শনি
পুরবী বসু
এবারও বিয়েটা ভেঙে গেল। শুনে খারাপ লাগল। আমার ছোটবোনের বড় মেয়েটির বিয়ের কথা বলছি। দেখতে-শুনতে দেবযানী
বেশ আকর্ষণীয়। ছিপছিপে লম্বা চেহারা। ভালো করে ওর দিকে তাকালে অবশ্য লক্ষ্য করা যাবে, ভিন্ন ভিন্নভাবে মুখাবয়বে বিশেষ উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই। চোখ, নাক, মুখ, ঠোঁট, কোনো কিছুই এককভাবে এমন আহামরি সুন্দর কিছু নয়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যা অনেকক্ষণ ধরে দেখা চলে। কিন্তু সব মিলিয়ে একটা কোমল স্নিগ্ধতা লেপে আছে সারা মুখমণ্ডলে। আর আছে ওর উজ্জ্বল দ্যুতিময় ত্বক। নরম, কুচকুচে কালো গোছাভরা চুল। সেই সঙ্গে বুক, কোমর, নিতম্বের পারস্পরিক সাযুজ্য। সব মিলিয়ে দেখতে ভালো দেবযানী। মিষ্টি একটি মেয়ে যার কথাবার্তা, চলনও বেশ ধীর, স্থির, শালীন; যেমন সাধারণত পছন্দ করে পাত্রপক্ষের অভিভাবকরা। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের জবাব দেখেশুনে ডাকা এ পর্যন্ত পাত্রও এসেছে বেশ ভালো ভালোই। পাত্রপাত্রী দেখাদেখির প্রাথমিক পর্যায়ে অধিকাংশ সময়েই দু'পক্ষেরই দারুণ পছন্দ
• অলঙ্করণ: বিপ্লব সরকার
হয়। কিন্তু আরও এগোবার পরে কোনো না কোনো কারণে, শুনে মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে অতি তুচ্ছ কারণে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না। হয় পাত্রপক্ষ নয়তো পাত্রীপক্ষ বিয়ে ভেঙে দেয়। বেশিরভাগ সময়েই পাত্র অথবা পাত্রী নিজেই অগ্রণী হয়ে তা করে। এমনি ধারাই চলে আসছে গত প্রায় এক বছর ধরে।
বুলবুলির, মানে আমার ছোট বোনটির মন বড়ই বিষণ্ণ এজন্য। আরও বেশি কষ্ট তার, কারণ ওর ছোট মেয়েটি যে দেখতে তার বড় বোনের মতো লাবণ্যময়ী নয়, কিন্তু একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে, দু'বছর আগেই নিজের পছন্দমতো এক আইটির ছেলেকে বিয়ে করে বসে আছে। ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় দেবযানীর বিয়ে এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে পরিবারের সবাই, মানে আমার অন্যান্য ভাইবোন-ভাগ্নেভাগ্নিরা যুগপৎ চিন্তিত ও হতাশাগ্রস্ত।
আমার নিজের একটিই মেয়ে। বয়স একচল্লিশ। ডাক্তার। স্থির করেছে বিয়ে করবে না, যেটা আমার কাছে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো মহাসর্বনাশের সংবাদ বলে কখনও মনে
গল্প
হয়নি। আমার স্বামীর কাছেও নয়। যদিও মেয়েটি বিয়ে করলে, ওর পাশে সার্বক্ষণিকভাবে কেউ থাকলে, নিঃশর্তভাবে ভালোবাসার একজন জীবনে-এ পারলে আমরা নিশ্চিমানুষ রয়েছে শুর জীবনে এ কথা জানতে বিয়েটা যদি মনমতো মানুগের। তবে সেই সঙ্গে এটাও মাড়ি। একটি সুস্থ বিকল্প সন্দেহ নেই।
ফেলে যতবারই দিয়ে ভেঙে যায় দেবযানীর, আর আমার কাছে মাথানত করে তার মাতঙে যায় দেবযানীর, আর আমার মতো শুকনো গলায় বলে, মাথাামার কনি সহোদরা, অপরাধীর হেসে বলি, তাতে কী বলে, এবারও বিয়েটা ভেঙে গেল'। আমি ভিন্নতাগুলো বেরিয়ে পড়লে বিয়ে হওয়ার পরে এইসব পার্থারও বেশি জটিলতা হতো তখন। এ এক রকম ভালোই হয়েছে। বিয়ের আগেই এই সব বিভেদগুলো ধরা বিয়ে ভেঙে গেছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও অলোক তালেগোত্রের সঙ্গেই ওর বিয়ে হবে। এত দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
