দিন টা বৃহস্পতিবার

প্রত্যেকটা দিনই মানুষের জন্য মূল্যবান একটা সময়।

 

 

জ্ঞান ফিরে ফারিয়া বুঝতে পারলো না ঠিক কটা বাজে এখন, ধুপ করে উঠে বসলো, উঠতে গিয়েই বুঝলো কোমর থেকে পায়ের নিচ অব্দি চিনচিনে ব্যাথা, ব্যাথায় দম বন্ধ হবার জোগাড়। পিছন ফিরে ফারিয়া জানালার দিকে তাকালো। দিনের আলো মিইয়ে আসছে, তার মানে সন্ধ্যে হবার পথে।

হাতের কাছে মোবাইলটা নেই। থাকবার কথাও না। ঘটনা ঘটবার আগে ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে আরাফকে ফোন দিয়েছিলো, উঁহু কিছুটা ভুল হলো বলতে। আরাফ ওকে ফোন করেছিলো। খাওয়ায় ফারিয়ার বরাবরই অনীহা। আর এখন তো অভ্যেসই হয়ে গেছে। আরাফ অফিস থেকে ফোন করে মিষ্টি গলায় যতক্ষণ না বলবে, আমার বউটা খেয়েছে তো! ততক্ষণ যেনো খেতেই ইচ্ছে হয়না। মাঝে মাঝে ফারিয়ার মনে হয় এতোটাই ভালোবাসার যোগ্যি তো সে! বান্ধবীরা প্রথম প্রথম বলতো, এই ভালোবাসা কই যাবে পালিয়ে সংসারের যাতাকলে। কিন্তু যায়নি, কাল তাদের পাঁচ বছর পূর্ণ হবে বিবাহর। 

ভালোবাসার ঘাটতি তো হয়নি! বরং আরাফ কি আলাদা অন্য পুরুষ থেকে।

 

এইতো ফারিয়ার ছোট বোন এ বাড়িতে থেকেই পড়াশুনো করছে। প্রথমে যখন মৃদুলা হোস্টেল উঠলো আরাফের সেকি রাগ। বোনের বাড়ি থাকতে কেনো ও হোস্টেল থাকবে। তাও সত্য, বাবার রোজগার স্বল্প। বছর তিনেক আগে রিটায়ার করে বাসার পাশেই একটা স্টেশনারির দোকান খুলে বসেছে, তার পক্ষে ঢাকায় মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালানো কিছুটা তো ঝক্কিই বটে! কিন্তু সে কথা কি আরাফ কে বলা যায়। আর মা সবসময়ই বলে মেয়ের বাড়ি গিয়ে এতোদিন থাকা যায়নারে মা। ভাগ্যিস মৃদুলাটা আছে।

নইলে কেমন একা হয়ে যেতো ফারিয়া। ফারিয়ার কিছুই বলতে হয়নি। এক ছুটির সকালে আরাফই ওকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলো, তারপর ওখানে গিয়ে হাকডাক করে মৃদুলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।

মৃদুলা ফুসতে ফুসতে বললো, আপা তোর বরটা এমন দজ্জাল কেনো, একদম যাচ্ছেতাই, কি করেছে জানিস আপা? আমার বান্ধবীদের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে এমন জোরে মাথায় ঠুসা মারলো আমি প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ছিলাম আরেকটু হলে। ছি ছি আপা আমি মুখ দেখাবো কেমন করে বলতো?

 

