অকৃত্রিম ভালবাসা

মানুষ মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা বলে।

 

 

-"বাজান!!!! আমাগো গরুডারে নাকি শহরে নিয়া যাইবা?"

 

-"(অবাক হয়ে) তোরে কেডা কইল মা?"

 

-"তুমি যহন মায়রে কইতাছিলা, তহন আমি হুনছি। কেন নিয়া যাইবা বাজান?"

 

-"(ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) মা রে!!! আমাগো সংসার চলেনা। চাইল, ডাইল কিনার টেহা নাই। সামনে কুরবানীর ঈদ। তাই এই গরুডারে শহরে নিয়া বেইচা কিছু টেহা আনবার পারুম।"

 

-"(অবাক হয়ে) তুমি আমাগো গরুডারে বেইচা দিবা?"

 

-"হ রে মা।"

 

-"(চিৎকার করে) আমার গরুডারে আমি কুথাও নিয়া যাইতে দিমুনা।"

 

এই কথা বলে ছোট মিনা তার প্রিয় গরুটির কাছে গিয়ে আদর করতে থাকে আর কাঁদতে থাকে।

 

-"দিলা তো মাইয়াডারে কান্দাইয়া। কি দরকার আছিল হাচা কথা কওনের?"

 

-"কিছু করার আছিল নারে মিনার মা। একদিন না একদিন তো হাচা কথা ও হুনতই। জানতই।"

 

-"অহন গরুডারে কেমনে নিবা? মিনারে দ্যাহো। গরুডারে ধইরা কেমনে কান্তাছে।"

 

-"আমি ওরে বুঝাইতাছি।"

 

এই কথা বলে জামাল মিয়া তার ৮ বছরের একমাত্র সন্তান মিনার কাছে গেল।

 

-"মিনা!!!! মা আমার একডা কথা হুন।"

 

-"(কাঁদতে কাঁদতে) না। আমি তোমাগো কারোর কোনো কথাই হুনুম না।"

 

-"একডু হুন না মা আমার।"

 

-"(চিৎকার করে) না না না।"

 

-"(হতাশ হয়ে) আইচ্ছা ঠিক আছে মা। আমি তোর গরুরে শহরে নিমুনা। অহন খুশি তো?"

 

-"(খুশিতে চোখের পানি মুছতে মুছতে) হাচা কইতাছ বাজান?"

 

-"হ রে মা। হাচাই কইতাছি।"

 

রাতে যখন মিনা ঘুমিয়ে পড়ল, তখন জামাল মিয়া আর তার স্ত্রী কুলসুম বানু কথা বলছে।

 

-"তুমি যে কইলা গরু শহরে নিবা না। গরু না বেঁচলে আমরা খামু কি?"

 

-"কাল ভোরেই নিয়া যামু। মিনা ঘুম থেইকা উঠার আগেই।"

 

-"(অবাক হয়ে) তাইলে যে মিনা রে কইলা?"

 

-"(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) আমিও তো চাইনাই গরুডারে বেইচা দেই। আমারও কি কম কষ্ট হইতাছে কও? অহন উপায় না পাইয়া গরুডারে শহরে নিয়া যামু। ভাল্লাগতাছেনা মিনার মা। ঘুমাও। ভোরে ডাক দিয়া দিও আমারে।"

 

জামাল মিয়া, তার স্ত্রী আর একমাত্র সন্তান মিনাকে নিয়ে বেশ সুখের সংসার ছিল তাদের। অভাব-অনটন তেমন ছিলনা বললেই চলে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নদীর ভাঙ্গনে তাদের বাড়িঘর সব ভেসে যায়। তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অন্যত্র চলে যায় তারা।

 

তাদের এখন এমন অবস্থা যে চাল কেনার সামর্থ্যটুকুও নেই। তাই জামাল মিয়া আর কোনো উপায় না পেয়ে তার প্রিয় গরুটিকে শহরে নিয়ে কোরবানীর হাটে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

 

পরদিন সকালে.......

 

-"মিনা কই?"

 

-"ঘুমাইতাছে।"

 

-"তাইলে আমি বাইর হই।"

 

-"কবে আসবা?"

