তুলির কলমের সওয়ারি রবি ২

মঈনুদ্দিন খালেদের লেখা গল্প

শিক্ষানবিশি নয়। হাত মকশো করারও নয়। শিল্পের এ এক নতুন। ভাষা। তিনি হবি আয়কশো করারও নজরে ঘর থেকে নতুন পান্ডুলিপিতে চিত্র রউন্যার শুরুতে। অক্ষর ও ইমেজের সম্মা রবীন্দ্রনাথ যে শিরচনা করেছেন। তার দৃষ্টায় তার সমীকরণে পৃথিবীতেও হয়তো নেই। নিতেনাগ যদি শুধু পাগুলিাল চিয়ই করতেন আর ছবি করেন, তবে সেই পাণ্ডুলিপিচিত্রী। হিসেবেই মৌলিকভার বিনা নিয়ে শিল্পের ইতিহাসে সম্প্রপিচিত্রী ঠাঁই পেতেন। নাম-পরিচয়হীন ছবিদের নিয়ে অনেক কাল। গোপন জীবন কেটেছে কবির। অর্থহারা এ ছবির ভাষা তো কেউ। বুঝবে না। কলমের নিখ বেয়ে কারা নেমে এলো সাদা কাগজের। গায়ে। কেবলই মনে হতে লাগল, তার ছবি ছবিই। এর কোনো বিকল্প বা সমার্থক উপায় নেই। রেখার বিচিত্র চাল আরকানো স্বাধীনতা- এই তো চিত্রশিল্পের গভীরের কথা। পেঞ্চর স্বাধীনতার শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। কদি। শেষ পর্যন্ত পেরুতে যাওয়া হলো না। কেউ বলেন লেন পথে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে আর্জেন্টিনার বুয়েনবি অ্যায়ারসে নেমে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়িতে উঠেইয়েনস। কারও গবেষণা ভিন্ন। তখন পেরুর শাসক ছিলেন দুঃশাসক। কবি দুষ্ট শাসকের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার কৌশল হিসেবে

 

অসুখের জুতো দেখিয়েছেন। দক্ষিণ আমেরিকা যেতে যেতে কবি মায়া আজটেক সভ্যতা। ও ওই মহাদেশের ইতিহাস এবং নানা বিষয় সম্পর্কে লেখারই

 

পড়ছিলেন। আর তখন লিখছেন কাব্যগ্রন্থ পরবী। এই কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে নরম কবিতার মতো দৃষ্টিনন্দন ইমেজ এঁকেছিলেন কবি। একটি পাখির ছবি যেন কবিতার চরণই কাকলিত করছে, 'শোনো শোনো ওগো বকুল বনের পাখি/দেখ। তো, আমায় চিনিতে পারো নাকি। তারপর কবির তুলি-কলম। থেকে অনেক পাখি ডানা ঝাঁপটাল, সাদা স্পেস ছিড়ল পাখির। ধারালো ঠোঁট, দীঘল গ্রীবা প্রসারিত করে অন্ধকার বিদীর্ণ করে। প্রকাশ পেল আরও পশুপাখি। চেনা জগতের সঙ্গে আর কোনো সহজ যোগ রইল না তার ছবির। ওকাম্পোর চোখকে নিষেধ জানানো সম্ভব হলো না কবির। কবিভক্ত এই নারী ছবি দেখে। বিস্মিত হয়ে চিত্রকর কবিকে জানালেন এই তথ্য যে, এখন নাকি। ইউরোপে এ ধরনের ছবিই আঁকা হচ্ছে। অজ্ঞাত কুলশীল নাম- গোত্রহীন ইমেজের আধিপত্য চলছে সমকালীন শিল্পে বর্তমান বিশ্বে। মানুষের অস্তিত্বে মহাযুদ্ধের চাপে যে প্রদাহ জন্মেছে, তার কারণেই নাকি এসব অদ্ভুত ইমেজের নির্ভরতায় অবচেতনের ভয় উঠে এসেছে চিত্রশিল্পে। ওকাম্পো হয়তো কবিকে এক্সপ্রেশনিস্ট

 

