পঞ্চরঙ্গ

কিছু মানুষের জীবন কাহিনী কখনো ভুলা যায় না।

 

 

তুমি যেই জায়গায় এখন বসে আছো, ঠিক এই জায়গায় আমার মা বসেছিলেন, আমার বাবাও বসেছিলেন!

 

ইডেন গার্ডেনের চার নাম্বার বেঞ্চিতে বসে গল্প করছিলাম আমার প্রেমিকা রিকার সাথে। বেঞ্চির একদম উপরে একটা বড় বট গাছ এমনভাবে ছেয়ে আছে যেন মনে হচ্ছে এই কঠোর রোদে শুধু আমাদেরই ছায়া দিতে সে জন্মেছে! 

 

 

একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ। সেটা ছাপিয়ে কিছুক্ষণ পরপর আগরবাতির ঘ্রাণও নাকে আসছে। 

কাছেই কোথাও শেয়াল ডাকছিলো। বাড়ির পিছনেই ঘন জঙ্গল। সেদিক থেকেই শেয়ালের হাঁক শোনা যায়। আগরবাতির ঘ্রাণের উৎস কোথায় তা পরিষ্কার নয়। মাঝারি এই গ্রামটাতে খবর খুব দ্রুতই ছড়িয়ে যায়। তাই কেও মারা গেলে অবশ্যই তা কানে আসার কথা। 

- মাফি আছোস?

ঝিমুনিতে চোখ বুজে আসছিলো, তা সজাগ হয়ে গেলো। নিশুতিতে একবার ডাকে জবাব দিতে নেই। দ্বিতীয় ডাকের অপেক্ষা করলাম। 

- ওই মাফি, বাড়ি আছোস?

হ্যা, এইবার নিশ্চিত হলাম। উত্তরপাড়ার সবুজ ডাকতে এসেছে। গ্রামের কবরস্থানে কবর খোড়ায় আমার সঙ্গী। কেও মারা গেলে সবার আগে সবুজই জানতে পারে। 

এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিলাম। বাইরে সবুজ দাঁড়িয়ে আছে। হাতের টর্চের আলোতে মাথায় প্যাচানো গামছা আর কাধের কোদাল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। অন্ধকারে গায়ের সাদা গেঞ্জিটা স্পষ্ট ফুটে উঠছিলো বিধায় গেঞ্জির দিকে আলো না পরলেও চলতো। 

 

- কি হইছে?

- কবর খোড়া লাগবে। তাড়াতাড়ি চল। 

- কে মরছে?

- হাসান কাকার মাইয়াডা ফাস নিছে। 

- কস কি?

- হ। লোকজন জানাজানির আগে কবর দিয়া দেওন লাগবো। টাকা পয়সা বেশি দিবোনে। চিন্তা করিস না। 

এক মুহুর্ত ভেবে নিলাম। এই মুহুর্তে আসলেই টাকার অনেক দরকার। হাসান কাকা এলাকার সম্মানীয় ব্যাক্তি। তার সম্মান রক্ষা করলে অবশ্যই উপড়ি কিছু কামাই করা যাবে। 

দ্রুত পায়ে গামছা গায়ে জড়িয়ে কোদাল কাধে বের হলাম। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বাঁশঝাড় পেরিয়ে কবরস্থানে ছুটলাম দুজন। পথে যে দুইটা শিয়ালের চোখ চকচক করছিলো, তা গ্রাহ্যই করলাম না। 

ফস করে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে বিড়ি ধরালাম। কবরস্থানে ধুমপান করা অনেক পাপ। তাই বাইরে থেকেই শরীর গরম করে নিতে হবে। 

- সবুইজ্জ্যা নিবি একটা?

সবুজ কোন কথা না বলে কবরস্থানের ভিতরে ঢুকে পরলো। আমি নিশ্চিন্ত মনে বিড়িতে টান দিলাম। 

 

- মাপ আনছোস সবুইজ্জ্যা?

