আঁধার রাতের অতিথি

ঢং ঢং ঢং। অবশেষে রাত বারোটা বাজে। অধীর আগ্রহে এতক্ষণ প্রতীক্ষা করছিলাম অভীষ্ট মুহূর্তের জন্য। এখনই আমার স্বপ

গ্রামের নাম আনন্দপুর। মেদিনীপুরের ঘাটাল শহর থেকে মোটামুটি পনেরো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শাল সেগুনের জঙ্গলের কোলে আর লালমাটির দেশে অবস্থিত এক প্রত্যন্ত গ্রাম। বেশীরভাগই আদিবাসীদের বাস, তবে চৌধুরীরা বেশ বড়োলোক। গল্পলেখক হবার সূত্রে এই গ্রামের জমিদার উদয়নারায়ণ চৌধুরীর সাথে আমার বেশ আলাপ রয়েছে। উদয়বাবু আবার ভূতের গল্প পড়তে খুবই ভালোবাসেন। সেই সূত্রে তিনি শুভাশিসকে চিনবেন না, তা কি হতে পারে! হ্যাঁ, আমি শুভাশিস আচার্য, বাংলা ভৌতিক সাহিত্যে একজন নক্ষত্র। বাংলার গ্রামে শহরে কতো ফ্যান আছে আমার!কতো লোক আমায় স্রেফ দেখার জন্য পাগল! পুজোর সময় তো বিভিন্ন পত্রিকাগুলি তাদের শারদীয়া সংখ্যায় লেখা পাঠাবার জন্য পাগল করে দেয়! যাই হোক, আবার গল্পে ফিরে আসি। 

 

গ্রামের যে প্রান্তে এসে উঠেছি, সেই জায়গাটার নাম উঁচুমাঠ। শুনেছি লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় এখানে বহু নিরীহ কৃষক যখন কুখ্যাত সূর্যাস্ত আইন অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ে কোম্পানির কাছে খাজনা দিতে অপারগ হত, তখন তাদের জোর করে জমিদারের লেঠেলরা জীবন্ত অবস্থাতেই এই জমিতে পুঁতে ফেলত। শোনা যায়, তারা নাকি পিশাচে পরিণত হয়ে আজও জিঘাংসা পূরণের জন্য ঘুরে বেড়ায় রাতের অন্ধকারে(মূলতঃ অমাবস্যা আর ভূতচতুর্দশী)। এছাড়া কাছাকাছি আছে বাওড়। সেখানে নাকি রাতের বেলা ঘুরে বেড়ায় আলেয়া। উদয়বাবুর কাছেই শুনেছি কাছাকাছি জঙ্গলে নেকড়ে মানবের বসতি ও তাদের উপদ্রব। কবরখানায় রয়েছে মামদো আর শ্মশানের কাছে আশশ্যাওড়া গাছে সন্ধ্যা থেকেই পা ঝুলিয়ে বসে থাকে চুড়েইল। আজও অন্ধকার নেমে এলে রক্ত টগবগ করে ফুটছে এরকম নবীন যুবকের সন্ধান করে বেড়ায় শাঁকচুন্নী বা শঙ্খিনী। 

 

আহা, এরকম একটা জায়গারই তো খোঁজ করছিলাম। উদয়বাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ, এখানে এত ভূত! এ যেন সোনায় সোহাগা। এতো হন্টেড প্লেস যাদের নাম শুনলেই রক্ত জল হয়ে যায়, ঘুরে বেড়ালাম কিন্তু কিছুই পেলাম না। মুম্বাইয়ের মুকেশ মিলস থেকে রাজস্থানের ভানগড়। এক সে বড়কর এক। আর এ যেন পরম বৈষ্ণবের জন্য হাতের কাছেই বৃন্দাবন। যাই হোক, এখানে এসে অভীষ্ট সিদ্ধ হয় কিনা, সেটাই দেখার। 

 

হ্যাঁ, এবার একটু বলি। আমি এখানে এসেছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে। ভূত আছে কি ভূত নেই! আর তার জন্য খুঁজতে বেরিয়েছি মধ্যরাত্রের অতিথি ব্লাডি মেরীকে। ব্লাডি মেরী, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। ব্রিটেন ও পশ্চিমী দুনিয়ার এক অভিশপ্ত প্রেতিনী, যাকে নিয়ে কতো গল্প, কতো উপকথা! এই ব্লাডি মেরীকে যাঁর প্রেতাত্মা বলে অভিহিত করা হয়, সেই ইংল্যান্ডের রাণী মেরী ছিলেন ইতিহাসের পাতার এক ঘৃণ্য চরিত্র। কতো পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে যৌবনের স্বাদ মিটে গেলে নিজের নামে রটনা না রটার জন্য প্রেমাস্পদদের গুপ্ত হত্যা করেছেন, কতোবার নিজের গর্ভপাত করিয়েছেন -তার ইয়ত্তা নেই। কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর তাঁর অত্যাচার ছিল অবর্ণনীয়। কতো যে বাইবেল গর্হিত কাজ করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এতো সব পাপের বোঝার জন্য মুক্তি পায়নি তাঁর আত্মার। তাই তাঁর আত্মা অভিশপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর বুকে। সবত্র সেই আত্মার অবাধ বিচরণ। 

 

এই গল্প শুনেছিলাম সাত বছর আগে তোর্ষা দির কাছে। আর তখন থেকেই ইচ্ছা ব্লাডি মেরীকে প্রত্যক্ষ করব!

