একাকী সমুদ্র সৈকতের একটি সন্ধ্যাকে ঘিরে সেরকম রেখাঙ্কিত স্মৃতি আমার জীবনে মহার্ঘ সম্পদ হয়ে আছে। সেদিনের নদী তীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য আমার মনের মনিকোঠায় চিরদিনের জন্য গেথে আছে। এখনো কোন নিঃসঙ্গ একাকী মুহূর্তে শেষ স্মৃতি মনে হলে স্বপ্নিল ওঠে মন, বয়ে যায় অনির্বচনীয় আনন্দের বন্যা।
অনেক আগের কথা প্রকৃতিতে তখন বসন্তের আমেজ । চারপাশটা ফুলের রাজ্য। সুভাষ মাখা বাতাস। ভাট ফুলে তীব্র গন্ধে মাতোয়ারা মেঠো পথ। আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে যাচ্ছি সমুদ্র সৈকতে, সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখতে। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিয়েছি। বন্ধুদের মধ্যে তমাল ও ফুটিক দুজনের বাড়ি পটুয়াখালী। কাজেই পথ চলতে আমাদের কোন চিন্তা নেই। তবে হাস্যকর বিষয় হলো কক্সবাজারে ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা তমালের থাকলেও ফটিক কোনদিন সেখানে যায়নি। তার চেয়েও অবাক কান্ড দু বন্ধুর কেউই সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখেনি। কাজে এসে সম্পর্কে তাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই। এ বিষয়ে ফটিকের প্রশ্ন করলে, ফটিক বলে উঠলো হ্যাঁ বন্ধু, বিশ্বকবি এ কারণেই বলেছেন:
'দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু।'
কবিতার ছন্দের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে বলল, তবে এবারের চান্সটা আর মিস হচ্ছে না বন্ধু। আমরা সবাই হাসতে হাসতে লুটোপুটি। সে যাক পথিমধ্যে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছি। তমাল আমাদের পটুয়াখালী কুয়াকাটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল: পটুয়াখালী জেলার সর্ব দক্ষিণে কলাপাড়া থানার লতা চাপলি ইউনিয়নে কুয়াকাটার অবস্থান। সেখানে দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী আধুনিক গুষ্ঠি রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা দাবি করে যে কুয়াকাটা নামটি তাদেরই দেখা। বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করে নিলে হাজার হাজার রাখাইন দেশ ত্যাগ করে। তাদের একটি দল বঙ্গোপসাগরের তীরে রাঙ্গাবালী দিবে এসে বস্তির স্থাপন করে। সেখান থেকে কিছু রাখা ইন পরিবার বনজঙ্গলা কির্ণ এলাকায় ঢুকে পড়ে তারা স্থানটির নাম দেয় 'কানসাই' অর্থাৎ ভাগ্যকূল, তারপর কুয়া খনন করে ছুপেই পানি পাওয়া গেলে এর নাম দেয় কুয়াকাটা। এসব মজার গল্প আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম। কুয়াকাটার সাগর সৈকত প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ। সৈকতের গা ঘেঁষে চোখে পড়ে বিশাল নারকেল বাগান গঙ্গা নদীর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। দক্ষিণের দৃষ্টি সীমা যতদূর যায় শুধু নীল সাগরের জলরাশি শীতকালে পূর্ব প্রান্তে করে ওঠে অস্থায়ী জেলেপাড়া আর শুটকি মাছের কারখানা। গঙ্গা নদীর চরের কাছে পূর্ব দিকে ছোট একটি খাল। তারও আগে খাওয়ার চর নদী সবকিছু নিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। কুয়াকাটা সাগর সৈকতকে কেন্দ্র করে প্রায় দুইশ একর জমি জুড়ে গড়ে উঠেছে নারকেল বাগান। অনুমতি সাপেক্ষে বাগানের ভেতর পিকনিক করা যায়। নির্জন প্রকৃতির স্বাক্ষর কুয়াকাটা সাগর সৈকত। এসব গল্প করতে করতে কখন যে আমরা কুয়াকাটা পৌঁছে গেছি বলতেই পারবোনা। পৌঁছাতে রাত দশটা বেজে গেল। রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা হলো সেখানকার পর্যটন মডেল হলিডে হোমসের।
ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল বলে সূর্যোদয় দেখা সম্ভব হয় না। কি আর করা আশেপাশের দৃশ্য দেখার জন্য দ্রুত সবাই বেরিয়ে পড়লাম। সিদ্ধান্ত হলো সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখব বিকেলে। তেল চিক চিক চিরল পাতার ঘন নারকেল বাগান পেরিয়ে হাজির হলাম রাখাইন পাড়া। কাছে একটি মন্দির এর ভিতরে রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় অষ্টধাতু নির্মিত ৩৭ মন ওজনের ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি। অবাক বিষয়ে মূর্তির দিকে চেয়ে থেকে আমি নিজেও কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্ন না হয়ে পারলাম না। মন্দিরের নিচেই আছে ঐতিহাসিক কুয়া। রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা চারদিক বাধানো পুরনো এই কুয়ার পানি ব্যবহার করে। কথা ছিল কুয়াকাটা থেকে একটি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল পাত্রার বর্ণ দেখতে যাব। সেখানে যেতে হয় জোয়ার-ভাটা হিসেব করে। ইঞ্জিল চালিত নৌকা ঢেউয়ের ধাক্কায় নাকি তিন চার ফিট উপরে ওঠে। এসব শুনে ভয়ে মুখ শুকিয়ে উঠলো। ওইদিকে হাতেও সময় নেই। সব বিবেচনায় পাত্রার বনে আর যাওয়া হলো না।
দিনের রোদ অঞ্চলের আলো ধীরে ধীরে স্টেজ হতে শুরু করেছে। সূর্যের তাপও কমতে শুরু করেছে আমরা রওনা দিলাম সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার আশায়। ধূসর থেকে হালকা নীল হয়ে ক্রমশ গাড়ো নীল রঙের সমুদ্র সৈকতে মিশেছে। দৃষ্টিনন্দন এই জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখা যাবে সূর্যাস্তের দৃশ্য। কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সূর্যের অস্ত রোশনি পাতে সারা পৃথিবী আগুন বরণ রূপ ধারণ করেছে। নদীর জলে সূর্য রষ্ণী ছড়িয়ে সোনালী রঙের চিকচিক করছে। এক রঙিন খেলায় মেটে উঠে নদীর জল আর সূর্যের রশ্মি। সূর্য রশ্মি যেন আকাশে আলোর মিতালী পাঠিয়েছে। কোথাও সারা শব্দ নেই। নিস্তব্ধতার মধ্যে সবাই সূর্যাস্ত দেখা নিয়ে ব্যস্ত। এক অপরূপ সুন্দর যে নদীর তীর আরো সৌন্দর্যময় হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর স্বতন্ত্র বৈচিত্র নিয়ে স্বপ্নীল হয়ে উঠলো।