আমি রাজধানীতে বাস করি। একটি প্রাইভেট ফার্মের মোটামুটি বড় কর্মকর্তা। মাইনে খারাপ নয়। স্বামীও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। ঢাকা শহরেই আমাদের দুটো বাড়ি আছে। আসলে একটি বাড়ি, একটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়াও গ্রামে আছে বেশ কিছু জায়গা-জমি ও একটা পাকা বাড়ি। যেখানে বছরে একবার করে গিয়ে থেকে আসি শীতকালে। টাটকা খেজুরের রস পান করা অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আরেক আকর্ষণ জানালা দিয়ে মাঠের পর মাঠ দিগন্তজোড়া গাঢ় হলুদ রঙের শর্ষে ক্ষেত দেখা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জুড়িয়ে যায় আমার।
আমার সংসারে সচ্ছলতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। ফলে আমার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রায়ই আমার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেয়। আমি নিজেই তাদের উৎসাহ দিই এই ব্যাপারে। তাছাড়া আমার ছোট যে তিন ভাইবোন, ওদের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য অনেক। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পরে ওদের আর্থিক সব। দায়িত্ব আমিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছিলাম, যে দায়িত্ব। নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি এই বছর চার-পাঁচ আগে পর্যন্তও। এখন অবশ্য ছোট দুটো ভাই-ই রোজগার করে। আর বুলবুলির
তো বিয়ে হয়ে গেছে কত আগেই। এই তিন ছোট ভাইবোনের কাছে আমি তাই পিতৃতুল্য। এর মধ্যে একদিন বুলবুলি আমার বাসায় আসে। চুপি চুপি
আমার কাছে ২০ হাজার টাকা চায়। বলে, দেবযানীর ফাঁড়া কাটিয়ে সমূহ দুর্ভাগ্য থেকে তার পরিত্রাণের প্রার্থনায় বড় করে একটা পুজো দিতে হবে। শনি ও সত্যনারায়ণের পুজো। তার। জন্যই টাকাটার দরকার। তার হাতে এই মুহূর্তে যে টাকা আছে। তা যথেষ্ট নয়, এত বড় পুজোর আয়োজনে। বেশ কিছু হিতাকাঙ্ক্ষীকে খাওয়াতে হবে সেদিন। দেবযানীর ওপর নাকি কারও অভিশাপ, কারও বদ-নজর পড়েছে। সেটা কাটাতে না পারলে ওর বিয়ে হবে না। পুরোহিত কথা দিয়েছেন খুঁজে বের করবেন সেই পাপিষ্ঠটি কে, যে এই রকম মহা ক্ষতি করে চলেছে এই নিষ্পাপ মেয়েটির। আর সেই সঙ্গে গোটা পরিবারটিকে
ভোগাচ্ছে দিনরাত। আমি হাসি: বোনের পাগলামি দেখে আসলেই না হেসে
থাকতে পারি না। মনে মনে ভাবি, একেই বোধ হয় বলে অপত্য স্নেহ। মানুষকে অযৌক্তিক করে দেয়; অন্ধ বানিয়ে ফেলে এই বাৎসল্য। হাসতে হাসতেই বলি, 'তুই কেমন করে যে এমন কুসংস্কারে বিশ্বাস করিস? বুঝতে পারি না।'
সঙ্গে সঙ্গে বুলবুলি বলে ওঠে, 'আমার মতো অবস্থা হলে তুই বুঝতি দিদি।'
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে দিই। বুলবুলিকে। মনে মনে বলি, এমন করে কতদিন পুরোহিতরা ধাপ্পা দিয়ে টাকা নেবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু পুজো। কবে হবে ইত্যাদি কিছুই জানতে চাই না। ওরাও কেউ কিছু বলে না আমায়। প্রায় ৫০ জনকে খাওয়ানো হবে। ভেবেছিলাম আমাকেন বলবে। নেমন্তন্ন না পেয়ে ভাবি, হয়তো ঘরের
ক্রীয় লোকজনকেই এই বিশেষ পুজোয় ডাকতে 2024.10.19 15:21 কালের যেয়া
