ইচ্ছে পূরণ

মানুষের অনেক শখ থাকে। শখের পাশাপাশি ইচ্ছাও থাকে।

 

 

"তোমার জন্য তাজমহল আনছি। দেখবা?" বলেই জামার পকেটে হাত ঢুকায় রেজা। মিথি গদগদ হয়ে বলে, "তাজমহল? কই, দেখি?"

 

রেজা পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে দেয়। সেটাতে লেখা, "তাজমহল।" কাগজটা নেতিয়ে গেছে। হাতের লেখাটাও আনাড়ি। সেটা দেখে মুখ ভার হয়ে যায় মিথির। সে একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে, "এই তোমার তাজমহল?"

 

রেজা সবেগে বলে, "হ, চোউক্ষে দ্যাহোস না? এই যে, ত আকার তা বর্গিয় জ তাজ। ম হ আর ল মহল। হইলো তো তাজমহল, না কি?"

 

"তোমার তাজমহল তুমি নিজের কাছেই রাখো।" বলে রাগে গজরাতে গজরাতে রেজার পকেটে কাগজটা ঢুকিয়ে দেয় মিথি। তখনই তার হাতে কী একটা টের পায়। পকেটের ভিতরে কী একটা আছে। রেজা ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছিল। মিথি জোর করে সেটা বের করে এনে তার চোখ কপালে উঠে যায়। বিড়ির প্যাকেটটা দু'আঙুলে ধরে বাঁকা মুখে সে বলে, "নাউজুবিল্লা! তুমি বিড়ি খাও! বিড়ি খাও তুমি!"

 

রেজা দ্রুত মিথির মুখ চেপে ধরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, "চুপ কর! আব্বার কানে গেলে মাইরা ফালাইব!"

 

মিথি রেজার হাতে কামড় বসিয়ে পালিয়ে যায়। বিড়ির প্যাকেটটা রয়ে যায় তার হাতে। সন্ধ্যের আগে আগে বাড়ি ফিরলে উঠানে পা রাখতেই নিজাম উদ্দিনের গর্জন শোনা যায়। রেজাকে নাম ধরে ডাকেন তিনি। রেজা দুরুদুরু বুক নিয়ে এগিয়ে যায়। সে জানে, মিথি তার নামে নালিশ করেছে। সে যে বিড়ি খায় সেটা তার বাবার কাছে বলে দিয়েছে। তাই বাবার সামনে দাঁড়াতে ভয় হয় তার। সে এক পা এগোয় তো দু'পা পেছনে সরে যায়।

 

নিজাম উদ্দিন লাঠি নিয়ে তেড়ে আসেন। রেজা দৌড় দিবে তখনই চিৎকার দিয়ে বলেন, "এই, দৌড়াবি না! একদম দৌড়াবি না কইলাম! খাড়ায়া থাক।"

 

রেজা দাঁড়িয়ে পড়ে। বাবা ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন, "তুই মিথিরে কী কইছোস?"

 

রেজা মাথা নত করে নেয় এবং ভাবতে থাকে সে মিথিকে কী এমন বলেছে যার জন্য বাবা তার উপর রেগে যেতে পারেন? কিন্তু কিছুই ভেবে পায় না। বাবা ফের চেঁচিয়ে বলেন, "কী কইছোস তুই মিথিরে?"

 

রেজা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

 

"তুই মিথিরে বিয়ার প্রস্তাব দিছোস কোন সাহসে?"

 

নিজাম উদ্দিন কথাটা বলতেই চট করে তাঁর মুখের দিকে তাকায় রেজা। বিস্ময়ে তার চোখ গোল। সে তো কখনো মিথিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি! তাহলে?

 

"আমি এমন কিছু কইনাই আব্বা।"

 

"কী! ভুল তো করছোস এহন আবার মিছা কথা কছ! তোরে আমি..." কয়েক ঘা পিঠে পড়ে রেজার। মার খেয়ে দৌড়ে ঘরে চলে যায় সে। রাতে তাকে আর ভাত দেওয়া হয় না। একরাত সে না খেয়ে থাকতে হবে। এটাই তার শাস্তি। কিন্তু মাঝরাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তখন রেজার ঘরে আসেন মিনু। তিনি রেজার মা। রেজা উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। তিনি আলতো করে রেজার মাথায় হাত রাখেন। একেবারে নিচু আওয়াজে ডাকেন,

 

"আব্বা! ও আব্বা! বাজান!" 