সবুজ কথা না বলে পাশে ইশারা করে পাটের সোলাটা দেখালো। 

- হাসান কাকার মাইয়া এত উচা?

সবুজ কিছু না বলে মুচকি হাসি দিলো। 

- কিরে হাসোস ক্যান?

সবুজ আবারও জবাব না দিয়ে মাটিতে কোপ শুরু করলো। যাই হোক, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তাড়াতাড়ি কবর খুড়ি। এরপর আবার বাঁশ কাটতে হবে। 

কাজে ব্যাস্ত ছিলাম। টর্চটা জ্বালিয়ে রেখে দ্রুতই মাটি সরিয়ে ফেলছিলাম। টিপটিপ বৃষ্টি আবারও শুরু হয়েছে। কিছু একটা দিয়ে কবর ঢেকে ফেলতে হবে। না হলে পানি জমে যাবে। 

- সবুইজ্জ্যা পেলাস্টিকের কাগজটা আন তো...

বলতে বলতে উপরে তাকালাম। 

সবুজ নাই। মানে কি! মাত্রই না দেখলাম। 

- সবুইজ্জ্যা কই গেলি রে?

কোনো আওয়াজ আসলো না। সম্পূর্ণ কবরস্থানের মধ্যে আমি একা দাঁড়িয়ে। টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা টর্চ নিয়েও ভরসা পাচ্ছি না। যেকোন মুহুর্তে নিভে যেতে পারে। 

লাফ দিয়ে কবর থেকে উঠে আশেপাশে খোজার চেস্টা করলাম। লাভ হলো না। কেও থাকলে তো খুজবো। বৃষ্টি ক্রমেই জোরে শুরু হচ্ছিলো। উত্তর সীমান্তে বাঁশের চাটাই এর পাশে প্লাস্টিকের কাগজ থাকে। সেটা দিয়ে ভালোভাবে কবরটা ঢেকে দিলাম। 

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই আবারও শিয়ালটার সাথে দেখা। আগের যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ঘোলাটে চোখ লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাকি কে জানে? টর্চের আলো কম থাকায় বুঝতে পারলাম না। অকারণেই কোদাল তুলে ভয় দেখানোর চেস্টা করলাম। ভয় পেলো বলে মনে হলো না। 

 

কাঠের দরজায় ঠকঠক ঠকঠক। 

- মাফি ভাই, ও মাফি ভাই?

সবে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে বসেছি, এরই মাঝে কে ডাকতে এলো?

- ও মাফি ভাই? আমি সুজন। উত্তরপাড়ায়। 

- কি হইছে? বলতে বলতে দরজা খুললাম। 

- সবুজ ভাই মইরা গেছে। আইজকা সন্ধ্যায় বৃষ্টির সময়। 

আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে গেলো। 

- মানে কি?

- তাড়াতাড়ি চলেন। বাজ পড়ছে মাথার উপরে। 

কিছুই আর চিন্তা করতে পারছিলাম না। সবুজের সাথে তো একটু আগে আমি কবর খুড়লাম? তাহলে সন্ধ্যায় মারা গেলো কে?

- সুজন

- হুম্ম ভাই। 

- হাসানা কাকার মাইয়া নাকি ফাস নিছে?

- ধুর ভাই, কি বলেন? হাসান কাকার তো মাইয়াই নাই। দুইটা পোলা আছে খালি।

 

সবুজের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার উপর থেকে কপালের ডান পাশ পর্যন্ত কালো কুচকুচে হয়ে আছে। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে মুখে মুচকি হাসি। যেন এইতো আছি আমি বেশ। আমার জন্য চিন্তা কিসের?