 

আজ রাতেই হয়তো উঁচুমাঠের বুকে পূরণ হতে চলেছে আমার স্বপ্ন। আজ শনিবার, তায় আবার অমাবস্যা। প্রেতাত্মাদের মহোৎসব করার দিন। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছি। 

 

একটা মোমবাতি জ্বেলে দাঁড়ালাম আয়নাটার সামনে। এসে ওটাকে ধূলিধূসরিত দেখেছিলাম, আজই পরিষ্কার করেছি। এইবার তিনবার ব্লাডি মেরীকে ডাকতে হবে"ব্লাডি মেরী, প্লিজ কাম টু মি" বলে। 

 

একবার ব্লাডি মেরী বলে ডাকলাম। দূরে কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠল। একপাল শেয়াল একসাথে ডেকে যাম বা প্রহরের সূচনা ঘোষণা করে, তাই শেয়ালকে বলা হয় যামঘোষক। কিন্তু, একটা শেয়ালকে একভাবে ডাকতে তো শুনিনি। আর ডাকটাও কেমন যেন অদ্ভূত, যেন হাঁড়ির মধ্যে মুখ রেখে ডাকছে। ভেসে এল অজানা রাতজাগা পাখির ডাক। সত্যিই অপার্থিব কিছু হচ্ছে কিনা জানি না, নাকি পরিবেশের জন্য আমি দেখলাম আমার মতো দামাল ছেলে যে ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে অমাবস্যার রাতে শ্মশানে আর গোরস্থানে একলা কাটিয়েছি, এই উঁচুমাঠের মতো জায়গায় তারও ভয় করছে। এই হেমন্তেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। 

 

না, নিজের অনুভূতিকে বেশি পাত্তা না দিয়ে আবার ডাকলাম ব্লাডি মেরী বলে। এবার যেন কাছেই শুনতে পেলাম ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাড়হিম করা গর্জন। না, কানের ভুল একেবারেই নয়, আর আমি সস্তার নেশাও করিনি। সত্যিই যেন শুনতে পেলাম, কাছাকাছি এক পাল নেকড়ে হাড় হিম করা স্বরে হুহুংকার করছে। তাহলে কি উদয়বাবুর কথাই সত্যি!এবার আমি সত্যিই ভয় পেলাম। আর এরপর যা শুরু হল তা কল্পনাতীত বললেও কম হবে। আজ বিকালে আকাশে কালো মেঘের চিহ্নমাত্র ছিল না, বাইরে শুনতে পেলাম ঝোড়ো হাওয়ার গোঁ গোঁ শব্দ। যেন সারা উঁচুমাঠ জুড়ে আঁধি বইছে! জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, পরিষ্কার আকাশে নক্ষত্র উজ্জ্বলতা বিকিরণ করছে আর কিছু উড়ছেও না। আর গাছের পাতাগুলিও আশ্চর্যরকমভাবে স্থির! কিন্তু, শুধুই শোঁ শোঁ শব্দ। কেমন একটা খটকা জাগল মনে। যা ঘটে চলেছে কোনো কিছুই তো বাস্তবে সম্ভব নয়। ওদিকে মাঠেও পঞ্চাশ-ষাট জন ছায়ামূর্তিকে দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন অস্পষ্ট কুয়াশা দিয়ে ঘেরা আছে লোকগুলি। যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তারা যেন এই পোড়ো বাড়ি যেখানে আমি এসে উঠেছি, ভাসতে ভাসতে সেই দিকেই এগিয়ে আসছে। 

 

না এবার সত্যিই ভয় করছে। মোমবাতির শিখাটা কাঁপছে, যেকোনো মুহূর্তে নিভে যেতে পারে। ছায়াগুলো কাছে চলে এসেছে। একটা কথা আছে, মানুষের কৌতুহল অদম্য। অসীম কৌতুহল নিয়ে শেষবারের মতো ডাকলাম ব্লাডি মেরী বলে। আর তারপর যা হল তা আমার কল্পনারও অতীত। হঠাৎই কোনো এক অজানা মন্ত্রবলে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল মাঠের লোকগুলি, থেমে গেল নেকড়ের ক্রুদ্ধ গর্জন, আকাশ ভরে উঠল ঘন কালো মেঘে আর শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়। পাগলা হাওয়া দুর্দম গতিতে আছড়ে পড়তে লাগল বাড়িটার ওপর। 

 

আর মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় কাঁপতে কাঁপতে আমি আয়নায় দেখলাম এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আয়নায় আমার মুখের বদলে আমি দেখতে পেলাম এক সাদা গাউন পরা স্ত্রীলোকের ক্ষতবিক্ষত হিংস্র অপার্থিব মুখচ্ছবি। সেই মুখের হিংস্রতা আর নারকীয় ভয়াবহতা বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত। 

 

একটু পরেই দমকা হাওয়ায় নিভে গেল মোমবাতি। এখন শুধুই নিশ্ছেদ্য অন্ধকার। শুনতে পেলাম কেউ যেন দরজার কড়া নাড়ছে-খট, খট, খট। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় আমায় জানান দিল এসে গেছে সেই বহু প্রতীক্ষিত ব্যক্তি। মধ্যরাত্রের অতিথি ব্লাডি মেরী।


MD SOHAG KHAN

107 Blog posts

Comments