ষ
রাজনীতি
বাংলাদেশ
অপরাধ
বিশ্ব
বাণিজ্য
মতামত
খেলা
বিনোদন
চাকরি
জীবনযাপন
Eng
By using this site, you agree to our Privacy Policy.
OK
ছবি
সাক্ষাৎকার
ভিডিও
গল্প
গ্রাফিতি
তানজিনা হোসেন
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১: ০০
ফলো করুন
অলংকরণ: এআই আর্ট/প্রথম আলো
অলংকরণ: এআই আর্ট/প্রথম আলো
‘শুনছ? আইমানের অঙ্ক খাতা শেষ হয়ে গেছে। আসার সময় একটা অঙ্ক খাতা কিনে আইনো!’
অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। রেবার ফোন বলে মিটিংয়ের মধ্যেও অনেক কায়দা করে ফোনটা ধরেছিল আবিদ। আজকাল রেবাকে প্রচণ্ড ভয় পায় সে। সামান্যতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে রেবা আজকাল, রেগে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে। জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। নিজের চুল ধরে টানে। তারপর সবকিছু একসময় শেষ হয় কান্নায়—এক তীব্র, সুদীর্ঘ, ভয়ধরানো কান্নায়। সে যখন কাঁদতে শুরু করে, তখন গোটা পৃথিবী যেন চুপ হয়ে যায়। রাতের আকাশে ফ্যাকাশে ছাইরঙা মেঘেরা উড়তে উড়তে থেমে পড়ে। বারান্দার গাছের কালো কালো পাতাদের সরসর শব্দ হঠাৎ থমকে যায়। দেয়ালের টিকটিকিগুলোও অবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ না রেবা থামে, ততক্ষণ চারদিকে কিছুই চলে না। সব অচল, সব স্থবির হয়ে থাকে।
রেবা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঘোলাটে আর অপ্রকৃতিস্থ সেই দৃষ্টি। যেন আবিদকে সে চিনতে পারছে না। আবিদ ওর হাত ধরে, ‘চলো রেবা। বাসায় যাই।’তাই আবিদ ওকে আজকাল ভয় পায়। আজ কি তবে আবার ওর মন খারাপের দিন এল? আজও কি আবার সিনক্রিয়েট করবে রেবা? অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। কি–না–কি করে বসে! আর হ্যাঁ, মনে করে অঙ্ক খাতাও কিনতে হবে ফেরার সময়। স্টেশনারি দোকানটা বাড়ির পথের উল্টো দিকে, বেশ খানিকটা ঘোরা হবে তাহলে। কিন্তু যদি সে বলে কাল কিনে দেব, আজ না, তাহলে আর রক্ষা নাই। ধুর, মিটিং থেকে মন উঠে গেল আবিদের। মিটিংয়ে কে কী বলছে, তাতে আর মনোযোগ দিতে পারছে না। অনেক কষ্টে একটা দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখেছিল বুকে। মিটিং শেষে টয়লেটে গিয়ে দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়ল। সিংকের ট্যাপ খুলে ঝরতে থাকা পানির দিকে অকারণেই চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।
কারণে–অকারণে যখন–তখন রেবা ফোন করে বসে। অদ্ভুত সব বায়না ধরে। যা বলবে, তক্ষুনি তার চাই। যদি বলে আজ আইমানকে নিয়ে ওর পছন্দের চিজকেক খাওয়াতে নিয়ে যাবে, তাহলে তখনই আবিদকে আসতে হবে, তাকে নিয়ে যেতে হবে সিক্রেটস রেসিপিতে। যদি বলে আইমান আজ ওর সঙ্গে ঘুমাবে, তবে আবিদকে তা মেনে নিয়ে কাঁথা–বালিশ নিয়ে চলে যেতে হবে ছোট্ট গেস্টরুমে, বেডরুম ছেড়ে দিয়ে। রাত গভীর হলে আবিদ অবশ্য একসময় চুপি চুপি উঠে আসে গেস্টরুম থেকে, রেবা কী করে দেখতে। কখনো দেখে রেবা আইমানের স্কুল ড্রেস জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে, ডাক্তার ওকে হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ দিয়েছে বলে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না। কখনো আবার দেখে সে মোটেও ঘুমায়নি, তন্ময় হয়ে টেলিভিশন দেখছে, যদিও তাতে দেখার কিছু নাই, চলছে কেবল বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন, তবু নিষ্পলক টেলিভিশনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আবিদ সাধারণত খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রেবাকে দেখে আবার ফিরে আসে চুপচাপ। কিছু বলে না। ডাক্তার বলেছেন কোনো রকম কনফ্রন্টেশনে না যেতে। কিছুদিন এভাবেই চলুক। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার ছয় মাস, এমনকি এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। তারপর হয়তো থিতিয়ে আসবে সবকিছু। কিন্তু সত্যি কি রেবার শোক থিতিয়ে আসবে কোনো দিন?এখন আবিদ ঘরে ঢুকতেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রেবা, ‘খাতা আনছ?’
শার্ট খুলতে খুলতে আবিদ বলে, ‘হুঁ।’
‘দাও, দাও। স্কুলব্যাগে এখনই ঢুকায়ে রাখি। এই সপ্তাহে অঙ্ক পরীক্ষা। ছেলের কাণ্ডজ্ঞান দেখো, আমাকে বলে নাই। আমি শুনলাম রুম্মানের আম্মুর কাছ থেকে।’
আবিদ আস্তে করে বলল, ‘রেবা, এক কাপ চা খাব। মাথা ধরছে।’
হুট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রেবা, ‘চা? ওহ, চা? আচ্ছা, দাঁড়াও। দিচ্ছি। আইমানের স্কুলড্রেস ইস্তিরি করতেছিলাম। কাজটা শেষ করে দিই? তুমি একটু ড্রয়িংরুমে বসো।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবিদ বলে, ‘ঠিক আছে।’
জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরে টিভি ছেড়ে বসে আবিদ। চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টাতে থাকে। সব চ্যানেলে একই খবর। রক্তাক্ত জুলাইয়ে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে। কীভাবে ঠা-ঠা-ঠা করে গুলি করা হয়েছে ছোটদের ওপর। কীভাবে লাশ ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে ট্যাংকের ওপর থেকে নিচে পিচঢালা রাস্তায়। কীভাবে লাশগুলো কোরবানির চামড়ার মতো ছুড়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছে ভ্যানের ওপর। দম বন্ধ হয়ে আসে এসব দেখলে। মাথার ভেতরটা কেমন ওলট–পালট হয়ে যায়। আবিদ খালি চ্যানেল পাল্টাতে থাকে। আর কোনো খবর নেই দেশে? ধুস শালা! খালি মৃত্যু আর মৃত্যু! খালি লাশ আর লাশ! চ্যানেল পল্টাতে পাল্টাতে আল–জাজিরা চলে এলে গাজার আরও আরও শিশুর লাশের ছবি দেখে তার মাথা সত্যি গরম হয়ে যায় এবার। টিভিটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা করছে। নাহ্, কালই টেলিভিশনটা এখান থেকে সরায়ে ফেলবে। ড্রাইভার জসিমকে দিয়ে দেবে ওটা। এই জীবনে আর টেলিভিশনের দরকার নেই তার। তাদের জীবনে সব সংবাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।