তা আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি কৌশলের অধীন। যেমন শিশুকালে মূসা (আঃ) সাগরে ভেসে গিয়ে ফেরাঊনের গৃহে লালিত-পালিত হন’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯)। ঈসা (আঃ) মাতৃক্রোড়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে বাক্যালাপ করেন’ (মারিয়াম ১৯/৩০-৩৩) ইত্যাদি।

 

  দুঃখের বিষয় স্কটিশ প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মূর (১৮১৯-১৯০৫) তাঁর লিখিত নবীজীবনী Life of Mahomet (1857 & 1861) গ্রন্থে বক্ষবিদারণের এ ঘটনাটিকে মূর্ছা (Epilepsy) রোগের ফল বলেছেন। শৈশব থেকেই এ রোগগ্রস্ত হওয়ার কারণে তিনি মাঝে-মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। অতঃপর সেই বিকারের মধ্যে তিনি মনে করতেন যে, আল্লাহর নিকট থেকে তিনি বাণী প্রাপ্ত হয়েছেন (নাঊযুবিল্লাহ)।[1] জার্মান প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩) আরেকটি অদ্ভুত তথ্য পেশ করেছেন যে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিবি আমেনার কণ্ঠদেশে ও বাহুতে এক এক খন্ড লোহা ঝুলানো ছিল’। এর দ্বারা তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তিনি মৃগীরোগী ছিলেন’ (ঐ, ২৪০ পৃঃ)।

 

  উইলিয়াম মূর মুহাম্মাদকে চঞ্চলমতি প্রমাণ করার জন্য একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, ‘পাঁচ বছর বয়সে মায়ের নিকট রেখে যাওয়ার জন্য হালীমা তাকে নিয়ে মক্কায় আসছিলেন। কাছাকাছি আসার পর বালকটি হঠাৎ হালীমার সঙ্গছাড়া হয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন আব্দুল মুত্ত্বালিব তার কোন ছেলেকে পাঠিয়ে দেখেন যে, বালকটি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর তিনি তাঁকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যান’। কেবল মূর নন বৃটিশ প্রাচ্যবিদ স্যামুয়েল মার্গোলিয়থ (১৮৫৮-১৯৪০) লিখেছেন, পিতৃহীন এই বালকের অবস্থা মোটেও প্রীতিকর ছিল না। মুহাম্মাদের শেষ বয়সে তাঁর চাচা হামযা (মাতাল অবস্থায়) তাকে নিজ পিতার দাস বলে বিদ্রুপ করেছিলেন’ (ঐ, ২৫৮-৫৯ পৃঃ)। মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) বলেন, এই শ্রেণীর বিদ্বেষ-বিষ জর্জরিত অসাধু লোকদিগের কথার প্রতিবাদ করিয়া শ্রম ও সময়ের অপব্যয় করা উচিৎ নহে’ (ঐ, ২৪০ পৃঃ)।

 

[1]. মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত (ঢাকা : ঝিনুক পুস্তিকা ১৯৭৫), ২৫০ পৃঃ।


Salma Akter

233 Blog posts

Comments