 

রেজার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে দেখে মা একপ্লেট ভাত নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে ছোটো মাছের তরকারি। পাতলা ডাল আর আলুভর্তা। তরকারি ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাতে কিছু আসে যায় না। পেটের খিদেয় কনুই ডুবিয়ে খায় রেজা। খাওয়া শেষ করে হাত চাটতে চাটতে সে বলে, "তুমি খাইছো?"

 

মিনু শুকনো হাসেন। একেবারে নিচু আওয়াজে বলেন, "সকালে খামুনে।"

 

"আর রাইতে?"

 

মুচকি হাসেন মিনু, "তুই খাইছোস তাতেই আমার খাওয়া হইছে।"

 

"আব্বায় তোমারেও খাওন দেয়নাই?"

 

"দিব না ক্যান? কিন্তু খাওন গলা দিয়া নামে না। তুই না খাইয়া পইড়া আছোস। আমি খাওন হজম করি ক্যাম্নে?"

 

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রেজা। সে সব চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। একটু থাকলে মা'কে খাওয়ানো যেত!

 

পরদিন বিকেলবেলা নাও নিয়ে বেরিয়েছিল রেজা। আষাঢ় মাস। পতিত জমিগুলো সব জলের নিচে। চারিদিকে পানি থৈ থৈ করছে। কেউ কেউ উড়ান জাল ফেলছে। কেউ আবার বঁড়শি পেতে বসে আছে। কেউ নাও নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিকেলে বেরিয়ে দুই ঘন্টার মধ্যে সত্তর টাকা রোজগার করে ফেলেছে রেজা। এখান থেকে ষাট টাকা সে বাবাকে দেবে। টাকা পেয়ে বাবার রাগ কমে যাবে তা সে জানে। বাকি দশ টাকা সে বিড়ির জন্য রেখে দেবে।

 

দেখে দেখে কয়েকটা শাপলা তুলেছিল রেজা। সেগুলো হাতে নিয়ে যখন ফিরছে তখন চারপাশের আলো একেবারে ফিকে হয়ে এসেছে। আলো আঁধারিতে কোথায় যেন ছুটে যাচ্ছিল মিথি। রেজা ছুটে গিয়ে খপ করে মিথির হাত ধরে ফেলে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন ধরে ফেলায় আতঙ্কে আঁতকে উঠে মিথি। "লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা..." বলতে বলতে সে রেজাকে দেখতে পায়। বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে নিতে নিজের বুকে থুতু ছিটিয়ে দেয়। সে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। একটুক্ষণের জন্য তার প্রাণপাখি উড়ে গিয়েছিল।

 

রেজা নিজেও হতবাক হয়ে গেছে। মিথি এতটা ভয় পাবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তাই থমথমে গলায় বলে, "ডরাইছোস? বেশি ডরাইছোস?"

 

"ভূতের মতো উইড়া আইসা হাত ধরছো আর এখন কও ডরাইছি কিনা?" রাগে গর্জন করে উঠে মিথি।

 

"ভুল হইছে। মাপ চাই।" বলে মাথা নিচু করে রেজা। সঙ্গে সঙ্গে আবার মিথির দিকে তাকায়। ঝাঁজালো কণ্ঠে বলে, "তোরে নাকি আমি বিয়ার প্রস্তাব দিছি?"

 

মিথি কোনোরকমে হাসি চেপে রাখে। জবাব দেয় না। রেজা ফের জিজ্ঞেস করে, "কথা ক! তোরে কোনদিন আমি বিয়ার প্রস্তাব দিলাম?"

 

"দেওনাই তো কী হইছে? দিবা তো? তাই অগ্রিম বিচার দিলাম।"

 

"দিমু মানে! তুই ক্যাম্নে জানলি তোরে আমি বিয়ার প্রস্তাব দিমু?"

 

"জানতে হইব ক্যান? এমনেই বোঝা যায়।"

 

"কস কী? ক্যাম্নে বুঝলি? কে কইছে তোরে এই কথা?"

