ধানসিঁড়ির ঘাট

সন্তোষ তোমাকে একবার দেউলটি যেতে হবে, যদিও জায়গাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়, কারণ তোমায় প্রত্যন্ত গ্রামে য??

আচ্ছা বেশ স্যার, আমি দেউলটি যাব"। 

 

 কলকাতা থেকে ট্রেন ধরে দেউলটি পৌঁছতে হবে। যদিও রাস্তাটা খুব বেশী নয়, তবুও তার জন্য সমস্ত রকমের প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে সন্তোষ, কখন কোনটা দরকার পড়ে? 

 

 ট্রেন ছেড়ে দিল। দেউলটি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তারপর কিছুটা পায়ে হাঁটা পথ। এরপর নদীপথে ওপারে যেতে হবে। এমনটাই সন্তোষ কে জানানো হয়েছে। দেউলটি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। এমনিতে জায়গাটা শহরের মতই কিন্তু কলকাতা শহরের মতো এতটা আধুনিক নয়। 

 

 পায়ে হেঁটে এতটা রাস্তা যাওয়া সন্তোষের পক্ষে সম্ভব হলো না, তাই সে ঠিক করল একটা রিক্সা অথবা ভ্যান নিয়ে নেবে, ভ্যান পাওয়া না যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেশ কিছুটা দূর হেঁটে গিয়ে একটি রিক্সা স্ট্যান্ড দেখতে পেল। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় রিক্সা দেখতে পাওয়া গেল না, হঠাৎ পিছনের দিক থেকে একজন হাঁক দিল সন্তোষকে, 

 

" দাদা আপনি কি কাউকে খুঁজছেন? এখানে কি নতুন এসেছেন? কারুর বাড়িতে যাবেন? "

 

" হ্যাঁ, আসলে আমি পেশায় একজন ডাক্তার, এদিকে এসেছি চিকিৎসার জন্য, ঠিকানাটা আমার ঠিক জানা নেই, তবে এটুকু জানি যে নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে, "। 

 

" ও আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। নদীর ঘাটে নিয়ে যেতে হবে আপনাকে। আসুন আমার রিক্সায় উঠে পড়ুন। আসলে এই অঞ্চলটাতে রাত্তিরের দিকে রিক্সা ভ্যান কিছুই পাওয়া যায় না। যে যার নিজের বাড়িতে চলে যায় সন্ধ্যে সাতটার পরেই। আমিও আমার বাড়ির দিকেই ফিরছিলাম। হঠাৎ আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমার বাড়ি ওই পথেই, চলুন যাবার পথে আমি আপনাকে নদীর ঘাটে নামিয়ে দিয়ে যাব, উঠে পড়ুন"। 

 

 সন্তোষ উঠে পড়ল, রিক্সা চলতে লাগলো। 

 

 সারাদিন ট্রেনে আসতে আসতে বেশ ভালই ধকল সহ্য করতে হয়েছে সন্তোষকে। এবারে কোন রকমে নদীপথে ওপারে পৌঁছে বিশ্রাম নিতে হবে। শরীর না হলে আর দিচ্ছে না। 

 

 এমন সময় রিক্সাচালক টি তাকে জিজ্ঞাসা করল " আচ্ছা দাদা, ওপারে কি আপনি সেই দুস্থ লোকেদের চিকিৎসা করবার জন্য এসেছেন, যারা অনেকেই মড়ক লেগে মারা যাচ্ছে? কিসের থেকে মড়কটা লেগেছে সেই রোগের কারণটাই এখনো কেউ ধরতে পারেনি। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন, বড্ড বিপদসঙ্কুল জায়গা"। 

 

" না না সেসব ঠিক আছে, আমি আমার সাথে সমস্ত রকমের ওষুধপত্র নিয়ে এসেছি। তুমি এত ভেবনা। তেমন কোনো বিপদ হবার সম্ভাবনা নেই"। 

 

 তখন রিক্সাওয়ালা রিক্সাটি থামিয়ে হঠাৎ করে সন্তোষের দিকে তাকালো, " ভয়ের কারণ শুধু একটাই যে তা নয়"!

 

" তার মানে তুমি কি বলতে চাইছো? একাধিক বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে বুঝি? "

 

" আসলে ব্যাপারটা হল এই যে, আমাদের এই অঞ্চলে হঠাৎ এক পিশাচের উপদ্রব শুরু হয়েছে। সবাই বলে নাকি সন্ধ্যার পরে সে এই গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। যাকেই হাতের কাছে পায়, তাকেই শেষ করে ফেলে। এই কারণে সন্ধ্যের পর গ্রামের রাস্তায় কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না। আমার আজকে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে তাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। কিন্তু আপনাকে এরকম অসহায় অবস্থায় ফেলে যেতে মন চায়নি তাই নদীর ঘাট অবদি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে গেলাম"। 

 

" তোমরা আধুনিক যুগের মানুষ হয়ে, এখনো এসব কথায় বিশ্বাস করো কি করে? আমি একজন ডাক্তার, আমি বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে বিশ্বাস করি, আমার কাছে এসব বিষয়ের কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো শুধুই মানুষের মনের বিকার এবং কুসংস্কারের দ্বারা তৈরি করা ভয় মাত্র। তুমি কি কোনদিন পিশাচকে নিজের চোখে দেখেছো"? 

