বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত যে, সকল নবীই নিষ্পাপ ছিলেন। আর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) নবী হওয়ার আগে ও পরে যাবতীয় কুফরী থেকে এবং অহী প্রাপ্তির পরে কবীরা গোনাহের সংকল্প থেকেও নিষ্পাপ ছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে ছগীরা গোনাহ জায়েয ছিল। তাঁদের এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, কুফরী ও কবীরা গোনাহ থেকে তিনি নবুঅত লাভের পূর্ব হ’তেই নিষ্পাপ ছিলেন। যেমন
(১) তিনি কুরায়েশদের নিয়ম অনুযায়ী হজ্জের সময় কখনো তাদের সাথে মুযদালিফায় অবস্থান করেননি। বরং অন্যদের সাথে আরাফাতে অবস্থান করতেন। তাঁকে সেখানে দেখে একবার জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম আশ্চর্য হয়ে বলে উঠেছিলেন, وَاللهِ مِنَ الْحُمْسِ فَمَا شَأْنُهُ هَا هُنَا ‘আল্লাহর কসম! এ তো হুম্স-দের সন্তান। তার কি হয়েছে যে, সে এখানে অবস্থান করছে?[1]
(২) তিনি কখনো মূর্তি স্পর্শ করেননি। একবার তিনি স্বীয় মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহকে নিয়ে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করছিলেন। সে সময় যায়েদ মূর্তিকে স্পর্শ করলে তিনি তাকে নিষেধ করেন। দ্বিতীয়বার যায়েদ আরেকটি মূর্তিকে স্পর্শ করেন বিষয়টির নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। তিনি পুনরায় তাকে নিষেধ করেন। এরপর থেকে নবুঅত লাভের আগ পর্যন্ত যায়েদ কখনো মূর্তি স্পর্শ করেননি। তিনি কসম করে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনোই মূর্তি স্পর্শ করেননি। অবশেষে আল্লাহ তাকে অহী প্রেরণের মাধ্যমে সম্মানিত করেন।[2]
(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনোই মূর্তির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত পশুর গোশত কিংবা যার উপরে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, এমন কোন গোশত ভক্ষণ করেননি’ (বুখারী ফৎহসহ হা/৫৪৯৯)।
(৪) কা‘বা পুনর্নির্মাণ কালে দূর থেকে পাথর বহন করে আনার সময় চাচা আববাসের প্রস্তাবক্রমে তিনি কাপড় খুলে ঘাড়ে রাখেন। ফলে তিনি সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। অতঃপর হুঁশ ফিরলে তিনি পাজামা কঠিনভাবে বেঁধে দিতে বলেন’ (বুখারী, মুসলিম)। যদিও বিষয়টি সেযুগে কোনই লজ্জাকর বিষয় ছিল না। ইবনু হাজার আসক্বালানী উক্ত হাদীছের আলোচনায় বলেন, ‘এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ স্বীয় নবী-কে নবুঅতের পূর্বে ও পরে সকল মন্দকর্ম থেকে হেফাযত করেন’।[3]
(৫) আল্লাহ তাঁর আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন (বুখারী হা/৭৪১০)। তাই তিনি ছিলেন আল্লাহর মনোনীত নিষ্পাপ রাসূল[4]- ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আল্লাহ তাঁর উপরে অনুগ্রহ করুন ও শান্তি বর্ষণ করুন!)।
[1]. বুখারী হা/১৬৬৪; মুসলিম হা/১২২০।
[2]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৪৬৬৮; হাকেম হা/৪৯৫৬, ৩/২১৬; সনদ ছহীহ।
[3]. মুসলিম হা/৩৪০; বুখারী ফৎহসহ হা/৩৬৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[4]. ড. আকরাম যিয়া উমারী, সীরাহ নববিইয়াহ ছহীহাহ ১/১১৪-
ফিজার যুদ্ধের ভয়াবহতা স্বচক্ষে দেখে দয়াশীল মুহাম্মাদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে এরূপ ধ্বংসলীলা আর না ঘটে, সেজন্য তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। এই সময় হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটে যায়। যুবায়েদ (زُبَيْد) গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে মক্কায় এসে অন্যতম কুরায়েশ নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর নিকটে মালামাল বিক্রয় করেন। কিন্তু তিনি মূল্য পরিশোধ না করে মাল আটকে রাখেন। তখন লোকটি অন্য নেতাদের কাছে সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে তিনি ভোরে আবু কুবায়েস পাহাড়ে উঠে সবাইকে উদ্দেশ্য করে উচ্চকণ্ঠে হৃদয় বিদারক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন।
রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা যুবায়ের বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এই আওয়ায শুনে ছুটে যান এবং ঘটনা অবহিত হয়ে তিনি অন্যান্য গোত্র প্রধানদের নিকটে গমন করেন। অতঃপর তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আব্দুল্লাহ বিন জুদ‘আন তায়মীর গৃহে গোত্রপ্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে রাসূল (ছাঃ)-এর দাদা ও নানার গোত্র সহ পাঁচটি গোত্র যোগদান করে। তারা হ’ল বনু হাশেম, বনু মুত্ত্বালিব, বনু আসাদ, বনু যোহরা ও বনু তাইম বিন মুররাহ। উক্ত বৈঠকে তরুণ মুহাম্মাদ কতগুলি কল্যাণমূলক প্রস্তাব পেশ করেন, যা নেতৃবৃন্দের প্রশংসা অর্জন করে। অতঃপর চাচা যুবায়েরের দৃঢ় সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মূলতঃ ভাতিজা মুহাম্মাদ ছিলেন উক্ত কল্যাণচিন্তার উদ্ভাবক এবং পিতৃব্য যোবায়ের ছিলেন তার প্রথম ও প্রধান সমর্থক। চুক্তিগুলি ছিল নিম্নরূপ :
হারবুল ফিজারের পরে যুলক্বা‘দাহ্র ‘হারাম’ মাসে আল্লাহর নামে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি সম্পাদনের পরপরই তারা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর নিকট যান এবং তার কাছ থেকে উক্ত মযলূম যুবায়দী ব্যবসায়ীর প্রাপ্য হক বুঝে দেন। এরপর থেকে সারা মক্কায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে এবং কুরাইশগণ এই কল্যাণকামী সংগঠনকে ‘হিলফুল ফুযূল’ (حِلْفُ الْفُضُولِ) বা ‘কল্যাণকামীদের সংঘ’ বলে আখ্যায়িত করেন।[1] একে (حِلْفَ الْمُطَيَّبِينَ) ‘পবিত্রাত্মাদের সংঘ’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে (আহমাদ হা/১৬৫৫)। অথচ ইতিপূর্বে নিয়ম ছিল গোত্রীয় বা দলীয় কোন ব্যক্তি শত অন্যায় করলেও তাকে পুরা গোত্র মিলে সমর্থন ও সহযোগিতা করতেই হ’ত। যেমন আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়-অন্যায় বাছ-বিচার ছাড়াই দলীয় ব্যক্তির সমর্থনে নেতা-কর্মীরা করে থাকেন। এমনকি আদালতও প্রভাবিত হয়।
হিলফুল ফুযূল-এর গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, شَهِدْتُ حِلْفَ الْمُطَيَّبِينَ مَعَ عُمُومَتِى وَأَنَا غُلاَمٌ، فَمَا أُحِبُّ أَنَّ لِى حُمْرَ النَّعَمِ وَأَنِّى أَنْكُثُهُ ‘আমি আমার চাচাদের সঙ্গে হিলফুল ফুযূলে অংশগ্রহণ করি, যখন আমি বালক ছিলাম। অতএব আমি মূল্যবান লাল উটের বিনিময়েও উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করতে রাযী নই’ (আহমাদ হা/১৬৫৫, ১৬৭৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯০০)।
[1]. ইবনু হিশাম ১/১৩৩-৩৪; সীরাহ ছহীহাহ ১/১১১-১১২।
প্রসিদ্ধ আছে যে, জনৈক ইরাশী ব্যক্তি মক্কায় উট নিয়ে আসেন। আবু জাহল তার নিকট থেকে একটি উট খরীদ করেন। কিন্তু তার মূল্য পরিশোধে টাল-বাহানা করেন। তখন উক্ত ব্যক্তি কুরায়েশদের ভরা মজলিসে দাঁড়িয়ে অভিযোগ পেশ করে বলেন, আমি একজন গরীব পথিক। অথচ আমার হক নষ্ট করা হয়েছে। লোকেরা তাকে রাসূল (ছাঃ)-কে দেখিয়ে বলল, তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে চেন? তাঁর কাছে যাও। তখন লোকটি অনতিদূরে বসা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এল এবং উক্ত অভিযোগ পেশ করে বলল, আপনি আমার হক আদায় করে দিন। আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন! তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে নিয়ে আবু জাহল-এর বাড়িমুখে চললেন। মুশরিকদের পক্ষ হ’তে একজন তাদের পিছু নিল, ঘটনা কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্য। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) এসে আবু জাহলের দরজায় করাঘাত করলেন। তখন আবু জাহল বেরিয়ে এলেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, আপনি এই ব্যক্তিকে তার হক বুঝে দিন। আবু জাহল বললেন, হ্যাঁ। আমি এখনই দিয়ে দিচ্ছি। অতঃপর তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন ও টাকা এনে ইরাশীকে দিয়ে দিলেন।... একথা জানতে পেরে লোকেরা আবু জাহলের কাছে এসে ধিক্কার দিয়ে বলল, আপনার কি হয়েছে? কখনই তো আপনার কাছ থেকে এরূপ আচরণ আমরা দেখিনি। আবু জাহল বললেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক! আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ আমার দরজায় করাঘাত করার পর তাঁর কণ্ঠ শুনে আমি ভয়ে কম্পিত হয়ে পড়ি। অতঃপর বেরিয়ে এসে দেখি তাঁর মাথার উপরে ভয়ংকর একটি উট। যার চোয়াল ও দাঁতসমূহের মতো আমি কখনো দেখিনি। আল্লাহর কসম! যদি আমি অস্বীকার করতাম, তাহ’লে সে আমাকে খেয়ে ফেলত’ (ইবনু হিশাম ১/৩৮৯-৯০)। ঘটনাটির সনদ যঈফ (মা শা-‘আ ১৪৮-৪৯ পৃঃ)।