কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণ ও মুহাম্মাদের মধ্যস্থতাঃ আল-আমীন মুহাম্মাদ-এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরায়েশ নেতাগণ কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে গড়া ন্যূনাধিক আড়াই হাযার বছরের স্মৃতিধন্য এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনর্নির্মাণের পবিত্র কাজে সকলে অংশীদার হ’তে চায়।
ইবরাহীমী যুগ থেকেই কা‘বাগৃহ ৯ হাত উঁচু চার দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর ছিল, যার কোন ছাদ ছিল না। কা‘বা অর্থই হ’ল চতুর্দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উঁচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির স্রোতের আঘাতে কা‘বার দেওয়াল ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সে বছরের তীব্র বন্যায় কা‘বা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। অধিকন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঐ সময় ঘটে যায়, যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি এবং যা কা‘বা পুনর্নির্মাণে প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে কাজ করে। ঘটনাটি ছিল এই যে, কিছু চোর দেওয়াল টপকে কা‘বা গৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়।
কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে স্থির করেন যে, এর নির্মাণ কাজে কারু কোনরূপ হারাম মাল ব্যয় করা হবে না। তারা বলেন, হে কুরায়েশগণ! তোমরা এর নির্মাণ কাজে তোমাদের পবিত্র উপার্জন থেকে ব্যয় কর। এর মধ্যে ব্যভিচারের অর্থ, সূদের অর্থ, কারু প্রতি যুলুমের অর্থ মিশ্রিত করোনা’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৪)। অতঃপর কোন কোন গোত্র মিলে কোন পাশের দেওয়াল নির্মাণ করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা ইতিপূর্বে ছিল না। কিন্তু কে আগে দেওয়াল ভাঙ্গার সূচনা করবে?
অবশেষে অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী সাহস করে প্রথম ভাঙ্গা শুরু করেন। তারপর সকলে মিলে দেওয়াল ভাঙ্গা শেষ করে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙ্গা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে ‘বাকূম’ (باقوم بنّاء رومى) নামক জনৈক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকার্য শুরু হয়। কিন্তু গোল বাঁধে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজারে আসওয়াদ’ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গড়াবার আশংকা দেখা দিল। তখন প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযূমী প্রস্তাব করলেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ‘হারামে’ প্রবেশ করবেন, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল।
আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, বনু শায়বাহ ফটক দিয়ে সকালে সবার আগে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সকলের প্রিয় ‘আল-আমীন’। কা‘বা নির্মাণে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী রাবী আব্দুল্লাহ বিন সায়েব আল-মাখযূমীর বর্ণনা মতে তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো- هَذَا الْأَمِينُ، رَضِينَا، هَذَا مُحَمَّدٌ ‘এই যে আল-আমীন। আমরা তাঁর উপর সন্তুষ্ট। এই যে মুহাম্মাদ’। অতঃপর তিনি ঘটনা শুনে একটা চাদর চাইলেন এবং সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ উঠিয়ে তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সকলে মিলে চাদরের চারপাশ ধরে নিয়ে চলুন। তাই করা হ’ল। কা‘বার নিকটে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন।[1] এই দ্রুত ও সহজ সমাধানে সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মাদের তারীফ করতে করতে চলে গেল। আরবরা এমন এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল, যা ২০ বছরেও শেষ হ’ত কি-না সন্দেহ। এ ঘটনায় সমগ্র আরবে তাঁর প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো। নেতাদের মধ্যে তাঁর প্রতি একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রমবোধ সৃষ্টি হ’ল।