 

-"(ভাঙ্গা স্বরে) ওরে বিদায় দিয়া তারপর আসুম। মিনা রে দেইখা রাইখ। ওরে বুঝাইও। সাবধানে থাইক তোমরা। আহি। আল্লাহ হাফিজ।"

 

-"বাবা কই যাও?"

 

মিনার কথা শুনে জামাল মিয়া আর তার স্ত্রী দুজনই অবাক হয়ে গেল।

 

-"এইতো মা। একডু বাইরে যামু।"

 

-"(অবাকচোখে তাকিয়ে) তাইলে হাতে পুঁটলি কেন?"

 

-"তোর বাজান কামে যাইব। আইয়া পরব। তুই অহন ঘুমা।"

 

-"আমি জানি বাজান আমাগো গরুডারে নিয়া যাইব। আমি নিয়া যাইতে দিমুনা।"

 

এই কথা বলে মিনা যখনই গরুটির কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, ঠিক তখনই তার মা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

 

জামাল মিয়াও অনেক কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার প্রিয় গরুটিকে নিয়ে যাচ্ছে শহরের উদ্দেশ্যে।

 

আর এইদিকে মিনা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল। মিনার মাও অনেক কাঁদছে আর মিনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

 

জামাল মিয়া তার গরুটিকে অন্য গরুগুলোর সাথে ট্রাকে দিয়ে সে বাসে গেল। তার মন বারবার অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। গরুটিকে পানি, খড় বা ঘাস খেতে দিল কিনা। রোদ, বৃষ্টিতে যে কিভাবে এতদূর কষ্ট করে যাচ্ছে তা ভেবেই জামাল মিয়ার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

 

গন্তব্যস্থানে পৌছামাত্রই জামাল মিয়া তাড়াতাড়ি করে তার প্রাণপ্রিয় গরুটিকে বেশি করে পানি আর ঘাস জোগাড় করে খাওয়াল। গোসল করানোর ব্যবস্থা করল। রাতে মশা যাতে না কামড়ায় তাই সারারাত জেগে পাহারা দিল আর মশা তাড়িয়ে দিল।

 

-"গরুডারে এত যইত্ন করতাছ মিয়া, যহন কিনা নিয়া যাইয়া দুইদিন পর কুরবানী দিব, তহন কি করবা?"

 

এই কথা শুনে জামাল মিয়া আর কান্না থামিয়ে রাখতে পারলনা। তার প্রিয় গরুটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তার এই ভালবাসার কান্না দেখে আশেপাশের সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

 

সেদিন বিকেল বেলায়.........

 

-"এই গরুটার দাম কত?"

 

জামাল নিশ্চুপ হয়ে রইল।

 

গরু ক্রেতা কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল।

 

-"ভাই, এই গরুটার দাম কত?"

 

-"ষাইট হাজার টেহা।"

 

-"ওহ্। পঞ্চাশ হাজার হলে দিবেন?"

 

-"(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) লইয়া যান।"

 

তার এরকম অদ্ভুত উত্তর শুনে গরু ক্রেতা অবাক হয়ে গেল। জামাল মিয়ার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে গরু নিয়ে যেতে লাগল।

 

কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল যে, গরুটি জামাল মিয়াকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাইছেনা। জামাল মিয়ার দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। গরুটিকে যারা নিতে চাইছে তাদেরকে গুঁতো দিয়ে জামাল মিয়ার কাছে ফিরে যেতে চাইছে। জামাল মিয়া খেয়াল করল তার প্রিয় গরুটির চোখ দিয়ে পানি ঝরছে আর জামাল মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

 

জামাল মিয়া এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে চলে যায়। বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসে উঠে। আর মুখে গামছা চাপা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে

 

 

অনেকদিন পর কলেজ ছুটি পেয়েছি। আজ সাত মাসের বেশি গ্রামের মাটিতে পা রাখিনি । কি করবো কলেজের পড়া, টিউশনি বন্ধুবান্ধব এগুলো রেখে বাড়িতে যেতে সময় পাইনা। তাই এবারের সুযোগটা হাত ছাড়া করা বোকামি হবে। সকাল সকাল ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে নিয়ে সোজা বাস-স্টান্ডে পৌঁছাতেই শুরু হলো বