ছেলেটা গম্ভীর স্বরে বলেছিল—আমার হিসাবে, প্রেমিকা ব্লক লিস্টে। ভার্চুয়াল নয়, বাস্তব আমিটা তোমার।
বছর দেড়েক আগে, ছেলেটার হাত ধরেই মেয়েটার কবিতার জগতে প্রবেশ। এক ভোরে ফেসবুক মেসেঞ্জারে ছেলেটার নক। যদিও দুজনে আগেই ফেসবুক বন্ধু হয়েছিল।
‘আপনার প্রিয় সময় কখন?’ মেয়েটা উত্তর দিয়েছিল, ‘ভোর।
আপনার?
‘আমারও! প্রতি ভোরে আমার অ্যাকটিভ ফ্রেন্ড হিসেবে আপনাকে দেখি। তাই আরকি জিজ্ঞাসা...’
মেয়েটা একটা স্মাইলি পাঠায়। ছেলেটা আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘কবিতা পড়েন?’
‘উম্ম্, বই পড়া হয়। কিন্তু কবিতা ঠিক বুঝি না। আপনার টাইমলাইন ঘুরে এলাম, ভালো লিখেন তো আপনি!’ এবার ছেলেটা একটা স্মাইলি পাঠায়।
পরপরই একটা কবিতা পাঠায় ‘ভালোবাসার বিস্ফোরণ’ নামে। কবিতার নিচে ছেলেটার নাম। তার নিচে সেদিন ভোরের একটা সময় আর লেখা—অমর একুশে হল, ঢাবি।
মেয়েটা কবিতা পড়তে গিয়ে বুঝতে পারে, ছেলেটা সায়েন্সকে কেন্দ্র করে প্রেমের কবিতাটা লিখেছে। বিগ ব্যাং থিওরি...।
মেয়েটা উত্তর দেয়, ‘আমি যে কমার্সের ছাত্রী। কী করে বুঝি বলুন তো?’
ততক্ষণে ছেলেটা অফলাইনে...।
এরপর প্রতি ভোরেই তাদের কথা হতো। মেয়েটা একসময় আবিষ্কার করে, অসম্ভব মেধাবী ছেলেটা নিজের জীবনকে পুরোটাই সাদাকালো করে রেখেছে। একটু একটু করে ছেলেটার জীবনের গল্প উপলব্ধি করে। মেয়েটার মন দ্রবীভূত হয়। আর ছেলেটা আস্তে আস্তে মেয়েটাকে রুদ্র চেনায়, জীবনানন্দ বোঝায়, বিনয় মজুমদার আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় শোনায় এবং আরও আরও...।
আঁকিয়ে মেয়েটা ছেলেটাকে রং চেনাতে চেষ্টা করে। মেয়েটার ইচ্ছা করে তার প্যালেটের সমস্ত রং এই সাদাকালো ছেলেটার জীবনে ছড়িয়ে দিতে। ছেলেটা ভীষণ উদাসীন আর মেয়েটা অদম্য লড়াকু। আক্ষরিক অর্থেই দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা।
একই শহরে ওদের চলাচল কিন্তু কাকতালীয়ভাবেও ওদের কখনো দেখা হয় না।
একদিন সবকিছু এক পাশে রেখে ছেলেটা মেয়েটাকে বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে থাকা যায়?’
‘মানে’?
‘মানে, আমার একটা মেয়ে থাকবে। লাল ফ্রক পরা। চুলে দুবেণি করা। আর হাতে চিপস।’
ব্র্যাকেটে লিখেছিল, ‘আজ সন্ধ্যায় উত্তর চাই’। এবং ছেলেটা অফলাইনে গিয়েছিল।
সন্ধ্যায় ছেলেটাই নক করে বলেছিল, ‘কিছু ভেবেছ?’
‘আমি আর কিছু ভাবছি না।’
‘মানে’?
‘মানে, আমার একটা মেয়ে থাকবে। লাল ফ্রক পরা। চুলে দুবেণি করা। আর হাতে চিপস।’
ছেলেটা একটা স্মাইলি দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল অফলাইনে। আর সত্যিই ভার্চুয়াল জগৎ থেকে মেয়েটাকে ব্লক করেছিল।
এরপর ওদের জীবনে রুদ্র, জীবনানন্দ, বিনয়, শক্তির সঙ্গে কার্ট কোবেইন, জিম মরিসনও জড়িয়ে গেল। মেয়েটাকে অদ্ভুত নেশায় চেপে ধরল। ছেলেটার কবিতাগুলো গুছিয়ে রাখার নেশা। ছেলেটার প্রিয়গুলো, প্রিয় করে তোলার নেশা। মেয়েটা ছেলেটার জন্য লেবু রঙের পাঞ্জাবিতে নকশা তোলে। প্রতিটি ফোঁড়ে ফোঁড়ে ভালোবাসা সাজায়। ছেলেটা মেয়েটার জন্য এক পাতা নীল টিপ কেনে। কিন্তু ওদের কখনো দেখা হয় না। হয় হয় করেও হয় না...
একসময় ছেলেটা জীবনানন্দের ‘বোধ’-এ আটকে যায়। বদলে যেতে থাকে। ছেলেটা কার্ট কোবেইনকে ভাবে। জিম মরিসনে ডুবে। কিন্তু মেয়েটার কথা ভাবে না!
ছেলেটা রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। গায়ে কালো টি-শার্ট। তার বুকে লেখা ‘নিরভানা’।
মেয়েটার ইজেল বোর্ডে ঝোলানো পেপারে আঁকা ছেলেটার অসম্পূর্ণ ছবি।
ওরা একই সঙ্গে গ্র্যাভিটির অতলে হারায় কিন্তু কখনো এক হয় না।
মেয়েটা তবু অপেক্ষা করে তিমির রাত পেরোনো কোনো এক ভোরের। মেয়েটা ডুবে থাকে জীবনানন্দের তিমিরহননের গানে—
কোনো হৃদে
কোথাও নদীর ঢেউয়ে
কোনো এক সমুদ্রের জলে
পরস্পরের সাথে দু’দণ্ড জলের মতো মিশে
সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে
আমাদের জীবনের আলোড়ন