অথচ মুচকি হাসির আড়ালে ও নিজের কবর নিজে খুড়ে শুয়ে আছ।

'বসতেই পারে। এটা তো পাবলিক সিট।'

 

রিকার এই প্রশ্নে আমি সামান্য হাসলাম কারণ আমি জানি তার পরের উত্তরে সে একটু বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হবে। 

 

'ঠিক এই জায়গায় বসার পরই আমার বাবা ও মা একসাথে মারা যায়।'

 

আমার পূর্বের বাণী ঠিক ফলেছে৷ রিকা ভয় পেয়েছে। ভিক্টর ফ্রাংকির সাইকোলজির বই ঘেটে তবে আমার লাভ হলো। 

 

রিকা বেঞ্চ থেকে উঠে দাড়ালো। 

 

'তুমি আমাকে জানালে না? তোমার মা বাবা মারা গিয়েছেন?'

 

'জানানোর সময় কই? তুমি তো আমার প্রেমিকা হলে মাত্র এক সপ্তাহ পেরোলো।'

 

রিতা বেঞ্চে বসে আমার হাত ধরলো। 

 

'কবে ঘটেছে এই ঘটনা?'

 

আমি তার হাতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে নির্ভাবনায় খেলতে লেগে গেলাম। 

 

'শাফি?'

 

'দু বছর আগে। একটা ফাংশান থেকে ফেরার পথে ট্রাকের তলায় পিসে পড়েন৷'

 

'উহ।' 

 

'অনেকের জীবনে অনেক ইচ্ছে থাকে। আমারও ইচ্ছে ছিলো মা বাবার মৃত মুখখানা চুমু খাবো। যখন শুনেছি মারা গেছেন, দৌড়ে এলাম ঘরে। চুমু খেতে গিয়ে দেখি মা বাবা দুইজনেরই মাথা খানা নেই। এত ওজনের ট্রাক সেটা পিষিয়ে নিয়ে গেছে।'

 

ঘাসের দিকে একটা ফড়িং লক্ষ্য করলাম। একই ঘাসে পিপড়ে দেখতে পেলাম। দুজনে ঘাসের দখল নিবার জন্য লড়াই করছে৷ অথচ তাদের চোখখানা দিয়ে একটু এদিক ওদিক তাকালে পুরো মাঠটাই তাদের থাকত!

 

আমি একটু অন্যমনা হয়ে গেলে রিকা আমাকে আরও জড়িয়ে ধরে৷ সে ভাবছে আমি হয়তো সেই দুঃখের শোকে মন নিয়ে কোথাও হারিয়ে গেছি। কিন্তু আমি যে কি ভাবছি সেটা রিকা শুনলে বিশ্বাস করবে না। এত কষ্টের মাঝে সামান্য সৃষ্টি নিয়ে দার্শনিক চিন্তাভাবনা আর কে করতে পারে? 

 

'চলো এখানে না বসি। একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি?'

 

রিকা আমার উপর মায়া দেখাচ্ছে৷ 

 

আমি বললাম, 'তুমি ব্যাচেলর থাকো এক বাসায়। বাসা থাকতে আমায় রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে?'

 

'উহু শাফি এখন না।'

 

'কি এখন না?'

 

'কিছু না। চলো।'

 

একটা সবুজ রঙের রিকশায় আমরা দুজন উঠলাম। এতক্ষণে রিকার পরণের নীল সালোয়ার কামিজ আমার নজরে এলো। আহ! নীল রঙ আমার এত প্রিয়৷ সাথে কানের দুলটাও নীল রঙের। 

 

'তোমায় বেশ মানাচ্ছে রিকা!'

 

'এতক্ষণে দেখলে! প্রায় দু ঘন্টা যাবত পার্কে ছিলাম।'

 

আমি দাত বের করে খুব কমই হাসি। আমাকে মানায় না যে তা নয় কিন্তু দাত বের করে হাসতে আমি এতটা স্বস্তির মনে করি না৷ দাত বের করে আমি রিকার দিকে বললাম, 'হিহি।'

 

'কি হিহি?'

