প্রেম ও আমি...

তাহলে আপনিই শিহাব?’ নিজের নাম শুনে মাথা তুলে তাকালাম। দেখি, সুন্দর মুখের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। হাতে

মুখ তুলে চায় ভাগ্যদেবতা।

 

অবশেষে সেই দিনটির সাক্ষাৎ পেলাম।আকস্মিকভাবেই পেলাম। ঘড়ির কাঁটায় তিনটা বাজবে বাজবে করেও বাজছে না। এমন সময় একটা কল এলো ফোনে। শুয়ে ছিলাম, তাই চোখ বন্ধ করেই রিসিভ করি। তখন চিকন একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল—‘হ্যালো, শিহাব বলছেন?’

 

‘হ্যাঁ, বলছি। ’ গলার মধ্যে হঠাৎ নারীকণ্ঠ শোনার মতো একটা আশ্চর্য ভাব ফুটে উঠেছে।

 

‘চিনতে পারছেন আমাকে?’ আরে, আজব তো! নিজে ফোন দিয়ে আমাকেই বলে কিনা তাকে চিনতে পারছি কিনা। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নম্বরটা দেখে নিলাম। না, এ নম্বর আমার অপরিচিত। তবু স্বীকার করলাম না। চিন্তা করার জন্য কিছুটা সময় নিলাম। এই কয়েক দিনে কাকে কাকে নম্বর দিয়েছি মনে করার চেষ্টা করছি। তবু কিছু কিনারা করতে পারলাম না।

 

‘চিনতে পারলেন না তো? জানতাম চিনবেন না। ’ ওপাশ থেকে বলা হলো।

 

‘কে? সন্ন্যাসী?’ কণ্ঠে সন্দেহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম।

 

হাসছে কণ্ঠটা। ‘হুম্, আমি। চিনলেন কিভাবে?’

 

‘বুঝতে হবে। চিন্তা করে বের করবেন। ’

 

অত চিন্তা করার সময় নেই। তার পরের মিনিট পনেরো তুমুল আগ্রহে অনেক কথাই সে বলল। তার পরিবারের কথা, পছন্দের গানের কথা, ভালো লাগা রঙের গল্প—আরো কত কী! 

 

কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছিল, তাই শুধু শ্রোতার ভূমিকা পালন করে গেছি আমি। শেষে বলল, ‘আমার এক আত্মীয় ফোন দিয়েছে, আপনাকে রাতে ফোন দেব কেমন। ’ বলেই আকস্মিকভাবে ফোনটা রেখে দিল। খুব ভালো লাগছিল তখন। মনে হলো, যেন কত অমূল্য কিছু পেয়ে গেছি আমি। 

 

সত্যিই আমি পেয়েছিলামও। সেদিন থেকে টানা তিন মাস আমাদের কথা চলছিল। মান-অভিমানও কম হয়নি। আবার মিটেও গেছে। এর মধ্যে হৃদয়ের কত আবেগ দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে আরো গাঢ় হয়েছে আমাদের প্রেম। একদিন কথা না বললে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত বুকটা। আজ সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে—বিশ্বাসই হতে চায় না সেটা।

 

‘চুল ছিঁড়বে ঠিক আছে, তবে চারটাই কেন? তার কম বা বেশি কেন নয়?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।

 

সে মুখ তুলে তাকায়। তার দৃষ্টিতে কেমন একটা কালো পতাকা শূন্যতা নিয়ে মিছিলে নামল। বলল, ‘কারণ আছে। শুনবেনই তাহলে?’ তারপর বড় করে একটা দম নিল। দমের সঙ্গে সঙ্গে সাহসও নিল বুঝি কিছু।

 

‘মনে আছে, ফোনে একদিন রাগী গলায় কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে। সেটা শুনে সারা রাত খুব কেঁদেছিলাম আমি। রাতের খাবারটাও খাইনি দুঃখে। কাঁদার জন্য একটা, আরেকটা খাবার না খেতে দেওয়ার জন্য। ’

 

‘মোটে তো দুটো হলো। আর বাকি দুটো? সেটার কারণও শুনি। ’ কৌতুক মনে করে মুচকি মুচকি হাসছি। আমার চোখ থেকে তার চোখ নামিয়ে নিল সে। মাথা নিচু করে আছে।

 

‘কী হলো, বলবেন না?’ আমি তাগাদা দিলাম।

 

হঠাৎ দেখি, তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেলাম। কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে কি আনমনে তাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?

 

কিছুক্ষণ পর ও মুখ তুলল। কান্নায় চোখ জোড়া সিঁদুরের মতো লাল হয়ে গেছে। সত্য বলবে বলে হয়তো চোখে চোখ রাখে শ্রাবণী। তারপর নাক টেনে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি শ্রাবণী নই। ওর যমজ বোন। আমার নাম লাবণী। আমাদের সব কিছু এক, কেবল কপালের কাছের এই দাগটা ছাড়া। ’ ঘোরের মধ্যে সে আঙুল দিয়ে তার কপালের দাগ দেখাল। ‘কলেজে পড়ার সময় বাথরুমে পড়ে এটা হয়েছে আমার। ’

 

‘তাহলে শ্রাবণী কোথায়?’

 

‘শ্রাবণী মারা গেছে। ’ বলেই সে উঠে দাঁড়াল।

 

‘মানে কী?’ আমিও উঠলাম। কথাটা শুনে মনে হলো, নিঃসঙ্গ কোনো বেনামি গ্রহের আকাশ ফুঁড়ে ধপ করে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। হাড়গোড় সব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে দলা পাকিয়ে গেছে। এটা কী শুনছি আমি! সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে এমন কষ্ট দিল। 

 

পাথরের মতো নিঃশব্দে অশ্রু ঝরতে লাগল দুই চোখ ভেঙে। ভেতরের সাগরটিতে বুঝি জোয়ার এসেছে খুব।

 

‘আজ থেকে এক মাস আগে আত্মহত্যা করেছে ও। বিশ্বাস করুন, আপনাকে ও ঠকাতে চায়নি। ’

 

‘তবে আত্মহত্যা করল কেন?’ বাচ্চাদের মতো শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠলাম। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে আমার। 

 

চন্দ্রাহতের মতো একের পর এক চাপড় মারছি বুকে।

 

লাবণী বলল, ‘বেশ কয়েক দিন ধরেই ওর বিয়ের কথা চলছিল। হঠাৎ এক পাত্রপক্ষ এসে পছন্দ করে সেই রাতেই বিয়ে করে নিয়ে গেল ওকে। তার পরের দিন বিকেলে তার লাশ পাওয়া যায় ঘরের তীরের সঙ্গে লটকানো অবস্থায়। এই কয়েক দিন ওর হয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলেছি। পারলে আমাকে মাফ করে দিয়েন। ’

 

তারপর সে আর কী বলেছে, সেটা কানে পৌঁছেনি। কোনো কিছু ভাবার মতো সময় ছিল না হাতে। টুকরো টুকরো করে গড়া এত দিনের স্বপ্নের পৃথিবীটা আমার চোখের অগোচরেই ভেঙে গেল। 

 

এমনই দুর্ভাগ্য আমার, টেরও পেলাম না। হঠাৎ পাগলের মতো এক ভোঁ-দৌড় দিলাম। কোথায় যাব, তা জানি না। শুধু এটুকু জানি, আমাকে দৌড়াতে হবে। দৌড়াতে হবে অনন্তকালের দৌড়।


Shohag333

53 Blog posts

Comments