দরজার নীচের চৌকাঠ ২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৬২)। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর ইচ্ছা ছিল, হাত্বীমকে অন্তর্ভুক্ত করে মূল ভিতের উপর কা‘বাগৃহ নির্মাণ করা, যা মাটি সমান হবে। যার পূর্ব দরজা দিয়ে মুছল্লী প্রবেশ করবে ও ছালাত শেষে পশ্চিম দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে। যাতে তাদের ইচ্ছার বাইরে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে’।[1]
খালা আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট এ হাদীছ শোনার পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে (৬৪-৭৩ হিঃ) ৬৪ হিজরী সনে কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে রাসূল (ছাঃ)-এর ইচ্ছানুযায়ী তা পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু ৭৩ হিজরী সনে তিনি যুদ্ধে নিহত হ’লে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তা পুনরায় ভেঙ্গে আগের মত হাত্বীমকে বাইরে রেখে নির্মাণ করেন। যা আজও রয়েছে। পরবর্তীতে আববাসীয় খলীফা মাহদী ও হারূণ এটি পুনর্নির্মাণ করে রাসূল (ছাঃ)-এর ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.) তাদের বলেন, لاَ تَجْعَلْ كَعْبَةَ اللهِ مَلْعَبَةً لِلْمُلُوْكِ ‘আপনারা কা‘বাগৃহকে রাজা-বাদশাহদের খেল-তামাশার বস্ত্ততে পরিণত করবেন না’।[2] ফলে কা‘বাগৃহ ঐ অবস্থায় রয়ে যায়। ইবরাহীমী ভিতে আজও ফিরে আসেনি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আকাংখাও পূর্ণ হয়নি।
[1]. বুখারী হা/১২৬; মুসলিম হা/১৩৩৩।
[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১২৭-২৮ আয়াত; ঐ, আল-বিদায়াহ ৮/২৫৩; সুহায়লী, আর-রাউযুল উনুফ ২/১৭৩।
নবুঅত লাভের সময়কাল যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, ততই তাঁর মধ্যে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা বাড়তে থাকল। এক সময় তিনি কা‘বাগৃহ থেকে প্রায় ৬ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে হেরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ১২*৫১/৪*৭ বর্গফুট আকারের ছোট গুহার নিরিবিলি স্থানকে বেছে নিলেন। বাড়ী থেকে তিনি পানি ও ছাতু নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে আবার আসতেন। কিন্তু বাড়ীতে তার মন বসতো না। কখনো কখনো সেখানে একটানা কয়েকদিন কাটাতেন। তাঁর এই ইবাদত কতদিন ছিল, সেটির ধরন কেমন ছিল, সে বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না।
অতঃপর রবীউল আউয়ালের জন্ম মাস থেকে শুরু হয় ‘সত্যস্বপ্ন’ (الرُّؤْيَا الصَّادِقَةُ) দেখা। তিনি স্বপ্নে যাই-ই দেখতেন তাই-ই দিবালোকের ন্যায় (مِثْلَ فَلَقِ الصُّبْحِ) সত্য হয়ে দেখা দিত’ (বুখারী ফৎহসহ হা/৪৯৫৩)। এভাবে চলল প্রায় ছয় মাস। যা ছিল ২৩ বছরের নবুঅতকালের ৪৬ ভাগের এক ভাগ। হাদীছে সম্ভবতঃ একারণেই সত্যস্বপ্নকে নবুঅতের ৪৬ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে।[1]
এসে গেল রামাযান মাস। পূর্বের ন্যায় এবারেও তিনি পুরা রামাযান সেখানে ই‘তিকাফে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বগোত্রীয় লোকদের পৌত্তলিক ও বস্ত্তবাদী ধ্যান-ধারণা তাঁকে পাগল করে তুলত। কিন্তু তাদের ফিরানোর কোন পথ তাঁর জানা ছিল না।
মূলতঃ হেরা গুহায় নিঃসঙ্গ অবস্থানের বিষয়টি ছিল আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনা ও মহতী ব্যবস্থাপনারই অংশ। ইবনু আবী জামরাহ (ابن أبي جَمْرَة) বলেন, এর মধ্যে তিনটি ইবাদত এক সাথে ছিল।
(১) নির্জনবাস
(২) আল্লাহর ইবাদত এবং
(৩) সেখান থেকে কা‘বাগৃহ দেখতে পাওয়া।
ইবনু ইসহাক বলেন, ‘এভাবে নিঃসঙ্গ ইবাদত জাহেলিয়াতের রীতি ছিল। তাঁর কওম পূর্ব থেকেই যেমন আশূরার ছিয়াম পালন করত, তেমনি হেরা গুহায় নিঃসঙ্গ ইবাদত করত। আব্দুল মুত্ত্বালিব এটি প্রথম করেন’।[2] বরং এটি ছিল ইবরাহীমী ইবাদতের (فَالتَّحَنُّثُ مِنْ بَقَايَا الِْإِبْرَاهِيْمِيَّةِ) অবশিষ্টাংশ’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/১২৩-টীকা)। যার মাধ্যমে আল্লাহভীরু বান্দার মধ্যে অধ্যাত্ম চেতনার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটা সম্ভব হয়। এভাবে হেরা গুহায় থাকা অবস্থায় একদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী নিয়ে জিব্রীল (আঃ) এসে হাযির হন।
[1]. বুখারী ফৎহসহ হা/৬৯৮৩-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[2]. বুখারী ফৎহসহ হা/৬৯৮২-এর আলোচনা; ইবনু হিশাম ১/২৩৫।