 

'খেয়াল করিনি আসলে। তবে এখন তোমার খেয়ালেই আছি।'

 

'হুহ। কবির প্রেমে পড়লে এইটা পজেটিভ দিক। শব্দ দিয়ে রাগ ভাঙিয়ে নিতে পারে।'

 

'তুমি আমার কয়টা কবিতা পড়েছো?'

 

'তোমার কবিতার বই ৪ টে। একটা আমি পুরো পড়েছি।'

 

'আমার কবিতার বই কেউ কিনে না! '

 

'গত বইমেলায় কয়টা বিক্রি হয়েছে?'

 

'দশটার মতন। এর মধ্যে দুটো আমি নিজে লুকিয়ে গিয়ে কিনেছি। অবশ্য লুকোনোর কোনো কারণ ছিলো না। স্টলের কেউ আমাকে তেমন চিনতও না।'

 

'দুটো কিনেছিলে কেন?'

 

'একটা কিনেছিলাম আমার বন্ধুর জন্মদিনে উপহার দিবার জন্য। আরেকটা আমার বুকশেলফে রাখার জন্য।'

 

আমাকে দেখে রিকার একটু মায়া হচ্ছে। মায়া জন্মানো মানেই দূর্বল হয়ে পড়া। মন ও কায়া দুটোই একত্রে দিয়ে দেওয়া৷ 

 

এবার সে আমার হাতের ভিতরে হাত রেখে অন্য কথায় চলে যেতে চাইলো। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। কারণ আমরা বোধহয় তার বাসার সামনে এসে পড়েছি। রিক্সা থেমে পড়লো। শরীরের জড়তা নিয়েই লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। রিকা নেমে ভাড়া দিতে চাইলো। আমি থামিয়ে মানি ব্যাগ থেকে পনেরো টাকা দিয়ে দিলাম। এখন আমার কাছে আছে মাত্র দশ টাকা। 

 

'আসো!'

 

আমি ভিতরে ঢুকলাম। গোফে খানিকটা সংসর্গ দিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছি। রিকা আমার সামনে। তার জুতা থেকে সিড়িতে উঠার এক অদ্ভুত শব্দ করছে৷ 

 

'টরক' লকের শব্দে দরজা খুলে গেলো। 

'আসো, কিছু মনে করবে না আমার বাসা কিন্তু খুব অগোছালো।'

 

ভেবেছিলাম ব্যাচেলর বলে হয়তো দুই রুমের বা এক রুমের বাসা নিবে। কিন্তু চার রুমের বিশাল বাসায় এনে রিকা আমাকে রীতিমতো অবাক করে দিয়েছে! 

 

'কি সুন্দর বাসা' কথাটা মনে মনেই বললাম। 

 

বাসার ভিতরে ঢুকতে কিছু আর্ট পুরো দেয়াল জুড়ে টাঙানো। প্রথমে মনে হচ্ছিলো কোনো আর্ট মিউজিয়ামে এসেছি৷ 

 

'তুমি এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?'

 

'এই আর্টগুলো কি তোমার আকা না?'

 

'হুম! তুমি কি করে জানলে?'

 

'তুমি পার্কে তোমার আঙুল যখন আমার আঙুলে ঢুকালে তখন তোমার তালুতে কিছু রঙ দেখতে পাই। তখনি বুঝেছি তুমি আর্ট করো।'

 

রিকা অবাক হলো। এই অবাক হওয়ার খেলা হয়তো আরও কিছুদিন চলবে এভাবে। 

 

বেড রুমে ঢুকে আমি সামনে থাকা ইজি চেয়ারে বসলাম। 

 

'তুমি এখানে বসো। আমি আসছি।'

 

আমি তার হাত ধরে বললাম, 'কোথায় যাও?'

 

'শাড়ি পড়তে?'

