গড়কড়িদের ইতিহাস

এইরকম ভাবেই সন্ধ্যের থেকে প্রশংসার ঝড় আছড়ে পড়ছে আমার উপর। সত্যি বলতে আমার বেশ ভালোই লাগছে। একজন শিল্পীর এ??

করেছে। চারিদিকের জাঁকজমক, আলোক সাজ সরঞ্জাম, মানুষের কোলাহল, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ - এই সবকিছু নিয়েই যেন এখানে ছোটখাটো একপ্রকার উৎসব বসে গেছে, আর আমি হলাম সেই উৎসবের একমাত্র মধ্যমনি। কিন্তু এতকিছু হওয়া সত্ত্বেও একটা অন্যমনস্কতা বারবার আষাঢ়ের মেঘের মতো জমা হচ্ছিলো আমার মনের মধ্যে। এই যে এতকিছু, এত জাঁকজমক, এত মানুষের প্রশংসা, চর্চার শিরোনামে থাকা - এই সবকিছু আমার একার নয়। জানি সে হয়তো কোনোদিনই এই কৃতিত্বের ভাগ চাইতে আসবে না। তবুও সে না থাকলে হয়তো আমার এই গল্পখানি লেখাই হতো না। এবার আপনারা ভাবতেই পারেন যে, এই গল্পটা কি আমার নয়! আমি বলবো, না। জানি আপনারা শুনে অবাক হচ্ছেন। আমিও হয়েছিলাম সেদিন। হয়তো আপনাদের থেকে আরও অনেক বেশি। যেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল। আমি নিজেও জানিনা সেদিন আসলে কি হয়েছিলো! সেদিনকার ঘটনার কোনো ব্যাখ্যাই আমার কাছে নেই। 

 

আমি দীপরাজ। কলকাতার একটা বেসরকারি ইন্জিনিয়ারিং সংস্থায় মোটামুটি বেতনের একটা চাকরি করি। বুঝতেই তো পারছেন, বেসরকারি সংস্থা মানেই অত্যাধিক কাজ আর অত্যাধিক কাজ মানেই অত্যাধিক চাপ। তো এই অত্যাধিক কাজের চাপের মধ্যেও আমার যে সত্ত্বাটাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছি তা হলো আমার লেখন। যাইহোক এবার আসল কথায় আসি। কলকাতায় আমি কর্মসূত্রে থাকলেও আমার আসল বাড়ী হলো ফুলসূড়ীতে। ফুলসূড়ীর ভৌগোলিক অবস্থান এক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজন, তাই আর সেটা উল্লেখ করছিনা। তবে ফুলসূড়ীতে আমাদের যৌথ পরিবার। সবাই একসাথে, মিলেমিশে থাকি। কিন্তু বছর দশেক হলো আমাকে চাকরির জন্য কলকাতায় চলে আসতে হয়েছে। তবে এই কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে হারিয়ে গেলেও রোজ রাতে বাড়ি ফিরে বাড়ির লোকের সাথে ফোনে কথা বলতে কখনই ভুলিনা। এরকমই একদিন রাতে বাড়িতে ফোন করে কথা বলছি, মায়ের কাছ থেকে খবর পেলাম যে, ঠাকুমার নাকি ভীষন শরীর খারাপ। তাই আর থাকতে না পেরে পরেরদিনই অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়ে তারপরের দিনই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম ফুলসূড়ীর উদ্দেশ্যে। 

 