বোনের কথা শুনে ফারিয়া হেসে গড়িয়ে পড়লো। তাদের ছোট্ট সংসার বেড়ে হলো একটুখানি বড়। তাদের যত আবদার সব যেনো ফারিয়ার। শরীরে তীব্র ব্যাথা নিয়েও ও হেসে ফেললো। তারপর হঠাৎই মনে হলো, তাকে এই মুহূর্তে এই বাসা থেকে বেরোতে হবে। বহুকষ্টে উঠে দাড়িয়ে ধীর পায়ে এগুনো শুরু করলো। হ্যাঁ ফোনটা আছে খাবার ঘরে। ফোন করার আগে ঘরের মেইন দরজাটা আলগোছে বন্ধ হলো। তারপর তাড়াহুড়ো করে আরাফকে ফোন করতে যাবে সেই সময়ই দেখলো আরাফের মিষ্টি একটা ক্ষুদেবার্তা, বউ আমি মিটিংয়ে ঢুকছি। আজ ক্ষানিক দেরি হবে বাড়ি ফিরতে। তোমাদের দুবোনের জন্য কিছু আনতে হবে? ফারিয়ার চোখে জল এলো। এতো কেনো ভালো ও! অথচ জানেও না আজ কি ঘটে গেছে তার আদরের বউয়ের সাথে। না না দেরি করা যাবেনা। ডায়াল লিস্টের দ্বিতীয় নাম্বার হলো মৃদুলার। ওকে একটা ফোন করে জানাতে হবে শিগগির। ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে পড়লো প্রতি শনি মঙ্গল বৃহস্পতি মৃদুলার কোচিং থাকে। এখন ওর ফোন সাইলেন্টে।

তবে এখন! ফারিয়া একমুহূর্ত ভাবলো। বাবা মায়ের বাসাটাও ঢাকা না। তারা থাকে টাঙ্গাইলে।

থাকলেও এই অবস্থায় গেলে মা মূর্ছা যেতো। বাবা কি করতো ফারিয়া জানেনা। হয়তো এই ঘটনার জন্য ফারিয়াকেই দোষারোপ করতো। ওদের বাবা মেয়ের সম্পর্কটা কেমন আবছা! ফারিয়ার মন ভর্তি অভিমান ছিলো বাবাকে নিয়ে। যখনই বাবা মায়ের মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই বিয়ে করে নিলো। আর তার ঘর হয়ে গেলো আলাদা। প্রতিরাতে ফারিয়া কেঁদে বালিশ ভিজাতে ভিজাতে শুনতো বাবার ঘরের চাপা হাসির শব্দ। আচ্ছা বাবা কি করে পারলো এতো দ্রুত মায়ের স্মৃতি গুলো ভুলে যেতে, কি করে পারলো ভুলে যেতে তার মেয়ে একা অন্ধকারে ভয় পায়! বাবার মায়ের মাঝে শুয়ে যে মেয়ে আদরে বড় হয়েছে একমুহূর্তেই সেই মেয়ে পর হয়ে গেলো বুঝি! সে যাকগে বাবার স্ত্রী মানে সৎ মাকে একটা সময় মা ভাবা শুরু করলেও বাবার সাথে রয়ে গেলো যোজন যোজন দূরত্ব। অথচ মৃদুলা বাবার কত আদরের। সে যাকগে এখন তার বেরোতে হবে, এই বাসা একেবারেই নিরাপদ না। আবার যদি বাড়িওয়ালার সেই ভাগ্নে দেখে ফেলে বিরাট বিপদ হবে! ফ্লোরে ছোপ ছোপ রক্ত, আর শাড়িটাও ভিজে গেছে রক্তে।

আজ শখ করে এই শাড়িটা পড়েছিলো আরাফকে চমকে দিবে বলে! কতদিন ধরে ও বলছিলো, ফারিয়া কতদিন শাড়ি পরোনা তুমি!

 

মাগরিবের আজান পড়ছে। এখন আধার হয়ে আসবে চারদিক, বের হওয়ার জন্যে এখনি ঠিক সময়। দারোয়ান চাচাও এতে জড়িত আছে, সে নামাজ পড়তে যাবে। এই লোককে কতই না শ্রদ্ধা করতো ফারিয়া, ভালো কিছু রাধলে এই বুড়ো লোককে খাবার পাঠিয়ে দিতো। আর সে কিনা সাহায্য করলো বাড়িওয়ালার ভাগ্নেকে ফারিয়ার সর্বনাশ করতে, নাহয় এই ফ্ল্যাটের স্পেয়ার কি কিভাবে পেলো ছেলেটা। ফারিয়া ঘরের কোনো বাতি জ্বালালো না। আলগোছে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। এই যে দারোয়ান চাচা টুপি মাথায় বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের খোলা বারান্দা। এর উপরের ফ্ল্যাটটাতেই বাড়িওয়ালার ভাগ্নের মদ জুয়ার আসর বসে।

ফারিয়া চট করে বাথরুমে ঢুকে পায়ের কাছে লেগে শুকিয়ে থাকা চটচটে ভেজা রক্ত ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলো, কলটাও ছাড়লো না। বালতির ঠান্ডা পানিতেই ধুয়ে নিলো, কিন্তু কিছুতেই যেনো রক্ত উঠছে না। না না এখন চিন্তা করার সময় নেই তাকে দ্রুত যেতে হবে আরাফের অফিসে। আচ্ছা সিড়িতে কি পায়ের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে! সেই ছেলেটা নয়তো? ফারিয়া মরে গেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে আবার কি আসছে। ফারিয়ার হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে লাফাতে লাগলো। সে খাবার ঘরে গিয়ে দেখে দরজা খোলা সে কি! সে কি তবে তাড়াহুড়ায় ঠিকমত আটকায়নি দরজাটা। না না এটা হতে দেয়া যাবেনা। সে দৌড়ে চলে এলো ঘরের বাইরে। না সিরিতে কেও নেই। তবে হ্যাঁ উপর গুটিকয়েক পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাজেই লিফট না ওরা নামার আগেই সিড়িবেয়ে ওকে নেমে বেরিয়ে যেতে হবে। বাড়ির মেইন গেটের কাছে এসেই হঠাৎ তার মনে হল শোবার ঘরে কিছু কি পড়ে ছিলো, জমাট বাধা অন্ধকারে চোখে ঠাওর করতে পারেনি ফারিয়া। সে দ্রুত বেগে দৌড়াতে লাগলো। দ্রুততায় তার মোবাইল ফোন আর টাকার ব্যাগ সবই রেখে এসেছে, এমনকি শব্দ হবে বলে পায়ে স্যান্ডেলটাও গলায়নি।

 

এখান থেকে আরাফের অফিসের দূরত্ব বেশি না, তবে তা পায়ে হেটে যাবার মতও না। ফারিয়া অতশত না ভেবে চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠে পড়লো। ভেবেছিলো কন্ডাক্টর ছেলেটা কিছু বলবে, না সে ভাড়া তুলতেই ব্যস্ত। কিন্তু ওর কাছে যে টাকা নেই, কি বলবে সে! হাতের আংটিটার দিকে চোখ পড়ল ফারিয়ার। হ্যাঁ টাকা চাইলে এটাই দিয়ে দেবে বরং। আরাফ অফিস থেকে বেরোনোর আগেই ফারিয়াকে পৌঁছতে হবে যে করে হোক। বাসাটা ওর জন্যও নিরাপদ নয়। আজ বৃহস্পতিবার। এই দিন মৃদুলা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তারপরে বাড়ি ফিরে। কাজেই আরাফকে নিয়ে যাবে মৃদুলার কাছে।হ্যাঁ প্ল্যানটা ঠিক আছে। 

 

আরাফের অফিসের রাস্তা আসতেই ফারিয়া হাক ডেকে ডাকলো কন্টাকটার কে। ছেলেটা এতো মানুষের ভীড়ে তা শুনতে পেলোনা। তার উপরে একটা লোক প্রায় ওর গায়ের উপর উঠে পড়তে চাইছে এই অবস্থায় এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কাওকে ডাকা বৃথা। বাস ধীর গতির হয়েছে। কিছু মানুষ নামছে, কিছু উঠছে। বাসের টাকা না দিয়েই ফারিয়া নেমে গেলো বাস থেকে। আবার দ্রুত দৌড়ানো শুরু করলো। এতো শক্তি কোথা থেকে পেলো ও। বিপদ বুঝি শক্তি বাড়িয়ে দেয়। ফারিয়া আরাফের অফিসের সামনে পৌঁছে গেলো। গার্ড অন্য কাজে ব্যস্ত, টুপ করে ঢুকে পড়াটাই উত্তম, স্যারের ওয়াইফের এমন তর দশা দেখলে অফিসে কানাঘুষো শুরু হয়ে যাবে। আজ ফারিয়া অনেক গুলো অন্যায় কাজ করছে, এ ছাড়া উপায়ও নেই।

 

পুরো অফিসে করিডরের বাতি ছাড়া আর কোনো বাতি নেই। তবে কি আরাফ বেরিয়ে গেলো। ওর বৃহস্পতিবার এর মিটিং তো এত জলদি শেষ হয় না। দেখা যাবে আজই আগে শেষ হয়েছে, বিপদ যখন আসে চারদিক ঘিরে আসে। ফারিয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরাফের কেবিনটা খুজলো। হ্যা পেয়েও গেলো।ওর ঘরের বাতি জ্বলছে। দরজার নীচ দিয়ে তা স্পষ্টমান। ঘর থেকে হাল্কা কথার শব্দও ভেসে আসছে, হ্যাঁ ঐতো আরাফের গলা। আহা লোকটা কত পরিশ্রম করে এ-তো তারই জন্য। কিন্তু অফিসে আর কেও নেই কেনো। তবে কি আরাফ ওভারটাইম কাজ করে কটা টাকা বেশি আয় করবার জন্য। এই যে মৃদুলার পড়ার খরচ, মায়ের ওষুধ, ভাইয়ের আব্দার সব তো ঐ পুরন করে। কটা স্বামী তার স্ত্রীর পরিবারের এতো খেয়াল রাখে। ফারিয়া ভাবলো কেবিনে যে আছে তাকে এই অবস্থায় দেখলে নিশ্চিত বুঝে যাবে কি ঘটেছে তার সাথে। তারচে বরং একটু অপেক্ষা করা যাক। কতটা সময় বসেছিল ফারিয়ার মনে নেই। হঠাৎ মনে পড়ল মৃদুলাকেও তো আনতে যেতে হবে। না আর অপেক্ষা করা যাবেনা। ও আরাফের কাচের দৃশ্যমান কেবিনের একটা অংশে গেলো আরাফকে যদি ইশারায় কিছু বলা যায়। গিয়েই চমকে উঠলো।আরাফ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বেগে শার্ট গলিয়ে নিচ্ছে। সামনের সোফায় বসা মেয়েটার শাড়ির আচল কোমর অব্দি এলিয়ে পড়া। মেয়েটা কামুক চোখে তার ব্লাউজের বোতাম আটকাতে আটকাতে বলছে, আজকের দিনটায়ও তাড়াহুড়ো করবে তুমি আরাফ। তোমার বউকি কিছু বলবে নাকি! শালীকে একদিন কোচিং থেকে না নিতে গেলে হয়না বেবি? সত্যি করে বলোতো নাকি ঐ শালীর সাথে কোনো চক্কর চলছে তোমার। আরাফ মেয়েটির কাছে এসে ওর ঠোঁটে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বলল, না সোনা কি আবলতাবল বলছো? বিয়ে আমি তোমাকেই করছি। এই পাচ বছরে একটা সন্তান হয়নি ওকে ডিভোর্স দেয়া বিষয় না। তবে কাজটা আমি ঝামেলা করে করতে চাইছি না তুমি তো জানোই। জাস্ট আর কটা মাস অপেক্ষা করো। দেরি হয়ে যাচ্ছে পাখিটা আমার। রোববার বসের সাথে প্রমোশন নিয়ে কথা বলছো আমার, মনে আছে তো? মেয়েটি আরাফের গলা জড়িয়ে বললো, সব তো করছি তোমার জন্য, নাহয় ঐ বুড়োটার সাথে কে শুতে যায়। এ্যাই, তুমি না অনেক ভালো, নাহয় কিভাবে শেয়ার করো ঐ লোকটার সাথে আমায়?

আরাফ ওর নাক টিপে দিয়ে বললো, ভালো তো তুমি আমার জানপাখি, নাহয় এই যে প্রতিদিন বউয়ের কাছে যাচ্ছি এ কোন মেয়ে মেনে নিতো। আগে কেনো এলেনা জীবনে নীতু।

 

হ্যাঁ, নীতু, ওর অফিসের একাউন্টস এ কাজ করে। গতবারও তো ফারিয়ার এনিভার্সারি ডে তোড়া নিয়ে এলো। কি মিষ্টি করে ভাবী ডাকছিলো। ফারিয়ার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, পা দুখানাও টলে উঠছে বার কয়েক। সে দৌড়ে নিচে চলে এলো। ফারিয়া কিচ্ছুটি হয়নি করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আরাফ নামলো কিছু বাদেই। ফারিয়াকে দেখে তেমন ভাবান্তরও যেনো হলোনা। শুধু গাড়ির গেট খুলে দাড়ালো। ফারিয়া কিছু না বলেই উঠে পড়লো গাড়িতে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরাফের গলা শুনলো, কার সাথে যেনো কথা বলছে, মৃদুলা নাতো! মৃদুলাকে জানানো দরকার এই ভালোবাসাময় আরাফের আসল রুপ। আজই জানাবে, মৃদুলাই তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওকে না বললে যে দম আটকে মারা যাবে ফারিয়া। আচ্ছা আরাফকি সত্যি ওকে ছাড়তে চায়, সত্যি ভালোবাসেনা! নাকি শুধু প্রমোশনের জন্যে ঐ বাজে মেয়েটাকে কাজে লাগাচ্ছে।

ভালোবাসলে যে নামে ফারিয়াকে ডাকে সে নামে ঐ মেয়েটাকে ডাকলো কি করে। একি সত্যিই ওর আরাফ? নাকি আজকের পুরো দিনটাই একটা দুঃস্বপ্ন, ঘুম ভেঙ্গে দেখবে আগের মত। 

 

ফারিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিলো, ঘুম ভাঙলো মৃদুলার গলায়, হ্যাঁ ওর আদরের বোন মৃদুলা। ফারিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুনলো মৃদুলা বলছে, দেরি করলা কেনো? কতক্ষণ দাড়িয়ে আছি। আচ্ছা তোমার কি ভয় নেই আরাফ? চলো আজ হোটেল না বাড়িতে যাই।

একি শুনছে ও! আচ্ছা ওরা কেওকি দেখতে পাচ্ছে না ফারিয়া পেছনে বসে আছে। নাকি ওরা নিজেদের নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত।

ধ্যান ভাঙলো আরাফের স্বরে, বললো, কি যাতা বলছো, আজ যদি অন্যদিনের চাইতে জলদি বাড়ি ফিরি তবে কি হবে ভাবতে পারছো? পুলিশের প্রথম সন্দেহ হবে আমাকে। মৃদুলা ভয় পাওয়া গলায় বললো, কিন্তু আমার ভয় করছে আরাফ। আজ হোটেল না যাই। যদি পুলিশ বের করে ফেলে এই সময় আমি হোটেল ছিলাম। আর প্রতি বৃহস্পতিবার আমরা ওখানে যাই। আরাফ অধৈর্য গলায় বলল, আরেহ বোকা, সেদিন তোমার বান্ধবীকে এতো শপিং করে দিলাম কেনো? সে যেনো বলে তুমি তার সাথে ছিলে, আর মোবাইলটা রেখে এসেছো তো তার কাছে? কোনোভাবে লোকেশন পরে ট্রেস করলে জানতে পাবে তুমি কোথায় ছিলে সিম্পল। মৃদুলা এই সব কিছু কার জন্য করছি বলোতো? আমাদের জন্যই তো? তোমার জন্য মৃদুলা। তুমি এমন করলে শেষে তীরে এসে তরী ডুববে। মৃদুলা জড়িয়ে ধরলো আরাফকে।

 

ফারিয়ার কান ঝা ঝা করছে। অসার লাগছে পুরো শরীর, তার আদরের মৃদুলা এটা। তার কলিজার বোন এটা। সব কি ভুল শুনছে সে। ওরা দুজন মিলে পরিকল্পনা করে ওকে মারতে চেয়েছে। তার এই সোনায় গড়া সংসার পুরোটাই খাদে ভরা। ফারিয়ার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেনো মৃদুলা কেন? 