 

'কিসের জন্য? '

 

'তোমার জন্য।'

 

'কোনো দরকার আছে? তুমি যেমন আছো তেমনি তো সুন্দর।'

 

'আচ্ছা ঠিক আছে যাও।'

 

পকেট থেকে ব্ল্যাক সিগারেটটা বের করে আগুন ধরাতে লাগলাম। রিকা পেছনে ঘুরে আমার দিকে বড় চোখে তাকালো। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে বসি। আমার এরুপ কর্মকাণ্ড রিকা কি অপছন্দ করেছে? 

 

'তোমার জন্য একটা উপহার আছে।'

 

এবার আমার চোখ বড় হয়ে উঠলো। 'কি উপহার শুনি?'

 

ওয়ারড্রবের পাশের ড্রয়ার থেকে কিছু একটা খোজাখুজি চলছে। একটা কালো রঙের বাক্স বের করে আমার সামনে রাখা হলো। 

 

'খুলে দেখো।'

 

অনেক দিন পর কৌতুহলী হয়ে পড়লাম। বক্স খুলে আমি রীতিমতো অবাক চোখে রিকার দিকে তাকালে সে মুচকি হেসে অন্য রুমের দিকে রওনা হয়৷ 

 

"ট্রেজার লাক্সারি ব্ল্যাক" পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সিগারেট। যার একটার দাম প্রায় সাড়ে পাচ হাজার টাকা। আমি জোরে একটা ডাক দিয়ে বললাম, 'তুমি কি সিগারেট খাও রিকা?'

 

'জ্বি আমি মাঝে মাঝেই খাই।'

 

'এই বক্স কি আমার জন্য?'

 

'হ্যাঁ তোমার জন্য। তুমি আজকে আমাকে অবাক করেছো তাই তোমার জন্য এই উপহার। আরও অবাক করতে থাকো!'

 

পেছনে ঘুরে এক হাসি দিয়ে পায়ের জুতা খুলে রুমের মধ্যে রিকা ঢুকে পড়লো। 

 

'কি অদ্ভুত!'

 

মুখে ট্রেজার প্রবেশ করে আমি রিকার হাসির নেশায় পড়ে গেলাম। 

 

নীল শাড়ি! আহ্ আজ যেন শুধু আমারই দিন৷ ট্রেজার চারমিনার টা মুখে দিয়ে প্রায় শেষের পথে। রিকা হেটে হেটে আসছে আমার দিকে। পুরোটা প্রায় দশ সেকেন্ড যাবত মুখেই পড়ে আছে৷ ধোয়া আমার বুকের ভেতরে প্রচন্ডরকম চাপ দিচ্ছে। এখন বের না করলে শরীরের প্রকৃতি জোরপূর্বক বের করতে চাইবে৷ সবটুকু ধোয়া আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমার মুখ এক মুহুর্তের জন্য ঢেকে গেলো। আমি রিকাকে দেখতে পারছি না। আমি অস্বস্তি বোধ করছি! দ্রুত ধোয়া সরিয়ে ইজি চেয়ার থেকে উঠে পড়তে চাইলাম। রিকা আমার সামনে চলে এসেছে। 

 

'আমাকে কেমন লাগছে?'

 

এক সুন্দরী অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে সিল্কের নীল শাড়ি পড়েছে, যার কোমড়ে নেই কোনো ভাজ; একটু পরপর নাভি উদয় হচ্ছে। সে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছে 'আমাকে কেমন লাগছে!'

 

প্রচন্ড রকমের আকর্ষিত হলে মানুষ চুপ হয়ে যায়। আমি চুপ হয়ে রইলাম। 

 

'কিছু বলছো না কেন?'

 

"একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।  

সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা–  

অথবা দুপুরবেলা — বিকেলের আসন্ন আলোয়–  

চেয়ে আছে — চলে যায় — জলের প্রতিভা।"

 

রিকা তার বেডে বসে পড়লো। আমার কবিতা আবৃত্তি শুনে সে খানিকটা খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করছে, 'তোমার কবিতা?'