হাওড়া থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ট্রেনে সফর করে যখন প্ল্যাটফর্মে নামলাম দেখি পংকা নিতে এসেছে। পংকা আমার কাকার ছেলে অর্থাৎ খুড়তুতো ভাই। ওকে দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। সটান ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, " কিরে ভাই, কেমন আছিস? " পংকাও হেসে বললো, " হ্যাঁ দাদা ভীষণ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস রে? " এরকম কিছু ক্ষুদ্র কথোপকথনের পর পংকা আমার ব্যাগটা নিয়ে " চল দাদা" বলে এগিয়ে যেতে লাগলো। আমিও ওর পিছু পিছু প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে একটা ভ্যানে গিয়ে চড়লাম। ভ্যানে চড়ে আসতে আসতে পংকার সাথে আরও অনেক কথা হলো। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে ভ্যানের ঝাঁকুনি খাওয়ার পর আমরা অবশেষে পৌঁছালাম। ভ্যান থেকে নেমে যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম আমায় দেখে বাড়ির মধ্যে যেন একপ্রকার হুলস্থুল পড়ে গেলো। মা তো আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদেই ফেললো, " বাবা, কেমন আছিস তুই? কতদিন পর তোকে দেখলাম!" একে একে বাবা, কাকা, কাকি এমনকি যার জন্য এতদূর থেকে ছুটে আসা অর্থাৎ ঠাকুমা, সবার সাথেই দেখা হলো। কিছুক্ষণ ঠাকুমার পাশে বসে কথা বললাম। দেখলাম ঠাকুমা আগের তুলনায় একটু সুস্থ আছে। 

 

রাতের বেলা আমরা সবাই মিলে খেতে বসেছি। আমাদের বাড়িতে ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়ার রেওয়াজ কোনোদিনই ছিল না। আমরা আগাগোড়াই নীচে আসন পেতে তার উপর বসেই খাই। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মা আমার পাতে আরেকটা মাছের টুকরো দিয়ে বললো, " তা বাবু বললিনা তো মাছের কালিয়াটা কেমন হলো!" আমি খেতে খেতে বললাম, " উহু! তোমার কোনো জবাব নেই মা! সেই স্বাদ! এখনও একটুও পাল্টায়নি। " বাবা বললো, " সে না হয় হলো। তা বল কলকাতায় কাজ কেমন চলছে? "

 

- সব ঠিকই আছে। তবে কি জানোতো কাজের প্রচন্ড চাপ। মাঝে মাঝেতো দম নেওয়ার ফুরসৎ-ই পাইনা। 

 

- সেতো নিশ্চয়ই। মনে রাখবি সব সময় সৎ পথে পয়সা কামাতে গেলে কষ্ট করতেই হবে। 

 

