"দেবদাস" শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কালজয়ী উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। এই গল্পে প্রেম, বিরহ, আত্মত্যাগ এবং হৃদয়বিদারক পরিণতির করুণ কাহিনি ফুটে উঠেছে, যা যুগের পর যুগ পাঠকের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। দেবদাস কেবল একটি প্রেমের গল্প নয়; এটি এক ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব, সামাজিক প্রথা, ও মানসিক যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবদাস ও তার শৈশবের বন্ধু পার্বতী, যাকে সবাই পারো বলে ডাকে। দেবদাস আর পারো ছোটবেলা থেকেই একই গ্রামে বড় হয়েছে, আর একে অপরের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট। শৈশব থেকেই দেবদাস ও পারোর মধ্যে একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা সময়ের সাথে সাথে প্রেমে পরিণত হয়। কিন্তু তাদের এই সম্পর্কের পথে আসে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা। দেবদাসের পরিবার উচ্চবংশীয় ও সম্পদশালী হওয়ায় পারোকে তাদের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে রাজি হয় না, যা তাদের সম্পর্কের জন্য এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পারো দেবদাসকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়, কিন্তু দেবদাস তার পরিবারকে অসম্মান করতে চায় না এবং সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রত্যাখ্যানের ফলে পারো অপমানিত হয় এবং দেবদাসের উপর ক্ষুব্ধ হয়। পরে পারো তার পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী অন্য একজন ধনী ও বয়স্ক জমিদারের সাথে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু দেবদাস পারোকে হারানোর পরই বুঝতে পারে যে তার হৃদয়ের আসল বাসিন্দা পারো ছাড়া আর কেউ নয়। পারোকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তার হৃদয় গভীর বেদনায় ভেঙে পড়ে।
পারোকে হারানোর পর, দেবদাস হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এই নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতার মাঝে সে মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়ে। তার জীবনে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা মদ দিয়ে পূর্ণ করার চেষ্টা করে। দেবদাস এই সময়ে চন্দ্রমুখী নামের এক নর্তকীর সাথে পরিচিত হয়। চন্দ্রমুখী প্রথমে দেবদাসকে মদ্যপ ও হতাশাগ্রস্ত হিসেবে দেখে, কিন্তু পরবর্তীতে তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তার প্রতি প্রেমে পড়ে। চন্দ্রমুখী নিজের জীবনের সমস্ত সুখ ত্যাগ করে দেবদাসের সেবা করতে প্রস্তুত থাকে, কিন্তু দেবদাসের হৃদয় যে এখনও পারোর জন্যই আকুল।
চন্দ্রমুখী দেবদাসের জীবনকে সুন্দর করতে চাইলেও, দেবদাস পারোর স্মৃতি ভুলতে পারে না। পারো তার হৃদয়ের গভীরে এমনভাবে স্থান নিয়েছে যে চন্দ্রমুখীর প্রেম এবং যত্ন তাকে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে না। দেবদাস প্রতিদিন আরও বেশি করে মদে ডুবে যায় এবং শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার এই আত্মধ্বংসের পথ তাকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। নিজের জীবনকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে সে পারোর বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয়। তার একমাত্র ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো পারোকে দেখা, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পারো তখন তাকে দেখতে পারেনি।
পারোকে ছাড়া দেবদাসের জীবন অসহ্য যন্ত্রণার একটি দীর্ঘ অধ্যায় হয়ে ওঠে, এবং পরিশেষে সে সেই যন্ত্রণার ভার সইতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই দেবদাস তার প্রেমকে চিরস্থায়ী রূপে রক্ষা করে।
"দেবদাস" কেবল একজন মানুষ নয়, বরং মানুষের একান্ত অনুভূতির প্রতীক। দেবদাস চরিত্রের মাধ্যমে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মানুষের অন্তরের গোপন আকাঙ্ক্ষা, প্রেমে পরাজয়, এবং সামাজিক প্রথার অবদমনকে তুলে ধরেছেন। দেবদাসের জীবনের করুণ পরিণতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কিছু অনুভূতি কখনও পূর্ণ
তা পায় না।