 

"কওয়ন লাগব না। আমি জানি, তুমি আমারে ভালোবাসো।"

 

রেজা আতঙ্কিত গলায় বলে, "কেডায় কইছে তোরে?"

 

"কইব কেডায়? আমি বুঝতে পারছি। ভালো যদি না-ই বাসো তাইলে ওইদিন আমারে তাজমহল দিলা ক্যান?"

 

চিন্তায় পড়ে যায় রেজা। সত্যিই তো! তাজমহল তো লোকে ভালোবাসার মানুষকেই দেয়! তাহলে কি সে মিথিকে ভালোবাসে?

 

নগদ ষাট টাকা হাতে পেয়ে খুশি হয়ে যান বাবা। টাকাগুলো বারবার গুণতে গুণতে বলেন, "কই পাইছোস?"

 

"নাও বাইছি।"

 

"কয়দিনে?"

 

"একদিনে। দুই ঘন্টায়।"

 

বাবা টাকা গুণা থামিয়ে দেন। আশ্চর্য হয়ে তাকান রেজার দিকে। "দুই ঘন্টায় ষাইট টাকা?"

 

"হ। দুইজন যাত্রী আছিল। গঞ্জ থেইকা পাঁচ কাটুন মিষ্টি কিনতে গেছিল।"

 

"ওরা তোরে এত টাকা দিছে?"

 

"হ।"

 

"ওরা কই নামছে রে? মসজিদের সামনে?"

 

"হ। আপনে জানলেন ক্যাম্নে?"

 

"ওইগুলা মানুষ আছিল না রে বাজান!"

 

কথাটা শুনে বুক কেঁপে উঠে রেজার। সে কাঁপা গলায় বলে, "মানুষ আছিল না? তাইলে?"

 

"গঞ্জ থেইকা পাঁচ কাটুন মিষ্টি কিইনা মসজিদে যায়। এইগুলা তো জিনের কাম!"

 

সহসা বুকের ভেতর শীতল হয়ে যায় রেজার। সে ভয়ার্ত গলায় বলে, "জিন!"

 

রাতে রেজাকে নিজের ঘরে ডাকেন নিজাম উদ্দিন। তার হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিয়ে বলেন, "টাকাটা কাইল সকালে তোর আকমল চাচারে দিয়া আইবি। তিনমাস আগে একশো টাকা ধার করছিলাম। পঞ্চাশ টাকা দিছি। পঞ্চাশ বাকি আছে। এইটা কাইল সকালেই তুই তাঁর কাছে পৌঁছায়া দিবি।"

 

আকমল চাচার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় রেজার। কারণ আকমল চাচা মিথির বাবা। সে আজ সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত সে বুঝে উঠতে পারছে না যে, সে মিথিকে ভালোবাসে কি না ততক্ষণ পর্যন্ত মিথির সামনে যাবে না। কিন্তু বাবার আদেশে কাল সকালেই মিথিদের বাসায় যেতে হবে!

 

ভোরবেলা বুক পকেটে পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে মিথিদের বাড়িতে উপস্থিত হয় রেজা। উঠান পেরিয়ে ঘরের দরজায় টোকা দিবে তার আগেই দু'টো হাত তার মুখ চেপে ধরে। টেনে নিয়ে যায় দরজা থেকে অনেক দূরে। রেজা আবিষ্কার করে, তার মুখ চেপে ধরে আছে স্বয়ং মিথি! সে চাপা গর্জন করে বলে, "ভালোবাসো বইলা ভোরবেলা দেখা করতে চইলা আইলা? যদি আব্বায় দেইখা ফালায়? ধরা খাইলে কী হইব জানো?"

 

রেজা কোনোমতে নিজের মুখ ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, "তোর লাইগা আসিনাই। তুই কি হুরপরী? যে তোর লাইগা ছুইটা আসতে হইব?"

 

মুখ ভার করে ফেলে মিথি। ঠোঁট উলটে বলে, "তাইলে কি দাদির লাইগা আইছো? বিয়া করবা তাঁরে?"

 

"হ, করুম। আইজকাই তোর দাদিরে বিয়ার প্রস্তাব দিমু।"

 

"ইশ! বুড়ির গলা টিপ্পা মাইরা ফালামু না?"