হয়, খাওয়াতে হয়। কে জানে? এই ব্যাপারে আমার আন সীমিত, অস্বীকার করব না। টাকাটা নেওয়ার সপ্তাহ খানেক পরের কথা। হন্তদন্ত হয়ে বুলবুলি আমায় ফোন করে। জোরে জোরে নিয়ে খুবই উন্মোখা ফোনের এধারে বসেও স্পষ্ট শুনতে পাই। বুঝাইরে। শনিবার। বুলবুলি। তখন ভরা দুপুর। খটখটে রোদ ছুটির দিন। এ রকম দিনে সকালে যেহেতু দেরি করে ঘুম থেকে উঠি, আর চা ছাড়া সকালে আর কিছুইর ফেলি। সেদিনই তাড়াতাড়িই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফেলিামি শুনিয়ে শুয়ে শুয়ে একটি বই পড়তে পড়তে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার গৃহসঙ্গী তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফোনের
শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দিদি। কাল রাতে সেই শনি আর সত্যনারায়ণের পুজো হয়ে গেছে। আজ দুপুরে লোক খাচ্ছে। পুরোহিত এসেছে। তার নাকি কিছু কাজ এখনও বাকি।'
একটু থেমে বুলবুলি হঠাৎ বলে ওঠে, 'তুই আমার বড় মেয়েটাকে একটু ভালো করে আশীর্বাদ কর দিদি। ওর যেন বিয়ে
হয়ে যায়। বুলবুলি যেন আর্তনাদ করে ওঠে। ওর গলার স্বরে সকাতর প্রার্থনা। মিনতি। আমি চমকে উঠি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে
আমার কনিষ্ঠ সহোদরা। ওর কণ্ঠস্বর শুনে বুঝি, কাছে থাকলে এতক্ষণে আমার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত সে, যদিও সে ভালো করেই জানে পায়ে ধরে প্রণামকে কী পরিমাণ অপছন্দ করি আমি। আজ ওর গলার আওয়াজ আর বলার ভঙ্গি থেকে বুঝতে পারি বুলবুলি বড়ই বিপন্ন। আমার মুখে কোনো কথ্য জোগায় না। কী বলব ওকে ভেবে পাই না।
'দোহাই তোর দিদি, সব ভুলে ওকে তুই আশীর্বাদ কর। ওর যেন শিগগিরই ভালো বিয়ে হয়।' আমি এতক্ষণে নিজেকে কিছুটা একত্রিত করে নিই।
প্রাথমিক ধাক্কাটা হজম করার চেষ্টা করি। বলি, 'সে কি রে? আমি তো সবসময়েই চাই ওর একটা ভালো বিয়ে হোক। আজ আবার নতুন করে সেটা বলতে হবে নাকি?' আমার বিস্মিত, বিচলিত কণ্ঠ এতটুকুও নিরুৎসাহী করতে
পারে না বুলবুলিকে। সান্তনাও দেয় না মোটেই। একই রকম স্বরে বলে, 'দিদি। তুই যদি ওর ওপর কোনো কারণে মনোক্ষুণ্ণ হয়ে থাকিস?, ওকে ক্ষমা করে দে। যদি তোর রাগটা সরিয়ে না নিস?, মনের মধ্যে পুষে রাখিস?, যদি ওকে মন খুলে আশীর্বাদ না করিস?, ঠাকুরমশাই বলেছে, ওর আর বিয়ে হবে না।' বুলবুলি ফোনে কাঁদতে শুরু করে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে
কাঁদতে শুর নাক ও মুখের জল একাকার হয়ে হাঁপানির মতো টান উঠতে থাকে, যেমনটা হতো ওর ছেলেবেলায়। 'দিদি, একমাত্র তুই-ই পারিস? ওর এই ফাঁড়া কাটিয়ে
উঠতে সাহায্য করতে।' আমি কী বলব, কী বলা উচিত এখন ঠিক করতে পারি না। আশীর্বাদে যদিও কোনো বিশ্বাস নেই আমার, তবু শুধু বুলবু-
লিকে শান্ত করার জন্য বলি, 'আমি দেবযানীকে আশীর্বাদ করছি বুলবুলি। আমার অজান্তে ওর ওপর যদি কোনো রাগ, ক্রোধ থেকে থাকে আমার, যদি কখনও কোনো কুনজর দিয়ে থাকি, সব তুলে নিয়ে, সব ভুলে গিয়ে আমি আজ সর্বান্তকরণে চাইছি, ওর বিয়ে হোক। ওর ভালো বিয়ে হোক। আমি যা বলছি, মন-প্রাণ দিয়েই বলছি। বুকের ভেতর থেকে কথাগুলো বলছি। সব সত্যি কথা। তুই বিশ্বাস কর।'
বুলবুলি খুব খুশি হয়ে ওঠে। আওয়াজ পাই, ভালো করে গলা, নাক, চোখ, মুখ পরিষ্কার করে নিচ্ছে। বেশ শব্দ করেই।
তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে, 'যাই ঠাকুরমশাইকে বলে আসি।' আমার যা বলা দরকার সব বলা হয়ে গেছে। আমি আর তাই হুবলি না। কিছু
বুলবুলি আবার বলে, 'বাই দিদি।'
বলেই ঠাকুরমশাইকে খবর দিতে ছোটে।
আর অন্য প্রান্তে হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতোনের অন্য প্রায়ো রিসিভা