তুলি-কলমের সওয়ারি রব
প্রায় সব ছবিই নাম-পরিচয়হীন। নাম দিলে তার। দাম থাকে না। অর্থ দিলেই সবচেয়ে বেশি অনর্থ হয়। যারা তার ছবির নাম দিয়েছিল, তাদের অনেক অম্ল-মধুর কথা শুনিয়েছেন কবি: কটাক্ষও করেছেন। কিন্তু নিজেই যখন নিজেকে এঁকেছেন তারও কি পরিচিতি লেখা যায়। প্রশ্নবিদ্ধ নিরুত্তর দ্বিধার কুহেলিকার জাল ছিড়ে সে-আমির আবরণ খুলে বিশ্লেষণ করে দেখি যে, রবীন্দ্রনাথও অচেনা। আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যেও যেন তিনি তার পরিচিত রূপ আত্মগোপন করেছেন। অবয়বটা যেন তার উপলক্ষ মাত্র: তাকে ভর করে কবি অন্তরের অতল কন্দর খুলে দেখিয়েছেন জলের নিচের অভূতপূর্ব আগুন। আত্মপ্রতিকৃতির চিত্রী রবীন্দ্রনাথ মানুষের সভ্যতার নেতির লীলা দেখে কি বিমূঢ়? দুঃখমথিত শূন্য দৃষ্টি কবিকে আমরা পেয়েছি জীবনের অন্তিম প্রহরে দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত ছন্দে রচিত মৃত্যুগন্ধী পঙক্তিমালায়। কবি তখন জেনে গেছেন এ পৃথিবী স্বপ্ন নয়: প্রবঞ্চনার জাল ছিন্ন করতে হলে সত্যকে ভালোবাসতে হয়। তবু জীবন সমাধানহীন। তাকে প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পায়নি এবং শেষ দিনের সূর্যের কাছেও তিনি নিরুত্তর।
দুই, শুরুতে চোখ-চেনা ছবি তার মন কেড়েছিল। প্রশংসা করেছেন বাড়ির দেয়ালে টাঙানো রবি বর্মার পৌরাণিক ছবির। তাতে স্বদেশীয় ভাব ছিল বলে আরও বেশি পুলকিত হয়েছিলেন। তখন বয়স বাইশ। নদীপাড়ের পলির মতো অতি দ্রুত ছন্দ ও সুরে ভরে উঠত মন। আরও কিছুকাল কেটে গেল। ঘুচে গেল সে ছবির বিমুগ্ধতা। দুঃখের আঁচে পুড়তে শুরু হলো জীবন। নিজের পাণ্ডুলিপির দিকে তাকিয়ে মনে হলো তার শব্দ ছাড়াও সাদা কাগজের গায়ে আরও ভাষায় কথা বলা যায়। কাটাকুটিগুলো যেন বলে- আমাদের একটা রূপ দাও, মুখ দাও, ভাষা দাও। সেই সাদার বিপরীতে কালোর লীলা দেখেই কবিতার পাণ্ডু- লিপিতে ভূমিষ্ঠ হয় চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ছবি আঁকার বিদ্যাটা
জানা হয়নি। শৈশবে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গৃহশিক্ষকদের মধ্যে ছবি আঁকা শেখানোর শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তখন চিত্রদেবীর বাণু পরিমাণ অনুগ্রহ পাননি। বয়স যখন চল্লিশ ছুঁই, তখন আর কারও অনুকম্পা প্রত্যাশা করলেন না। যে কথা শব্দে লেখা যায় না, সুরে অনুবাদ করা চলে না; তাকে পেতে তার নিজস্ব পথ আবিষ্কার করতে হবে। শব্দ নয়, সুর নয়ং ইমেজের শক্তিকে আলিঙ্গন করার জন্য ব্যাকুল হলেন কবি। যে করেই হোক, আমি চাই ছবির মধ্যে আমার আমিকে ফুটিয়ে তুলতে। এই বোধ-তাড়িত কবি জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখলেন, 'যত পেন্সিল চালাচ্ছি তার চেয়ে ঢের বেশি রবার চালাতে হচ্ছে সুতরাং ওই রবার চালানোটাই অধিক অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। বোঝা গেল, সৃজনের নতুন ঘোর ভর করেছে রবির চৈতন্য আরও পরে তিনি এই মীমাংসায় পৌঁছলেন, 'মাতনের মাত্রা অনুসারে বাণীর চেয়ে গানের বেগ বেশি, গানের চেয়ে ছবির।'
হেমন্তবালাকে লেখা চিঠি, ১৯৩১) কাটাকুটিগুলোর নাম দিয়েছিলেন কবি 'হিজিবিজিবিদ্যা' এই বিদ্যা তাকে আত্মার স্বয়ংচালের নতুন নিয়ম শিখিয়েছে
পাণ্ডুলিপি কাটতে কাটতে তিনি অন্ধকারের দীর্ঘ দেহ আঁকলেন তারপর মনে হলো, এই অন্ধকার কে, কী দিয়ে তাকে চেনাবেন। শেষে তাতে চোখ ফোটালেন। কোথাও সাদা ফুরিত হলো। অন্ধকার-অঞ্চলটার এদিক সেদিক যোগ করলেন আরও জ্যামিতি। এই জ্যামিতি কখনও হলো পাখির ঠোঁট অথবা রাক্ষুসে হাঁ-করা আদিম প্রাণীর মুখ। কখনও আবার কেবলই সৃর্পিলতা। রেখারা পেঁচিয়ে উঠছে। সাপের সঙ্গম চলছে; তীক্ষ্ণ ঠোঁটের পাখিদের শীৎকার। অবচেতনের কুজুটিকা থেকে আরও কত তৃষ্ণার লকলকে জিহ্বা, আরও কত চাওয়ার হলকা, অগ্নিময় শিখার লেলিহানতা। এসব রেখা ও রূপের স্বাধীনচারিতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ এক বিমূর্ত শিল্পভাষারই স্বরলিপি রচনা করেছেন। এই হিজিবিজিবিদ্যা তার ছবি আঁকার প্রথম আয়োজন নয়,
পার্ট২:২