 

"ক্যান মারবি?"

 

"এমনেই। তুমি ক্যান আইছো?"

 

"তোর আব্বারে টাকা দিতে আইছি।" বলে পঞ্চাশ টাকা বের করে দেয় রেজা। মিথি পঞ্চাশ টাকার নোটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে, "সত্যিই আব্বার লাইগা আইছো? আমার লাইগা না?"

 

তাকে হতাশ হতে দেখেও গা করে না রেজা। বলে, "তোর লাইগা ক্যান আইমু? তুই হুরপরী?"

 

মুখ বেজার করে ঘরে চলে যায় মিথি।

 

সেদিন সকাল থেকেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মাঠের পানি। বাড়ির উঠানে জল এসেছে বেলা বারোটায়। তিনটার দিকে উঠানে হাঁটুজল। ঘরের ভেতরেও ঢুকে গেছে। বিকেল হতে হতে ডুবে গেছে সব। সবাই উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছিল। মিথিদের বাড়ি অনেক উঁচু জমিতে। বাড়িটাও বিশাল। মিথিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন জমিদার। তাদের বাড়িটাই তার প্রমাণ।

 

সন্ধ্যায় নৌকায় করে অনেকে আশ্রয় নিতে এসেছে মিথিদের বাড়িতে। রেজারাও এসেছে। আলগা ঘরে মাটিতে চাটি বিছিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে সবাই। সকলের সাথে পোঁটলা, শুকনো খাবার আর বালিশ। কেউ কেউ বদনাটাও সঙ্গে এনেছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। কেউ শুয়ে ঘুমাচ্ছে তো কেউ বসে। রেজা বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়িতে আগুন দিয়েছে। এখন সে নিশ্চিন্তে ধোঁয়া টানতে পারবে। কেউ তাকে দেখবে না। কিন্তু আসল সত্যিটা হলো এই যে, কেউ একজন তাকে জানালা দিয়ে দেখছিল। সেই মানুষটা মিথি।

 

সে রেজাকে বাইরে দেখে নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। দ্রুত পা ফেলে উঠান পেরিয়ে এগিয়ে আসে রেজার সামনে। রেজা থতমত খেয়ে যায়। চাপা স্বরে বলে, "তুই! ঘুমাসনাই এখনও?"

 

মিথি জবাব না দিয়ে বলে, "একটা অনুরোধ রাখবা?"

 

"কী অনুরোধ?"

 

"আমারে নিয়া একটু ঘুরতে যাইবা এখন? না কইরো না কিন্তু!"

 

"এখন! এত রাইতে!" আঁতকে উঠে রেজা। "কেউ যদি দেইখা ফালায়?"

 

"কেউ দেখব না। চলো যাই।"

 

"কিন্তু!"

 

"কোনো কিন্তু না। আমার অনেক দিনের শখ এমন মাইঝরাইতে নাও নিয়া ঘুরুম।"

 

রেজার মন কিছুতেই সায় দেয় না। তবুও মিথির কথায় রাজি হয়ে যায় সে। গভীর রাতে নাও নিয়ে ভেসে বেড়ায় দু'জন। বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। আকাশে অসংখ্য তারা ভেসে উঠেছে। পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে মিথি। আনমনে বলে উঠে, "আমার বহুত দিনের শখ এমন কইরা তারা দেখুম!"

 

রেজা কথা বলে না। শুধু আপনমনে বইঠা বায়। মিথি হঠাৎ বলে উঠে, "বইঠা আমারে দেও তো। আমি একটু চেষ্টা কইরা দেখি।"

 

"তুই নাও বাইতে পারোস?"

 

"কোনোদিন বাইনাই। চেষ্টা করলে পারুম।"

 

"তাইলে পারবি না। নাও উল্টায়া ফেলবি।"

 

"কিন্তু আমার যে ইচ্ছা!"

 

"বইঠা বাওয়ার ইচ্ছা?"

 

"হ।"

 

"তাইলে আয়, আমি শিখায়া দেই।"

 

সত্যি সত্যি রেজার কাছে এসে বসে মিথি। রেজা মিথির হাত ধরে বইঠা বায়। মিথি আহ্লাদী চোখে রেজার মুখের দিকে তাকায় একবার। ফের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মিথি ফিসফিসিয়ে বলে, "আমার আরো একটা ইচ্ছা।"

 

"কী ইচ্ছা?"