 

" সে কথা আমি কল্পনাতেও আনি না, কারণ তাকে একবার কেউ দেখে ফেললে, সে আর তাকে ছাড়ে না"। 

 

 নদীর ঘাটে পৌঁছে গেল তারা। ঘাটে কোন নৌকাও নেই। এমন অবস্থায় ওপারে যাওয়ার কাজ আরো কঠিন হয়ে গেল। 

 

 রিকশাওয়ালা টি বলল, "দেখেছেন বাবু, এই ঘাটে ও কেউ নেই। সব জায়গা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। এখনো সময় আছে আমি আপনাকে বলছি আপনি বাড়ি ফিরে যান। আপনার ওদিকে না যাওয়াই ভালো"। 

 

" সেসব এখন আর ভেবে কাজ নেই। যা কপালে আছে হবে। আমাকে নিজের চাকরি বাঁচাতে হবে। আমি কলকাতা ফিরে গেলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে"। 

 

"ঐ যে একজন আসছে নৌকা নিয়ে। মনে হয় এদিকেই আসছে। "

 

" ও মাঝি, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার একটু দরকার আছে, আমাকে ওপারে নিয়ে যাবে? "

 

 মাঝি টি থমকে দাঁড়ালো নৌকাটি নিয়ে। 

 

" না বাবু, আমি এই ঘাটে নৌকা বেঁধে এবার বাড়ি যাবো। অনেক রাত হয়ে গেছে, আর তাছাড়া ঐদিকে অনেক ভয়ের কারণ আছে। এরপর ওই পথে আর কেউ যায় না। আপনি বরং অন্য কাউকে খুঁজে নিন। সেটাই ভালো হবে। "

 

" আমি তোমাকে অনেক টাকা দেব, আমাকে একটিবার ওপারে নিয়ে চলো"। 

 

" টাকার মোহ নেই বাবু, প্রাণের মোহটা বেশী। আপনাকে আমি নিয়ে গেলে হয়তো আর বেঁচে ফিরতে পারবো না"। 

 

" এরকম বলার কারণ কি? বললাম তো আমি তোমাকে অনেক টাকা দেব। তাছাড়া আমিতো রইলামই তোমার সাথে। তাহলে তোমার ভয়ের কি? "

 

" আপনি শহুরে মানুষ, আপনার হয়তো এসব বিষয়ের উপর বিশ্বাস নেই। কিন্তু আমরা গ্রাম বাংলার মানুষ, আমরা আজও এসব বিষয়ে যথেষ্ট বিশ্বাস রাখি। না না, মাফ করবেন, আমি এত রাতে আপনাকে ঐপারে কিছুতেই নিয়ে যেতে পারবো না। আপনি বরং অন্য কোনো উপায় খুঁজে নিন"। 

 

 সন্তোষ, চাকরি যাওয়ার ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল। সন্তোষের ওই বিমর্ষ মুখখানি দেখে মাঝির হঠাৎ দয়া জন্মালো। সে হঠাৎ বলে উঠল, " আচ্ছা আসুন বাবু, কিন্তু এটুকু জেনে রাখুন কোন বড়সড় বিপদ হলে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। আমি এক প্রকার নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি"। 

 

 মাঝির কাছ থেকে এই কথাগুলো শুনে, সন্তোষের মনে একটু বল এল, সন্তোষ ঠিক করল, আজকে যাইই ঘটে যাক না কেন, ওপারে তাকে পৌঁছতেই হবে। সে মাঝিকে জোর গলায় বলল, " তোমার কোনো চিন্তা নেই মাঝি ভাই। আমি তোমার সঙ্গে আছি। কোন বিপদ হলে একসাথে দুজন মোকাবিলা করব"। 

 

 ওর কথাটা শুনে যদিও মাঝি অবাক হলো, তবুও বলল, " একা একা যাবার থেকে কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া অনেক ভালো। এতে হয়ত বিপদের আশঙ্কা অনেকটাই কমবে, কারণ শুনেছি সে নাকি একা মানুষ পেলে তার উপরেই অত্যাচার চালায়। আমাদের দুজনকে দেখলে হয়তো এগোতে পারবে না"। 

 

 মাঝির কথাগুলি সন্তোষের কাছে এক প্রকার অবান্তর ও অযৌক্তিক বলে মনে হচ্ছিল। তবুও সে কিছু না বলে একটু হাসল।


MD SOHAG KHAN

107 Blog posts

Comments