জীবনের চাকা - ভালবাসার গল্প

বিয়ে করবেন আমাকে?
আনিকার মুখ থেকে কথা টা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো উদয়। আনিকা তাঁর বস। সে যে কোম্পানির কুক??

উদয়ের ছেলেটাকে খেয়াল করছে ভালো করে। ঠিক নাকের বাম পাশে একটা তিল ফারাযের, আর আনিকার ও সেখানেই সেরকম একটা তিল! ছেলেটাকে কাছে ডাকতে ইচ্ছে হলেও ডাকেনি। মনের অবস্থা মৃত্যু শয্যাশায়ী তাঁর।

আনিকা কষ্ট হলেও উদয়ের কাছে সবকিছু খুলে বলে ক্ষমা চেয়ে নিলো। আনিকার এরকম অবস্থাতে কীভাবে সে বলবে যে ছেলে টা দাঁড়িয়ে আছে পাশে সে তাঁরই সন্তান? উদয় বলেনি। ভেবেছিলো চলে যাবে। আনিকা শেষে বললো— পিচ্চি টা কে?

— ভাতিজা।

এ কথা শুনে ফারায কান্না করে দিয়ে বললো— আমি তোমার ভাতিজা আব্বু? তুমিও মায়ের মতো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তাহলে? আমাকে বিক্রি করে দিতে এসেছো এখানে না? আমি কী এতোই খাই পড়ি?

আনিকা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক হয়েই বললো— আপনার ছেলে? আপনার মতোই হয়েছে। কথার কড়া জবাব দিয়ে দেয়।

আনিকার এরকম স্বাভাবিক আচরণে উদয় অবাক হয়। আনিকার যে আর কিছু আসে যায় না উদয় বিবাহিত না কী অবিবাহিত তা নিয়ে৷ বরং উদয়ের ছেলেটাকে দেখে ভালোই লেগেছে। নাকের বাম পাশের তিলটার জন্য ভুলতেও পারবে না কোনোদিন। উদয় চলে যায়নি, বা আনিকাও চাকরীচ্যুত করেনি মিথ্যে বলার জন্য।

অবশ্যই করতো, শুধু ছেলেটার জন্য। নাহয় আনিকা মিথ্যে সহ্য করার বেটি নয়। শত যাই হোক। অফিসের পাশেই ছোট্ট বাসা নিয়েছে উদয়। বাপ ছেলে ভালোই থাকে। একটা স্কুলে ভর্তি করিয়েছে ফারাযকে। আনিকা রোজ লুকিয়ে একবার দেখা করে আসে। উদয়কে জানয়ে দেয় না।

ফারাযকে মানা করে দেওয়াতে সে ও বলে না। বাঘের গল্প শুনাচ্ছিলো ফারাযকে উদয়। ঘুমাচ্ছে না সে। হটাৎ বলে উঠলো— আচ্ছা আব্বু, আম্মু ডাক টা কী খুব খারাপ? আম্মু ডাকলে কেউ কষ্ট পায়? তোমার অফিসের আন্টিকে আজকে আম্মু ডেকেছিলাম আর উনি সমানে কান্না করলো কেনো?

উদয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো— কখন?

— কখন আবার, দুপুরে। রোজই তো আমার জন্য টিফিনে এটা ওটা আনে। তুমি নাকি পাঠাও। আবার তোমাকে বলতেও নিষেধ করে। কিন্তু আজকে উনি অনেক কান্না করেছে। আমার ভালো লাগছে না। ফোন দাও না স্যরি বলি।

উদয় আবার বিড়ম্বনায় পড়ে গেলো। ফোন দিতে বাধ্য হলো প্রায়। নাহলে ঘুমুচ্ছেই না। আনিকা ফোন ধরতেই ফারায বললো— স্যরি আন্টি। আমি আপনাকে কাঁদিয়েছি আজ।

আনিকার নীরব কান্নার শব্দ শুনতে পারছে উদয়। জবাব দিলো— রোজ কাঁদাবে এভাবে আম্মু বলে?

— আচ্ছা।

এভাবে ওরা কথা বলতেই আছে। পিচ্চি ছেলে টা কতো কথা বলতে পারে। উদয় ভাবছে কে জন্ম দিলো আর কে মা হলো!

