এই ছন্দ বদ্ধ কথা দুটি প্রথম শুনেছিলাম দাদার মুখে। তখন আমার বয়স ১৩ কি ১৪। পরিস সপ্তম অষ্টম শ্রেণীতে। দাদু আমাদের খুব আদর করতেন। প্রতিদিন বিকেলে আমাদের একসঙ্গে নিয়ে নানা দেশের রাজ-রাজারাদের গল্প শোনাতেন। কোন রূপকথার কাহিনী নয়। একেবারে সত্য সত্য সব ঘটনা। মহাবীর আলেকজান্ডারের গল্প তিনি জানতেন। ট্রয়ের যুদ্ধের কথা, সক্রেটিস এর কথা, প্লেটোর কথা, মহামানব মনীষীদের কথা বলতেন। যখনই দাদুকে জিজ্ঞেস করতাম দাদু স্বপ্নের চাবি কি? অমনি দাদু আবৃত্তি করতেন ওই দু লাইনের কবিতা। আমরাও দাদুর সঙ্গে মুখোমুখি আবৃত্তি করতাম। একসময় সবার মুখেই ওই ছন্দময় কথা-'হতে পারো যদি সৎ-সরল-সদাচারি, সহজেই পেতে পারে স্বপ্নের চাবি।'দাদু কখনোই এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের বলেননি। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আর জিজ্ঞেস করিনি।
সময়ের স্রোতে তিন মাস বছর ফুড়িয়ে একসময় যুগ গেল পেরিয়ে। আমি স্কুল-কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় সবে পা রেখেছি। দাদু মারা গেলেন। দাদুর জন্য অনেক কেঁদেছি, কিন্তু বারবারই মনের ভেতরটা কবিতাটি আবৃত্তি করতে লাগলাম। বড়ই দুর্ভোগ মনে হলো। কথাটির তাৎপর্য অনেক গভীর এটা বুঝতে পারলাম। বাড়ি থেকে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেকেই জিজ্ঞেস করলাম। সবাই সরল ভাবে ব্যাখ্যা করলেন। অনেকের গভীর তাৎপর্য উদঘাটন করলেন। কিন্তু কারো কথাই আমার মনঃপুত হলোনা। কথা তো খুব সামান্যই। খুব সহজেই স্বপ্নের চাবি পাওয়া যাবে-যদি আমি সৎসরল এবং সদাচারী হই। আমি সৎ সরল এবং সদাচারী হলাম তার ঠিক আছে কিন্তু স্বপ্নের চাবিকা কোথায়? শুধু এটুকুর হিসেব আমি কখনোই মিলাতে পারিনি। না পারলেও এর একটা শেষ আমি দেখতে চাই। এজন্য আমি সর্বপ্রকার অসৎ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখি সরল বলতে কী বোঝায় সেটি আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়। শুধু এটুকু জানি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বিধাতার কাছে একটি সরল পথ প্রার্থনা করেছিলেন। আমিও সকল কাজে কর্মে স্মরল হতে চেষ্টা করি। ভাবনা চিন্তায় নিজেকে কখনো জটিল করে তুলি না। এর ফলে সবার প্রতি আমার বিনয়ী হতে সাহায্য করেছিল। আমি সদাচারী থাকার প্রান্ত চেষ্টা করি। যদিও আমার রাগ খুব বেশি। তবুও ধৈর্য ধারণ করি। দাদ ার কথা মনে করে ভুল বললাম স্বপ্নের চাবি পাওয়ার আশায়।
এক রাতে ঠিক ঠিকই স্বপ্নে চাবি পেলাম। একেবারে সোনার চাবি। ঘুম থেকে জেগে বুঝত পারলাম দাদা তো সোনার চাবির কথা বলেননি। বলেছেন স্বপ্নের চাবি। আরেকবার স্বপ্নে দেখলাম এক লোহার চাবি। তার ভার আমি বইতে পারছি না। কিছুদিনের মধ্যেই আমি নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হলাম। স্বপ্নের চাবির কথা ভোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু হতাশ হলাম। যে স্বপ্নের চাবির কথা শৈশব থেকে শিখেছি তাকে কি আর এত সহজে ভোলা যায়? যেভাবেই হোক এক সময় স্বপ্নে চাবির কথা গেলাম ভুলে।
লেখাপড়া শেষ করেই আমি কর্মে ঢুকে পড়লাম। বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়েই আমি এক সময় স্বপ্নের চাবির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমি এখন পঞ্চাশের কোথায় পা রেখেছি। গাড়ি বাড়ি সব হয়েছে। বিয়ে করে ছেলে সন্তান হয়েছে বাবা হয়েছি। আমার ছেলে সন্তানেরা আমার শৈশবের বয়সে পা রেখেছে। এরই মধ্যে একদিন জ্ঞান ফিরলো। দাদার স্বপ্নের চাবিটি খুঁজে পেলাম। দেখেছি সেই চাবি দিয়ে আমি একে একে জীবনের সব স্বাদ ইচ্ছা পূরণ করছি। ক্লাসে কখনো সেকেন্ড হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কখনো পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়িনি। কর্মে দ্বিতীয় হইনি। গাড়ি বাড়ি সবকিছু করে ফেলেছি। বুঝতে পারলাম-"আমি নিজেই" সেই স্বপ্নের চাবি। যাকে ঘুরতে হয়েছে সৎ সরল আর সদাচারী হয়ে। কিন্তু সরল পথটি আজও খুঁজছি। সরল পথ খুঁজে পাওয়া তো সহজ নয়। জীবনের পথ যে শত সহস্র বাকে প্রসারিত। আমি সরল মনে বারবার প্রশ্ন করি নিজেক-
ওরে ও-মন পারবি কিরে তুই সহজ হতে -
খুব সহজে আমারে তুই চিনিয়ে নিবি সরল পথে!