আল-আমীন মুহাম্মাদ

হিলফুল ফুযূল গঠন ও তার পরপরই যবরদস্ত কুরায়েশ নেতার কাছ থেকে বহিরাগত মযলূমের হক আদায়ের ঘটনায় চারিদিকে তরুণ মু??

হিলফুল ফুযূল গঠন ও তার পরপরই যবরদস্ত কুরায়েশ নেতার কাছ থেকে বহিরাগত মযলূমের হক আদায়ের ঘটনায় চারিদিকে তরুণ মুহাম্মাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। সবার মুখে মুখে তিনি ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও আমানতদার বলে অভিহিত হ’তে থাকেন।

 

  অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না। সবাই শ্রদ্ধাভরে ‘আল-আমীন’ বলে ডাকত।[1]

 

[1]. ইবনু হিশাম ১/১৯৮। প্রসিদ্ধ আছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আবুল হামসা বলেন, নবুঅত পূর্বকালে আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে কিছু খরীদ করেছিলাম। সেখানে মূল্য পরিশোধে আমি কিছু বাকী রাখি। অতঃপর আমি তাকে ওয়াদা করি যে, এই স্থানেই আমি উক্ত মূল্য নিয়ে আসছি। পরে আমি বিষয়টি ভুলে যাই। তিন দিন পরে স্মরণ হ’লে আমি এসে দেখি রাসূল (ছাঃ) সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমাকে কষ্ট দিলে। তিন দিন ধরে আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় আছি’ (আবুদাঊদ হা/৪৯৯৬)। হাদীছটি যঈফ (আলবানী, সনদ যঈফ; মা শা-‘আ ২০ পৃঃ)।

১২ বছর বয়সে পিতৃব্য আবু ত্বালিবের সাথে সর্বপ্রথম ব্যবসা উপলক্ষে শাম বা সিরিয়া সফর করেছিলেন। কিন্তু ‘বাহীরা’ রাহেবের কথা শুনে চাচা তাকে সাথে সাথেই মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন।[1] এখন তিনি পঁচিশ বছরের পরিণত যুবক। কুরায়েশ বংশে অনেকে ছিলেন, যারা নির্দিষ্ট লভ্যাংশের বিনিময়ে ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু নিজেরা সরাসরি ব্যবসায়িক সফরে যেতেন না। এজন্য তারা সর্বদা বিশ্বস্ত ও আমানতদার লোক তালাশ করতেন। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন এমনই একজন বিদুষী ব্যবসায়ী মহিলা।

 

  মুহাম্মাদের সততা ও আমানতদারীর কথা শুনে তিনি তার নিকটে অন্যদের চেয়ে অধিক লভ্যাংশ দেওয়ার অঙ্গীকারে ব্যবসায়ের প্রস্তাব পাঠান। চাচার সাথে পরামর্শক্রমে তিনি এতে রাযী হয়ে যান। অতঃপর খাদীজার গোলাম মায়সারাকে সাথে নিয়ে প্রথম ব্যবসায়িক সফরে তিনি সিরিয়া গমন করেন।[2] ব্যবসা শেষে মক্কায় ফিরে আসার পরে হিসাব-নিকাশ করে মূল পুঁজি সহ এত বেশী লাভ হস্তগত হয় যে, খাদীজা ইতিপূর্বে কারু কাছ থেকে এত লাভ পাননি।

 

[1]. হাকেম হা/৪২২৯; তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮।

 

[2]. ইবনু ইসহাক এখানে বিনা সনদে উল্লেখ করেন যে, শামে গিয়ে রাসূল (ছাঃ) একজন পাদ্রীর উপাসনালয়ের পাশে একটি গাছের ছায়ায় অবতরণ করেন। তখন পাদ্রীটি গোলাম মায়সারাকে এসে বলেন, এ ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, ইনি হারামের অধিবাসী কুরায়েশ বংশের একজন ব্যক্তি। পাদ্রী বলেন, এই গাছের নীচে নবী ব্যতীত কেউ কখনো অবতরণ করেন না’ (ইবনু হিশাম ১/১৮৮)। এই পাদ্রীর নাম নাস্তূরা (نَسْطُورا)। সুহায়লী বলেন, ঈসা (আঃ) থেকে এত দীর্ঘ বছর পর্যন্ত ঐ গাছটি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অতএব এক্ষেত্রে সঠিক বর্ণনা এটাই হ’তে পারে যে, ঈসা (আঃ)-এর পরে এ যাবৎ কেউ এর নীচে অবতরণ করেন নি। ইবনু ইসহাক ব্যতীত অন্য কেউ উক্ত বর্ণনা করেছেন’ (ঐ, টীকা-৩)।

 

ইতিপূর্বে বাহীরা পাদ্রী এবং এখন নাস্তূরা পাদ্রীর ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ বর্ণনা করে গল্পকারগণ প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, খাদীজা উক্ত কারণেই মুহাম্মাদ-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন (মোস্তফা চরিত ২৮৬-৮৮ পৃঃ)। অথচ এগুলি একেবারেই ভিত্তিহীন কল্পকথা মাত্র।

ব্যবসায়ে অভাবিত সাফল্যে খাদীজা দারুণ খুশী হন। অন্যদিকে গোলাম মায়সারার কাছে মুহাম্মাদের মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী এবং উন্নত চিন্তা-চেতনার কথা শুনে বিধবা খাদীজা মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে পরপর দু’জন স্বামী মৃত্যুবরণ করায় মক্কার সেরা নেতৃবৃন্দ তাঁর নিকটে বিয়ের পয়গাম পাঠান। কিন্তু তিনি কোনটাই গ্রহণ করেননি। এবার তিনি নিজেই বান্ধবী নাফীসার মাধ্যমে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন যুবক মুহাম্মাদ-এর কাছে।