শিল্পের কথাই জানিয়েছিলেন। তিন. ছবির রবীন্দ্রনাথ অস্থির, তপ্ত। কবিতার রবীন্দ্রনাথ শান্ত, সমাহিত। কবিতার রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের বাণীতে সব।

 

ক্ষত ও ক্ষরণে শুশ্রূযার প্রলেপ দিয়েছেন। এসব প্রবচন এখন ভেঙে গেছে। কবিতার রবীন্দ্রনাথ ও ছবির রবীন্দ্রনাথ একই মানুষ। আমাদের মনে রাখতে হবে, 'সোনার তরী', 'চিত্রা', 'কল্পনা'র রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকছেন না। ছবি আঁকছেন সেই কবি, যিনি সোনার বাংলাকে প্রণতি জানালেও উগ্র জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করছেন। ওদিকে ইংরেজের বর্বরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, যুদ্ধের আগুনে পুড়ে মানুষের সভ্যতায় যে তার আস্থার ভিত ছিল, তাতে ফাটল ধরেছে। একটি মহাযুদ্ধের বারুদের গন্ধ বাতাস। থেকে মিলিয়ে না যেতেই আরেকটি মহাযুদ্ধের বিষবাষ্পে নীলাকাশ কালো হয়ে উঠছে। বিপ্লবীদের সমর্থন করে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন,

 

"নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,'

 

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-"

 

চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই উপনিষদের বাণীমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ নন। মায়াবনবিহারিণী হরিণীর কবি বা চিত্রকর নন।। চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ বনপোড়ো হরিণ; যদিও শুধু ছবি নয়, কবিতাও তার সেই আগুনে পুড়েছে।

 

এত পাখি কেন, এত কেন মানুষের মুখ, এত কেন দুঃখ সমাচ্ছন্নতা, কেনই বা এত পরিহাস, কেন এত আদিমতা, কেন। ও বিচিত্র প্রকাশ, কেন মানব অস্তিত্বের এত সব

 

 

বিচিত্র ভাব, বিকার ও খেয়াল কবিচিত্রকর পরিচিত ভাষার সূতে বিদিশ করলেন না। এ বিস্ময় নিয়ে যখন তা মনের বিচিত তাকাই, তখন বিচিত্র বোধে আন্দোলিত কাউনর বিচিত্র নদীরই রূপায়ণ দেখি তার ছবিতে। তিনি যেন প্রকৃতি ব্রান্ডেলাখি, মানুষ কোনো কিছুই বিষয়ের গুরুত্ব আরোপ দেওণ করে আর প্রধানত সভ্যতার নাভিশ্বাস ওঠা অবস্থাকে পর্যবেদনের অবস্থার বাক্তিজীবনের সামুহিক ভাঙচুর আত্মস্থ করে মনের অবস্থাটা শনাক্ত করেছেন তার চিত্রকলায়

 

সমাহিত অবস্থা খুব একটা নেই। চঞ্চল খেয়ালি যে পাখিতে তিনি ভর করেছেন মনের প্রতিনিধি হবে বলে, দেও কখনও সুদর্শন পালকের পাখি নয় জানা মেশা শরিয়ডোর আঘাত আছে রি পালকের বিস্তার নেই। রাশি রাশি শক্ত ঠোঁটের আঘাত আছে, বিচিত্র কাকলির অর্কেস্ট্রা আছে। যে পাখিটি চুপচাপ বসে থাকে। সেও উফ। উষ্ণতার জন্ম হয়েছে রঙের আচরণে। হলুদ ও কালোর বিবাদে সে পাখিও স্বাভাবিক চেনা সুন্দরের শাস্তি দেয়না চোখে। আদিমতাকে তিনি প্রত্যাশা করেছেন। কারণ দুরাতীত চোখে এমোদি স্বাধীন ছিল মানুষের মন। আর সেই আদিমতায় আমাদের পূর্বপুরুষের রক্ত কথা বলছে। কালো অন্ধকারের বিপরীতে চিকন আলোর রেখা আর সামান্য লাল ঝোপে অদ্ভুত দর্শন প্রাণী এঁকে কবি বললেন,

 

বিকম প্রাযুগে গুহাবাসীদের মন/যে ছবি লিখিত ভিত্তির কোণে/অবসরকালে বিনা প্রয়োজনে/সেই ছবি আমি আপনার মনে করেছি অন্বেষণ।