 

"আমার ইচ্ছা, তুমি আমারে কোলে নাও।"

 

থমকে যায় রেজা। উল্টো দিকে নাও ঘুরিয়ে নেয়। মিথি আশ্চর্য হয়ে বলে, "কী করতাছো?"

 

"ফিরা যামু।"

 

"কিন্তু আমার ইচ্ছা এখনও শেষ হয়নাই।"

 

"তোর সব ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারুম না।"

 

"ক্যান পারবা না?"

 

এরপর আর কোনো জবাব দেয় না রেজা। নৌকা তীরে ভিড়লে দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে চলে যায় মিথি। যাবার আগে একবার ফিরেও তাকায় না।

 

সেদিন ঘাটে বরযাত্রী দেখে মন খুশিতে নেচে উঠে রেজার। আজ ভালো টাকা রোজগার হবে! 

তিনবারে প্রায় বিশজন মানুষকে পার করে দেয় সে। পঞ্চাশ টাকা করে দেড়শো টাকা পেয়ে খুশি আর ধরে না তার। এখান থেকে একশো টাকা সে বাবাকে দিবে। চল্লিশ টাকা দিবে মায়ের হাতে। আর দশ টাকা সে নিজের কাছে রাখবে।

 

সারাটা দিন সে নৌকা নিয়ে পাড়ে বসে থাকে। কারণ সে জানে, বরযাত্রী যখন গ্রামে এসেছে তখন তারা আবার ফিরেও যাবে। সে চায় যাবার পথে তারা যেন তার নৌকা করেই যায়। এতে সে আরো কিছু টাকা কামিয়ে নিতে পারবে।

 

বিকেলবেলা, আসরের আগেআগে দেখা গেল মানুষগুলো ফিরে আসছে। এদিকেই আসছে। চট করে উঠে দাঁড়ায় রেজা। বইঠা হাতে তুলে নেয় দ্রুত। সবার আগে বর-কনেকে পার করে দিতে হবে। বর আগে আগে নৌকায় উঠে পড়েছে। কনে উঠতে যাবে তখনই এক ভদ্রলোক ছুটে এসে কনেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই ভদ্রলোক আর কেউ নয়, স্বয়ং আকমল চাচা! মিথির বাবা!

 

সহসা বুকের ভেতরটা ছাত করে উঠে। রেজা টের পায়, তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। হঠাৎ একটা তীব্র হাহাকারে ছেয়ে গেছে তার চারপাশ। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে সে ওদের দিকে তাকায়। কনেটা মিথি নয় তো!

 

মিথি বসে আছে তার নতুন বরের সাথে। বরটা মিথির হাত ধরে আছে। রেজা আস্তে আস্তে বইঠা বাইছে। আজ কেন জানি তার চোখের বাঁধ ভেঙে গেছে। শত চেষ্টা করলেও সে চোখের জল আটকে রাখতে পারছে না। বুকের ভেতরে দলা পাকিয়ে উঠছে কান্নার ঢেউ। বিষাক্ত ঝড় উঠেছে মনের গহীনে।

 

তারা যখন একে অন্যের হাত ধরে চলে যাচ্ছিল, তখন অসহায়ের মতো তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখছিল রেজা। যাবার সময় বর তাকে বিশ টাকা বকশিশ দিয়ে গেছে। এতে কি তার খুশি হওয়ার কথা?

 

দুই বছর পর।

এবারের বর্ষায় পানি হয়েছে খুব। বৃষ্টিও বেশি। তিনদিন ধরে দিনরাত মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। থামবার নাম নেই। আকাশটা থেমে থেমে গর্জন করে উঠছে। এমন দিনে কেউ ঘর থেকে বেরোয় না। বাইরে থেকে কেউ এদিকে আসেও না। তবুও ঘাটে নাও ভিড়িয়ে আনমনে বসে ছিল রেজা। বৃষ্টির জলে কাকভেজা হয়ে আছে সে। এতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। এখন তার বয়স হয়েছে উনিশ। গত বছর আশ্বিন মাসে তার বাবা মারা গেছেন। এবার বৈশাখ মাসের শেষের দিকে মা-ও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। রেজা এখন একা। ভীষণ একা। এখন কেউ তাকে শাসনও করে না আদরও করে না। এই যে ঘন্টার পর ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজছে, কেউ তাকে খুঁজতে বেরোবে না। কেউ এসে তাকে ধমক দিবে না। এমনকি আজ রাতে ঘরে না ফিরলেও কেউ সেটা নিয়ে ভাববে না।