উল্লেখ্য যে, নবুঅত লাভের পূর্ব পর্যন্ত কুরায়েশগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে শ্রদ্ধাভরে আল-আমীন (الْأَمِينُ) বলেই ডাকত’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৮)।
কা‘বাগৃহ নির্মাণের এক পর্যায়ে উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু ‘আদী বিন কা‘ব বিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের কমতি থাকায় কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে মূল ভিতের ঐ অংশের প্রায় সাত হাত জায়গা বাদ রেখেই দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। যা হাত্বীম (الْحَطِيم) বা পরিত্যক্ত নামে আজও ঐভাবে আছে। সেকারণ হাতীমের বাহির দিয়েই ত্বাওয়াফ করতে হয়, ভিতর দিয়ে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের পরে ঐ অংশটুকু কা‘বার মধ্যে শামিল করে মূল ইবরাহীমী ভিতের উপর কা‘বা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নওমুসলিম কুরায়েশরা সেটা মেনে নিবে না ভেবে বিরত থাকেন’ (বুখারী হা/১৫৮৬)। একারণেই বলা হয়ে থাকে, دَرْءُ الْمَفَاسِدِ أَوْلَى مِنْ جَلْبِ الْمَصَالِحِ ‘মন্দ প্রতিরোধ অধিক উত্তম কল্যাণ আহরণের চাইতে’। উল্লেখ্য যে, হিজরতের ১৮ বছর পূর্বে কা‘বাগৃহ পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত হয়’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৭-এর টীকা-৩)।
[1]. ইবনু হিশাম ১/১৯৭; আহমাদ হা/১৫৫৪৩; হাকেম হা/১৬৮৩; সনদ ছহীহ।
তাঁর মোট ৩ পুত্র ও ৪ কন্যা ছিল। ইবরাহীম ব্যতীত বাকী ৬ সন্তানের সবাই ছিলেন খাদীজার গর্ভজাত। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (ছাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ করেননি।[1] মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথে বিয়ের সময় খাদীজা পূর্ব স্বামীদ্বয়ের কয়েকজন জীবিত সন্তানের মা ছিলেন। তাঁর গর্ভজাত ও পূর্বস্বামীর সন্তানেরা সকলে ইসলাম কবুল করেন ও সকলে ছাহাবী ছিলেন। খাদীজার গর্ভে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম সন্তান ছিল ক্বাসেম। তার নামেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। অতঃপর কন্যা যয়নব, পুত্র আব্দুল্লাহ; যার লকব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের। কারণ তিনি নবুঅত লাভের পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর রুক্বাইয়া, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা।
ক্বাসেম ছিলেন সন্তানদের মধ্যে সবার বড়। যিনি ১৭ মাস বয়সে মারা যান। নবুঅত লাভের পর আব্দুল্লাহ জন্ম গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করায় ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘আবতার’ বা নির্বংশ বলে অভিহিত করেন। কেননা সে যুগে কারু পুত্র সন্তান মারা গেলে এবং পরে পুত্র সন্তান হ’তে দেরী হ’লে আরবরা ঐ ব্যক্তিকে ‘আবতার’ বলত। অতঃপর চার কন্যার মধ্যে কে সবার বড় ও কে সবার ছোট এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে প্রসিদ্ধ মতে যয়নব বড় ও ফাতেমা ছিলেন ছোট।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মোট সাত সন্তানের ছয় জনই তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মধ্যে পুত্রগণ শৈশবে মারা যান। কন্যাগণ সকলে বিবাহিতা হন ও হিজরত করেন। কিন্তু ফাতেমা ব্যতীত বাকী তিন কন্যা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ছয় মাস পরে ফাতেমা (রাঃ) মারা যান। রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বশেষ সন্তান ছিলেন পুত্র ‘ইবরাহীম’। তিনি ছিলেন মিসরীয় দাসী মারিয়া ক্বিবতীয়ার গর্ভজাত। যিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং দুধ ছাড়ার আগেই মাত্র ১৮ মাস বয়সে ১০ম হিজরীর ২৯শে শাওয়াল মোতাবেক ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ২৭ অথবা ৩০শে জানুয়ারী সূর্য গ্রহণের দিন সোমবার মদীনায় ইন্তেকাল করেন।[2]
[1]. ইবনু হিশাম ১/১৯০; মুসলিম হা/২৪৩৬।
[2]. বুখারী হা/১০৬০; মুসলিম হা/৯০৬; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৯৮ পৃঃ।