 

অবচেতনের গুহা, আদিমতা এসব প্রেক্ষিত বিবেচনা করে কবি স্বভাবতই কালোর রহস্য ভেদ করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ছবি মূলত অন্ধকারে ডোবানো। মনে হয়, কালোর শরীর কেটে আলো বের করা হয়েছে। অর্থাৎ সাদা রেখা টেনে ইমেজ পরিস্ফুট করা হয়েছে। এ কথা অনেকেই জানেন, নারীরা তার বিমূঢ়, অবগুণ্ঠিত, দ্বিধায় জড়ানো। বৌঠান, ওকাম্পো অথবা অন্য কোনো প্রেমময়ী প্রেরণাদাত্রীর অবয়ব তিনি চিত্রার্পিত করেননি। তবে নারীর প্রশ্নবিদ্ধ চোখই চিত্রকর কথির ছবির বিশেষ ভরকেন্দ্র। সেই চোখে হৈচৈ করে কোনো চাওয়া নেই, শুধু স্তব্ধ চাহনি আছে। এই স্তব্ধতাই তো দুঃসহ। নারী চিত্রে

 

রবীন্দ্রনাথ সেই দুর্বহ মনটা এঁকেছেন। নারীরা স্বস্তিত, তবে পুরুষেরা সরব, উজ্জ্বলতর। তারা কোনো কুণ্ঠা-জড়িত নয়, তবে তাদেরও মুখে চিন্তার ভার আছে,

 

অস্তিত্বের তাপিত অবস্থারই রূপায়ণ ওই সব মুখ। তবে নারী ও পুরুষ, উভয়েরই অনেক নাটকীয় দেহ আছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চায়। হয়তো নাটকের অভিনয়ে মানুষের দেহ সংস্থানের বিচিত্র চাল কবিকে মানবদেহের নতুন জ্যামিতি পাঠ করিয়েছে। চিত্রকর কবি মুখ এঁকেছেন, মুখোশও এঁকেছেন। মুখোশ মানুষের আদিমতম শিল্প। মুখের চেয়ে মুখোশেই মানুষের মন অপেক্ষকৃত বেশি মুখর। যতই দুর্গম হোক মানুষের মন, অতল- অবচেতনের অভিযানের বর্ণনা যতই দুঃসাধ্য হোক, তবু সে জগৎই চিত্রে প্রকাশ করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। অচেনা- আমির অভিব্যক্তি বারবার ফুটে উঠেছে তার চিত্রতলে।

 

সৃজনচেতনা কি স্পর্শমণি? সেই পরশপাথরে ছোঁয়ায় কি সবকিছু প্রাণ পায়, রূপ পায় আর পায় গতি! রবীন্দ্রনাথ পশুপাখি, সাপ, মাছ, প্রকৃতি, স্থাপত্য নকশা, ফুল, লতাপাতা, মানুষ- মানুষীর পাশাপাশি অনেক পাত্র বা আধার এঁকেছেন। এই পাত্রগুলোর কোনোটাই নির্জীব জড়ত্বের কথা বলে না। পাত্রের রূপেও তিনি এমন পরিবর্তন এনেছেন, তাকে আর কোনো বস্তু বলে মনে হয় না। কারণ তারও ঠোঁট আছে, চোখও আছে। আর যে টেক্‌সচারের ঝালর রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাষার সবচেয়ে ডাগর বৈশিষ্ট্য, তাও যুক্ত করেছেন কবি তার এসব পাত্রে। তাতে প্রকাশের জর্জরভাব, প্রাণময়তা- সর্বোপরি গতির দ্যোতনা জন্ম নিয়েছে জড়বস্তুতে। রবীন্দ্রপ্রতিভা আর গতি সমার্থক। গতিময় থাকা মানেই সৃজনের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন। সে। গতির যে রূপ-বৈচিত্রা যা কবিতায়, গানে ও গদ্যে ছিল অসম্ভব, ছবিতেই ছিল তার সম্ভাবনা। চিরনতুনের পিয়াসী রবীন্দ্রমন তাই সওয়ারি হয়েছিল তুলি-ব তুলি-কলমে। .


Salma Akter

233 Blog posts

Comments