 

একহাতে ছাতা সামলে অন্য হাতে একটা বাচ্চাশিশু কোলে নিয়ে এবড়োখেবড়ো পা ফেলে এগিয়ে আসছে একটি মেয়ে। রেজা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পানিতে নেমে যায়। কাঠ বিছিয়ে দেয়, যাতে মেয়েটা সহজে নৌকায় উঠে বসতে পারে।

 

নৌকার এক মাথায় ছাতা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মেয়েটা। এখনও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ভিজতে ভিজতে ধীরে ধীরে বইটা চালায় রেজা। হঠাৎ না চাইতেও মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে যায় তার। তখনই থেমে যায় তার হাত, থেমে যায় হৃৎপিণ্ড। মেয়েটাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন!

 

কত পরিবর্তন হয়েছে মিথির! আগে নাদুসনুদুস ছিল। এখন শুকিয়ে গেছে একদম। গায়ের রং ময়লা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো হয়ে আছে। মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। অজান্তেই রেজা বলে উঠে, "মিথি তুই!"

 

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার বিবর্ণ চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। শুকনো হেসে সে বলে, "চিনতে পারছো?"

 

"তোরে চিনুম না!"

 

মিথি মাথা নত করে। কথার ফাঁকে জানতে পারে মিথির বর আরেকটা বিয়ে করেছে। মিথিকে বিয়ে করার আগে লোকটা আরো একটা বিয়ে করেছিল। মিথি তার দ্বিতীয় বউ। কথাগুলো বলতে বলতে চোখদু'টো টলোমলো করতে থাকে মিথির। রেজা ব্যথিত গলায় বলে, "তাই রাগ কইরা চইলা আইছোস?"

 

মিথি ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, "তালাক দিয়া দিছে।"

 

বিমর্ষ হয়ে পড়ে রেজা। এরপর আর কোনো কথা হয় না।

 

দু'মাস পর একদিন মিথির বাবার কাছে যায় রেজা। কথা না ঘুরিয়ে সোজা বলে দেয়, "চাচা, আপনের মাইয়ারে আমার লগে বিয়া দিবেন?"

 

আকমল চাচা হতবাক হয়ে যান। হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, "আমার কোন মাইয়ার কথা কইতাছো বাবা?"

 

"আপনের মাইয়া তো একটাই। মিথির কথা কইতাছি।"

 

"কিন্তু হের তো..."

 

"আমি সব জানি। আমার কোনো আপত্তি নাই। মিথির একটা মাইয়া আছে তাও জানি। মাইয়াডারে আমরা দুইজনে পালমু। হেয় কোনোদিন জানতেও পারব না যে, আমি তার আসল বাপ না।"

 

আকমল চাচা কথা খুঁজে পান না। আচমকা চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার। এই জল দুঃখের না কি আনন্দের তা ভেবে পান না তিনি।

 

স্বল্প আয়োজনে বিয়েটা হয়ে গেল। রাত এগারোটা। আস্তে করে মিথির কাছে বসে রেজা। ভেজা গলায় বলে, "এইবার কও, কী কী ইচ্ছা আছে তোমার?"

 

মিথি ফিসফিস করে বলে, "আমার ইচ্ছা, আপনে আমারে কোলে নেন।"

 

সঙ্গে সঙ্গে দু'হাত বাড়িয়ে মিথিকে কোলে তুলে নেয় রেজা। ফের জিজ্ঞেস করে, "আর কী ইচ্ছা?"

 

মিথি ক্ষীণ আওয়াজে বলে, "আমারে একবার বউ বইলা ডাকেন।" 


Tanvir Arafat

93 ब्लॉग पदों

टिप्पणियाँ