বাবার কথা শেষ হতেই কাকি বলে উঠলো, " তা দীপু বাবা! অনেক দিনতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরলে। এবার বিয়েটা করে ফেলো দেখিনি। আমারও তো সখ হয় একটু কাকি শ্বাশুড়ি হওয়ার। " কথাটা শুনে সকলে হেসে উঠলো। মা বললো, " হ্যাঁ রে বাবা! কাকিমা তো ঠিক কথাই বলেছে। " আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। এর মাঝে আবার কাকাও ফোড়ন কেটে উঠলো। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, " দেখো দাদা! দীপু আবার যেন শহরের প্যান্ট জামা পড়া কোনো মেয়েকে না বিয়ে করে নিয়ে আসে!" আবার সবার সমবেত হাসি। আমি চুপচাপ মাথা নিচু করেই খেতে লাগলাম। আঁর চোখে দেখলাম পংকা সবার কথা শুনে মিচকি মিচকি হাসছে। হঠাৎ বাইরে থেকে কিসের একটা হট্টগোল ভেসে এলো। মনে হলো যেন কিছু মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে চেঁচামেচি করছে। ঘরে উপস্থিত সকলেই তাদের হাসি থামিয়ে দিয়ে সরব হয়ে উঠলো। বাবা বললো, " কি ব্যাপার! এত চিৎকার চেঁচামেচি কিসের!" বলেই উঠে পড়লো। আমিও বাবাকে দেখে আর চুপচাপ বসে থাকতে পারলাম না। বাবার পিছন পিছন আমিও উঠে পড়লাম। বাইরে এসে দেখলাম যে, আমাদের পাশের বাড়ি মানে বিশু কাকাদের বাড়িতে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে এবং একে অপরের সাথে কথা বলছে। প্রত্যেকের মুখেই উত্তেজনার ছাপ। আমি আর বাবা এগিয়ে গেলাম কি হয়েছে ব্যাপারটা দেখতে। " দাঁড়া দাদা" বলে পংকাও আমাদের পিছন পিছন আসলো। বিশু কাকার বাড়ির সামনে যেতেই এক বিকট কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা তিনজনেই তাড়াতাড়ি করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢুকেই দেখলাম বিশু কাকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁপছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত এবং স্হির। তাঁর পাশেই বিশু কাকার স্ত্রী মানে কাকিমা বিশু কাকার হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে, " একি হলো গো তোমার!" একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, " কি হলো গো! কথা বলছো না কেন! কি হয়েছে তোমার? " ব্যাপারটা যে কি তা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঘরে উপস্থিত বাকি আর সবার দিকে তাকালাম। তাদের মুখেও উদ্বেগের চাহনী। বাবা পাশেই দাঁড়ানো একটা মাঝ বয়সী লোককে জিজ্ঞেস করলো, " হারাণ, কি হয়েছে রে বিশুর? ওর বউ ওমন করে কাঁদছে কেন? শরীর টরীর খারাপ করলো নাকি? " লোকটি বেশ হতাশ হয়েই বললো, " দাদা কি আর বলি! শরীর খারাপ করলেও না হয় হতো! কিন্তু সে সব তো কিছুই হয়নি। ওকে বোধহয়..." লোকটি তাঁর কথা শেষ করার পূর্বেই " দেখি দেখি সরুন। রাম গুনিন এসেছেন" বলে বিশু কাকার ছেলে আরেকটি লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। লোকটিকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি একজন ভূত বিশেষজ্ঞ মানে ওঝা। গায়ে একটা কালো আলখাল্লা, কাঁধে একটা লাল রঙের পুঁটলি এবং গলায় অজস্র রং বেরঙের পুঁতির মালা। বিশু কাকার ছেলে লোকটিকে একটা টুল এগিয়ে দিলো। লোকটি টুলটি টেনে একদম বিশু কাকার মুখের সামনে গিয়ে বসলেন। ততক্ষণে বিশু কাকার বউও একটু শান্ত হয়েছে। লোকটি প্রথমে বিশু কাকার কপালে হাত রেখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। দেখে মনে হলো তিনি বোধহয় বিশু কাকার চোখে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ উঁকি ঝুঁকি করার পর কপাল থেকে হাত সরিয়ে বিশু কাকার বউকে বললেন, " ভয় নেই মা। তোর স্বামীর তেমন কিছুই হয়নি। সামান্য দৃষ্টি লেগেছে মাত্র। তবে আজ কিন্তু ও বেশ বড়সড় বিপদে পড়তে যাচ্ছিলো। শুধু সঠিক সময়ে ওকে পাওয়া গেছে বলে ও এইবারের মতো রক্ষা পেলো। " কথাটা শোনার পর বিশু কাকার বউ চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠুকে বেশ কয়েকবার প্রনাম করলো। লোকটি " দাঁড়া" বলে নিজের পুঁটলিটাতে হাতরে একটা মাদুলি গোছের কিছু একটা বার করলেন। তারপর সেটা মুখের সামনে ধরে বিড়বিড় করে বেশ কিছুক্ষন কি সব বলে সেটাতে পরপর তিনবার ফুঁ দিয়ে বললেন, " এই নে মা! এই মাদুলিটা আজ মধ্যরাতে ওকে পড়িয়ে দিবি। তাহলেই ওর সব বিপদ কেটে যাবে। " এই বলে লোকটি আবার বিশু কাকার কপালে হাত রেখে আবার মুখ দিয়ে কি সব বিড়বিড় করে বিশু কাকার আপাদমস্তক লম্বা লম্বা তিনটে ফুঁ দিয়ে উঠে পড়লেন। বিশু কাকার ছেলে এগিয়ে এলো তাঁকে বাহির অবধি ছেড়ে দেবে বলে। ওরা বেড়িয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম বিশু কাকাকে আগের তুলনায় একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। চোখে মুখে সেই ভয় ভাবটা আর নেই। বাবা এবার টুলটা টেনে নিয়ে বিশু কাকার সামনে গিয়ে বসে বললো, " হ্যাঁ রে বিশু! কি হয়েছিল রে তোর? " বিশু কাকা একটু থেমে থেমে বললো, " আর দাদা কি বলবো! আজকে আমাদের কারখানায় কাজের চাপটা একটু বেশি থাকায় আমাদের সকলকেই একটু বেশীক্ষন থাকতে হয়েছিল


MD SOHAG KHAN

107 Blog posts

Comments