তুইইতো সবসময় বলতি আপা, তোর মত লক্ষী বউ হতে চাই আমি। তোদের প্রেম দেখলে না হিংসে হয়। সে সব তাহলে মৃদুলা সত্যিকারের মন থেকেই বলতো! মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছে। চাইলে এখনি চিৎকার করে বলতে পারে, গাড়ি থামাও আমি আর শুনতে চাইনা।

কিন্তু ফারিয়া বলবে না। কারণ ও বেঁচে আছে শুনলেই ওকে দুজন মিলে মেরে ফেলতে এতোটুকু দ্বিধা করবে না ওরা। কি অদ্ভুত জীবন, যাদের জন্য এক মুহূর্তে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলো ফারিয়া, আজ তাদেরই ভয়।

গাড়ি থামলে ওরা বেরিয়ে গেলো। ফারিয়াও বেরিয়ে এলো কিছু বাদে। হাটতে লাগলো এলোমেলো পায়ে। কোথায় যাবে ও? হ্যাঁ মায়ের কাছে। মায়ের বুকটা এখন খুব দরকার ওর। ফারিয়া খেয়াল করলো কেমন হালকা লাগছে শরীরটা, যেনো খুব ভারমুক্ত হয়েছে, শরীরের আর কোনো কষ্ট নেই। ভেসে ভেসে যেনো মুহূর্তেই টাঙ্গাইল পৌঁছে যেতে পারবে। তবু একটা নির্জন বাসে উঠে পড়লো। কটা বাজে এখন! হবে ন'টা সাড়ে নটার কাছাকাছি। প্রতি বৃহস্পতিবারে এইসময় তো বাড়ি ফেরে ওরা। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষে সারারাত তিনজন মিলে ভূতের সিনেমা দেখে। সত্যি তাহলে ও অনেক বোকা, গেয়ো, অশিক্ষিত। আরাফ ঠিকই বলেছে মৃদুলাকে। আজ সে বুঝেছে অফিসের পার্টিতে কেনো ফারিয়াকে নিয়ে যায়না আরাফ। ফারিয়ার বেশি লোকজনে আরষ্ঠ লাগে কারণ এটা না, কারণ ওকে নিয়ে গেলে লোকে হাসবে। তাইতো পড়াশুনো ইন্টারমেডিয়েটের পর আর হলোনা। মা তোড়জোড় শুরু করল ভালো পাত্রের। সবাই বলতো ফারিয়া দারুণ সংসারী হবে। কারণ সৎ মায়ের ভালোবাসা পেতে সে ততদিনে ঘরের যাবতীয় কাজ, সেলাই নানা কাজে দক্ষ একেবারে। পড়াশুনো কোনোদিনও তার ভালো লাগেনি। তাই ইন্টারমেডিয়েটের পর মা'কে বলতে প্রথমে একটু চোখ গরম করলেও পরে বাবাকে কি করে যেনো ম্যানেজ করে ফেললো। ফারিয়ার আপন মা নেই তো কি হয়েছে, এই মা-ও তাকে খুব বুঝে। মা মাঝে মাঝেই ফারিয়ার মুখটা দুহাতে জড়িয়ে বলতো, আমার লক্ষী মামনী, দেখবি তোকে আমি খুব সুপুত্রে পাত্রস্থ করব। আজ যদি মা সব জানে তবে কষ্ট পাবে খুব নিশ্চয়ই। আহা মায়ের মুখটা ভাবতেই আবারও কান্না পেয়ে গেলো ওর।

 