 

রিকা কবিতা পড়ে না। তাই সে জীবনানন্দ দাশকেও চিনে না৷ খুশিরই বটে কিছু মিল পেলাম জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে। তাকেও খুব কম মানুষই চিনেছে আমাকেও অতি নগন্য এর চেয়েও কম মানুষ চিনে। না এই তুলনায় ও ফারাক আছে অনেক। 

 

বক্স থেকে আরেকটা ট্রেজার চারমিনার বের করতে মনে চাইলো। বের করলাম না।

 

'শাফি। তোমার এখন কেমন লাগছে?'

 

'আমি তো অসুস্থ নই। খুব ভালো লাগছে।'

 

'না আমাকে দেখার পর কেমন লাগছে?'

 

'বরাবরের মতোই ভালো।'

 

আমি রিকার একটা পরিক্ষা করতে চাইলাম। মনে মনে সেটা ঘুরপাক করছিলো। আমি তাকে বললাম, 'একটা সিগারেট খাও!'

 

রিকা এতটা অবাক হয়নি তবে সে বললো, 'এখন খাওয়ার কি দরকার আছে?'

 

'খেলে কি খুব সমস্যা হয়ে যাবে?'

 

রিকা হাত দুটো উঠিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। সামনে অগ্রসর হয়ে ওয়ারড্রব থেকে একটা দামি দেশলাই এর স্টিলের বক্স বের করে।

 

'একটা বের করো।'

 

আমি বের করলাম। আমি ইজি চেয়ার থেকে উঠে তার কাছে পুরোগামী হলাম। সিগারেটটা তার মুখে প্রবেশ করানোর পর সেই দামি লাইটার দিয়ে সিগারেটের এক প্রান্ত জ্বালিয়ে দিয়েছি। এবার দেখবো রিকা কি করবে। সেটা ভালো করে দেখার জন্য আমাকে দুই ফিট পেছনে কদম ফেলতে হবে। যথারীতি তাই করলাম। 

 

একটা টান, দুটো টান, তিনটে টান। পরপর তিনটে টান দিয়ে সে ইজি চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে বললো, 'তুমি কি আমাকে পরিক্ষা করতে চাইছো?'

 

'কিসের পরিক্ষা?'

 

'আমি ধূমপান করতে পারি কিনা?'

 

'না। দেখতে চাইছিলাম শাড়ি পড়ে আমার সামনে এখন পর্যন্ত কোনো মেয়ে চারমিনার খায়নি। এই সৌন্দর্য মিস করতে চাইনি।'

 

'তুমি কি ভেবেছো আমি শুধু সিগারেট পান করতে পারি? এর বাদে বাকি যত নেশা আছে সব আমি করেছি।'

 

'করতেই পারো।'

 

কথাটা খুব স্বাভাবিক ভাবে শোনালেও আমার ভেতরটা খুব অস্বাভাবিক ভাবে কি যেন করছে৷ মনে একদম বিশ্বাস হচ্ছে না। 

 

রিকার সাথে আমার দেখা হয় এক রেস্টুরেন্টে। তখন একটা জিনস ও ফুল হাতার শার্ট ভাজ করে সে বসে ছিল। আমি বরাবরের মতোই রেস্টুরেন্টে এসেছিলাম এক কাপ লেমনেড খেতে৷ খেতে খেতে তখন 'The Kite Runner' বইটি পড়ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করি রিকা রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। আমার নজরে তখন আসেনি যতক্ষণ না সে আমার ঠিক সামনের টেবিলটিতে বসে। আমার চোখ কিছুক্ষণের জন্য তার দিকে যায়। ব্যাস,,, ওইদিন অতটুকুই দেখেছিলাম। সে আর আমাকে দেখেনি। 

 

তার কিছুদিন পরের ঘটনা। বুক লাইব্রেরি নামের একটা বড় লাইব্রেরি আছে। ভেতরটা তিন তালার। এই লাইব্রেরিতে আমি প্রায়ই আসি বই পড়তে, বই কিনতে। 

 