এভাবেই একটু একটু ফারাযকে নিয়েই ফেলেছে আনিকা। ছেলে টা তাঁর কাছে আসতেই চায় না। এক চাঁদনী রাতে আনিকাকে ফোন দিয়ে বললো— পৃথিবীর চাঁদ আকাশে। আর আমার চাঁদ টা আপনার কাছে। তাঁকে ছাড়া আমার ঘুম হয় না।

— নিয়ে যান এসে। আমি কী আটকে রেখেছি?

— না, কিন্তু চাইলে আমাকে আটকে রাখতে পারেন।

— আমার এত সাহস নেই।

ফোন টা কেটে আনিকা ঠিকই খুশিতে আত্মহারা। নয় তারিখ তাঁদের বিয়ে হয়। হানিমুন করতে যায় গ্রামের বাড়ি। এখন উদয় অফিসের না হলেও ঘরের কুকার। শ্বশুরবাড়িতে সে থাকে না।

সেই ছোট্ট বাসাতেই থাকে। আনিকারও সেখানে থাকতে কোনো আপত্তি নেই। লোকেরা কতকিছু বলে। আনিকা সেদিকে কান দেয় না।

কিছু বছর পরের কথা।

সূর্যি মামা এখনো উঁকি দেয়নি।

আনিকা উদয়কে ডেকে বললো— আচ্ছা তোমার রক্তের গ্রুপ কী?

— ও পজেটিভ।

— তাহলে জলদি উঠো। একজনকে রক্ত দিতে হবে। সঠিক সময়ে না দিতে পারলে উনি ও মারা যাবেন। উনার পেটের সন্তান ও মারা যাবে।

— তোমার ও তো ও পজেটিভ। তুমি ফারাযকে নিয়ে যাও। একেবারে স্কুলে দিয়ে এসো। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।

— খালি ঘুম আর ঘুম। এই ঘুমই আমার এক নাম্বার সতিন। কবে এই সতিনটাকে ছাড়বে বলো?

— কালকে ছাড়বো। আজকে যাও।

— মনে থাকে যেন।

রোজই এক কথা বলে উদয়। আনিকারও উদয়কে এ নিয়ে বকতে ভালো লাগে।

ফারাযকে নিয়ে আনিকা রক্ত দিতে চলে গেলো। এর পর আরো দুই ঘণ্টা ঘুমানোর পর উঠলো উদয়। ভুলে ফারাযের স্কুল ব্যাগটাই রেখে গেছে তাড়াহুড়োয়। ফোন দিবে বলে ফোন তুলতেই আনিকার ফোন— ঘুম থেকে উঠা হয়েছে মহারাজের? তাহলে ফারাযের ব্যাগ টা স্কুলে দিয়ে আসা হোক। আমি অফিসে যাচ্ছি।

— আচ্ছা, তারপর কী রক্ত দিলে?

— হুম। কিন্তু একটা ব্যাপার কী জানো? মহিলা টা কীভাবে যেন ফারাযের দিকে তাকাচ্ছিলো!

— মহিলা? কী বলো? ফারাযের দিকে কীভাবে তাকাবে কেনো? আচ্ছা নাম কী উনার?

— সায়েরা আক্তার। উনার স্বামীটাও কী খচ্চর। একবার ও না কী দেখতে আসে না! সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে কী জানো? জীবনের প্রথম কাউকে রক্ত দিলাম আর সে তারপর এক ঘণ্টাও বাঁচলো না! বাচ্চা সহ মারা গেলো!

উদয় চুপ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বললো— ডিজিল্যাব হাসপাতালেই তো? কত নাম্বার কেভিনে?

— ৭৭, কেনো? আচ্ছা আমার সময় নেই। পরে কথা হবে। তুমি ফারাযের ব্যাগ টা জলদি দিয়ে যাও।

— আচ্ছা লক্ষ্মীটা।

— ঢং, রাখছি।

উদয় তাড়াহুড়ো করে ফারাযকে ব্যাগ দিয়ে হাসপাতে যায়। ৭৭ নাম্বার কেভিনে গিয়ে দেখে। এই সায়েরা আক্তার আর কেউ নয়। তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা, স্ত্রী এবং ছেলের আম্মু'ই!

সায়েরাকে দেখে নিজের অজান্তেই উদয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো— দুর্ভাগ্য তোমার সায়েরা। এতো ভালো একটা মেয়ের রক্ত নিয়েও বাঁচতে পারলে না। পরপারে আল্লাহ্ তোমাকে ভালো রাখুক।

#জীবনের_চাকা

~ সিয়াম আহমেদ জয়।


Shohag333

79 Blog posts

Comments