বাস থেমেছে। এখান থেকে বাড়ি পায়ে হাটা দূরত্ব। রাত অনেক হয়েছে নিশ্চয়ই। এসময়ে সকলে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কি জবাব দিবে বাবাকে।তার হঠাৎ মনে পড়লো এবারেও বাসের ভাড়া না দিয়েই মেনে পড়েছে সে। ফারিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। ওদের বাড়িটা টিনশেডের এক তলা। গাছের আড়াল দিয়ে বাড়ি ঢুকে বুঝলো, মায়ের ঘরের বাতি জ্বালানো। ফারিয়ার মনটা এই কষ্টেও একটা আশার আলো দেখলো। তাড়াতাড়ি বাবা উঠে না যায় এমন করে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মা'কে ডাকবে তখনই শুনলো মায়ের ফিসফিসে গলা, বলছে, শোন খুব সাবধান, পুলিশের কাছে বুঝে শুনে কথা বলবি। আমরা সকাল হলেই রওনা দেবো। তোর বাবা সংবাদ শুনে সে-ই যে পাথর হয়েছে নড়ার নাম নেই। এই মেয়ে সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। তোর বাবার খালি তাকে নিয়েই চিন্তা। যত্তসব ফাজলামো! এতো ভালো প্রস্তাব, তোকে বিয়ে দেয়ার কি শখটাই না ছিলো আমার, হলো কার? ঐ মেয়ের। বড় ঘরে বিয়ে হবে তাই সব টাকা খরচা করে বিয়ে দিলো। তোদের দিকে খেয়াল আছে তার? যেই মেয়ের সাথে রাগ, মেয়ে কেনো পড়লো না, সেই মেয়েকে নিয়ে যত মাথা ব্যাথা তার। কেনো মেয়ে পড়লো না, কেনো মেয়ে খালি রান্নাবাড়া করে, মেয়ের পছন্দের খাবার খেলেও গলা দিয়ে ভাত নামেনা বুড়োর। সারাজীবন পরের সংসারটাই যেনো করে গেছি। ঐ মেয়ের মাঝে তোর বাবা তার মা'কে দেখে গেছে বলে। আমার মেয়েকে আমি সেই কষ্ট পেতে দেবোনা। ঐ জায়গা তোরই মা, ওটা তোরই সংসার, আচ্ছা শোন রাখি, তোর বাবা কি করছে দেখে আসি।

 

বাকশক্তিহীন হয়ে ফারিয়া দাড়িয়ে রইলো। তার মানে তাকে খোঁজ শুরু হয়েছে। ফারিয়া দৌড়ে গেলো বাবার ঘরে, আরেহ দরজা তো আটকানো তবে সে ঢুকলো কিকরে! তার শরীর এতো হালকাই বা লাগছে কেনো? ফারিয়া এগিয়ে গেলো বাবার কাছে, বাবা ডুকরে কেঁদে বলছে, মারে! আমি একজন ব্যর্থ বাবা। তোর অভিমানের দেয়াল ঘেঁষে তোর যেতে পারিনি, শুধু দূরে সরিয়েছিরে মা! মারে তুই মরে গিয়ে আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব করে দিলি। আমি কি করে বাঁচবো বল। 

নাহ আর শোনা সম্ভব না। তার মানে ও মারা গেছে। তাই কেও তাকে দেখতেই পাচ্ছেনা। ফারিয়া বাতাসে ভেসে বেরিয়ে এলো। ছোট ভাইটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফারিয়া কিছু বললো না। কে শুনবে তার কথা। প্রায় বাতাসে ভেসেই সে চলে এলো তার বাড়ি, না তার বাড়ি না আরাফের বাড়ি। ফ্লাটের সামনে ভিড়, ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ অফিসারদের দেখা যাচ্ছে। ফারিয়া দেখলো সাদা কাপড়ে তাকে জড়িয়ে রেখেছে। মেঝেতে জমাট বাধা ছোপ ছোপ রক্ত। ফারিয়ার মাথা ঘুরিয়ে গেলো। মনে হলো শরীরটা না শরীর না। তার আত্মাটা মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসের সাথে। 

 

তীব্র ঝাকুনিতে চোখ খুললো ফারিয়া। কি ঘটছে বুঝে নিতে সময় লাগলো। পাশে আরাফ বসে। চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, এই কি হয়েছে ফারুপাখি? ঘুমের ভেতর কাঁদছো কেন? এসো বুকে এসো আমার। ফারিয়া বললো, কোথায় আমি? আরাফ অবাক গলায় বললো, সেকি আমাদের বাসায়, আমাদের বিছানায়, খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছো বুঝি? ফারিয়া হাই তুলে বললো, কটা বাজে? আজ কি বার?