আর গর্বের বিষয় হচ্ছে এই লাইব্রেরির একটা শেলফে আমার একটা বইও স্থান পেয়েছে কালেভদ্রে। একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে শেলফে একটু এগোলাম আমার বইয়ের সারি দেখতে। 

 

অবাক না রীতিমতো খুব অবাক হলাম! একটা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আমার বইটা পড়ছে ঘেটে ঘেটে৷ আমি প্রথমে ভেবেছিলাম প্রচ্ছদ সুন্দর বলে দেখেই রেখে দিবে। কিন্তু তাজ্জব ঘটনা, প্রায় দশ মিনিটের মতো বইটা ঘাটলো৷ এরপর বইয়ের একটা ছবি তুললো। এবং সেটা শেলফে না রেখে হাতে করে কাউন্টারের দিকে চলে গেলো। আমি তার পিছন করলাম। কারণ আমার দেখতে হবে এই মেয়েটা করছে কি। ওইদিন রেস্টুরেন্টে যাকে দেখেছিলাম সে-ই আমার বই হাতে নিয়ে সেটা কিনতে যাচ্ছে! 

 

আমিও তার সাথে সাথে কাউন্টারে গিয়ে দাড়াই। সে বইটা কেনার জন্য টাকা বের করতে গিয়ে তার নজর আমার দিকে যায়। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বইয়ের ফ্ল্যাপ টা খুলে শেষের দিকে থাকা আমার ছবিটা দেখে আবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। আমি একটা হাসি দিলাম। 

 

'আপনিই কি শাফি ইবনে শাদ না?'

 

'জ্বি আমিই।'

 

'ওহ! আপনার এই কবিতার বইটা পড়ছিলাম৷ অসম্ভব সুন্দর লিখেছেন আপনি। তাই কিনে নিচ্ছি।'

 

কথাটা বলে মিষ্টি রিকা মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। 

 

হাসিটা সজোরে আমার বুকে গিয়ে আঘাত করলো। বই কিনে আমি তার পিছন পিছন এগোই নি। সে বেরিয়ে যাচ্ছিল; কি মনে করে আবার পেছনে ফিরে আমার দিকে আসলো। 

 

'কিছু না মনে করলে আপনার সাথে কি এক কাপ চা পান করা যেতে পারে?'

 

যেই কথাটা আমার বলার ছিলো সেটা রিকা আমার মুখ থেকে কেড়ে নিলো৷ তখনি ঠিক করেছিলাম তার থেকে অনেক কিছুই আমার কেড়ে নেয়ার বাকি আছে। 

 

'এই শাফি!'

 

আমার হুশ এক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এলো। 

 

'বলো।'

 

'কি ভাবছো তুমি?'

 

'কিছু না।'

 

'না ভাবলে একটা কথা বলি?'

 

"আমার না মাথাটা কেমন করছে!"

 

আমি প্রশ্ন করার আগেই রিকা আমার গালে একটা চুমু খেয়ে ফেললো ততক্ষণে।

 

রিকা আমার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। অজ্ঞান হলে ভুল হবে৷ মৃত্যু তাকে ভালোভাবে ধারণ করে ফেলেছে। কাজটা খুব দ্রুতই হয়ে গেলো। সিগারেটির ভিতরে আমি যা দিয়েছি তা কেউ টানলে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট বাচঁতে পারবে৷ রিকা তো দূর্বল হৃদয়ের মানুষ। হার্টে নাকি একবার মাইনর এটাকও হয়েছিলো। যাই হোক রিকার পা দুটো আমার পা দিয়ে সরিয়ে আমি একটি চারমিনার ধরালাম৷ তৎক্ষণাৎ আমার মাথা এলো আমার পঞ্চম বইয়ের নাম হবে, "পঞ্চরঙ্গ"। এই বইটি আমি রিকাকে উৎসর্গ করব। 

 

 


Tanvir Arafat

93 Blog posts

Comments