 

  তখন উভয় পক্ষের মুরববীদের সম্মতিক্রমে শাম থেকে ফিরে আসার মাত্র দু’মাসের মাথায় সমাজনেতাদের উপস্থিতিতে ধুমধামের সাথে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মুহাম্মাদ স্বীয় বিবাহের মোহরানা স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। এ সময় খাদীজা ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারিণী হিসাবে ‘ত্বাহেরা’ (পবিত্রা) নামে খ্যাত। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ এবং মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। মুহাম্মাদ ছিলেন খাদীজার তৃতীয় স্বামী। অন্যদিকে খাদীজা ছিলেন মুহাম্মাদের প্রথমা স্ত্রী।[1] উভয়ের দাম্পত্য জীবন পঁচিশ বছর স্থায়ী হয়। মৃত্যুকালে খাদীজার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তবে উভয়ের বয়স নিয়ে মতভেদ আছে।[2]

 

[1]. ইবনু হিশাম ১/১৮৭-৮৯; আল-বিদায়াহ ২/২৯৩-৯৪।

 

[2]. অধিকাংশ জীবনীকারের নিকট প্রসিদ্ধ মতে বিয়ের সময় উভয়ের বয়স ছিল যথাক্রমে ২৫ ও ৪০ (ইবনু হিশাম ১/১৮৭)। তবে কেউ কেউ ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স সম্পর্কে বলেছেন ২১, ৩০ ও ৩৭ এবং খাদীজার বয়স সম্পর্কে বলেছেন ২৫, ২৮, ৩৫ ও ৪৫। মৃত্যুকালে খাদীজার বয়স সম্পর্কে বলা হয়েছে ৫০ ও ৬৫। দ্রঃ ইবনু হিশাম ১/১৮৭, টীকা ১-২; হাকেম হা/৪৮৩৮, ৩/২০০; বায়হাক্বী দালায়েল হা/৪০৪; মা শা-‘আ ১৮-১৯ পৃঃ।

 

খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর (১৮১৯-১৯০৫) ভিত্তিহীন কিছু বক্তব্য তাঁর প্রণীত নবী জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ এই বিয়েতে আদৌ সম্মত ছিলেন না। তাই খাদীজা তাঁর পিতাকে মদ পান করিয়ে মাতাল করেন। অতঃপর তাঁর অজ্ঞান অবস্থায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে নেন’। এছাড়া এখানে উভয়ের সম্পর্ক নিয়েও কিছু বাজে কথা লেখা হয়েছে (ঐ, নবীজীবনী পৃঃ ২৪)। অন্যতম লেখক মার্গোলিয়থ (১৮৫৮-১৯৪০) খাদীজার বয়স যে ৪০ ছিল, তা মানতে রাযী হননি। কেবল এতটুকুই স্বীকার করেছেন যে, খাদীজার বয়স মুহাম্মাদের চেয়ে কিছুটা বেশী ছিল (ঐ, নবীজীবনী পৃঃ ৬৬; দ্রঃ মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত ২৯০-৯১ পৃঃ)।

 

উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর অভিভাবকদের পক্ষ থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিয়েতে যান তাঁর চাচা হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব। তিনি খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ বিন আসাদ-এর নিকটে বিয়ের পয়গাম পেশ করেন। অতঃপর উভয় পক্ষের সম্মতিতে বিবাহ হয়। বিয়েতে খুৎবা পাঠ করেন গোত্রনেতা চাচা আবু ত্বালিব (ইবনু হিশাম ১/১৮৯-৯০ ও টীকা ১)। তবে যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ) বর্ণনা করেন যে, খুওয়াইলিদ ঐ সময় মাতাল ছিলেন। অতঃপর হুঁশ ফিরলে তিনি বিয়েতে অস্বীকার করেন। অবশেষে রাযী হন এবং বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। পক্ষান্তরে ইবনু ইসহাক ব্যতীত অন্যেরা বলেন যে, খুওয়াইলিদ ঐ সময় জীবিত ছিলেন না। ফলে খাদীজার বিয়ে দেন তাঁর চাচা ‘আমর বিন আসাদ। কেউ বলেন, তাঁর ভাই ‘আমর বিন খুওয়াইলিদ (ইবনু হিশাম ১/১৯০, টীকা ২)। দুষ্টু ঐতিহাসিক মূর যুহরীর অপ্রমাণিত বক্তব্যকে পুঁজি করে তাতে আরও রং চড়িয়েছেন।অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না। সবাই শ্রদ্ধাভরে ‘আল-আমীন’ বলে ডাকত।[1]

 

[1]. ইবনু হিশাম ১/১৯৮। প্রসিদ্ধ আছে যে, আব্দুল্লাহ বিন আবুল হামসা বলেন, নবুঅত পূর্বকালে আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে কিছু খরীদ করেছিলাম। সেখানে মূল্য পরিশোধে আমি কিছু বাকী রাখি। অতঃপর আমি তাকে ওয়াদা করি যে, এই স্থানেই আমি উক্ত মূল্য নিয়ে আসছি। পরে আমি বিষয়টি ভুলে যাই। তিন দিন পরে স্মরণ হ’লে আমি এসে দেখি রাসূল (ছাঃ) সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমাকে কষ্ট দিলে। তিন দিন ধরে আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় আছি’ (আবুদাঊদ হা/৪৯৯৬)। হাদীছটি যঈফ (আলবানী, সনদ যঈফ; মা শা-‘আ ২০ পৃঃ)।


Salma Akter

233 Blog posts

Comments