আরাফ এবার নিশ্চিত গলায় উত্তর দিলো, আমার বউয়ের তাহলে ধ্যান ভেঙেছে। আজ বৃহস্পতিবার। তুমি উঠতে দেরি করছিলে তাই মৃদুলাই নাস্তা বানিয়েছে। আমি তোমাকে ডাকিনি আর। ফারিয়া বললো, আচ্ছা আরাফ, মৃদুলা কে কোচিং থেকে তুমি কি প্রায়ই আনতে যাও? এই প্রথম আরাফের চোখে ফারিয়া স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখলো। থতমত গলায় বললো, কই নাতো। তবে আজ আমাকে বললো নিতে যেতে। কোচিং এর পর কোন বান্ধবীর বাড়ি যাবে বললো, কেনো বলোতো? কোনো কাজ আছে? ফারিয়া আবার হাই তুলে বললো, আচ্ছা শোনোনা, আমাকে ছ'মাস আগে যে ইনজেকশন টা দিয়ে আনলে তা কিসের যেনো ছিলো? আরাফ ভয়ার্ত গলায় বললো, সে তো তুমি জানোই, তুমি দুর্বল বলে ডাক্তার বলেছে ছ'মাস অন্তর অন্তর একটা ডোস দিতে। কি হয়েছে তোমার পাখি? শরীর খারাপ লাগছে? ফারিয়া বললো, এই প্রথম শরীর খুব ভালো লাগছে, মনও। আজ তো তোমার মিটিং আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে। আমি মৃদুলাকে বলে দেবো একাই যেনো আসে। আরাফ দ্রুত গলায় বললো, কেনো কোনো কাজ আছে? ফারিয়া বললো, হুম বাড়িটা ছাড়তে হবে, তোমাকে আগেই বলেছি বাড়িওয়ালার ভাগ্নের নজরটা ভালো না। হেসে উড়িয়ে দিয়েছো। আমি অল্প শিক্ষিত সরল হলেও বোকা না আরাফ। এই বলে ফারিয়া এগিয়ে গেলো হতভম্ব মুখের আরাফ কে পিছনে রেখে। তারপর হঠাৎ ফিরে বলল, আর এই পাখি পাখি করে ডাকবে নাতো আমায়, জঘন্য লাগে। মৃদুলার প্লেটে রুটি দিয়ে ফারিয়া বললো, তুই হোস্টেলে উঠে যা মৃদুলা। আমরা বাসা বদলাবো। সম্ভব হলে কালই উঠবি। আমি উঠিয়ে দিয়ে আসবো। আর মা'কে বলবি খরচ বেড়ে গেছে ওষুধের টাকা দেয়া আর সম্ভব হচ্ছেনা। ফারিয়া দেখলো মৃদুলা বড় চোখ করে রুটি মুখে নিয়ে বসে আছে। ফারিয়া বললো, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। ক্লাসের দেরি হবে। 

 

ঘরে গিয়ে বাবাকে এতো গুলো বছর পর ফোন দিয়ে বললো, কেমন আছো বাবা?

ফোনের ওপাশে বাবা নিশ্চুপ রইলেন।কিছুক্ষণ বাদে ভারি গলায় বললেন, অভিমান ভেঙেছে মা? 

ফারিয়া চোখের পানি মুখে বললো, হ্যাঁ বাবা এতোদিন দুচোখ দিয়ে দেখতাম শুধু আজ থেকে যে মনের চোখ দিয়ে দেখছি। বাবা আমার অনার্সের ভর্তির ব্যবস্থা করো তো জলদি। বাবা প্রাণ খুলে হাসলেন।

কতকাল ফারিয়ার এই হাসি শোনা হয়নি। 

 


Tanvir Arafat

93 Blogg inlägg

Kommentarer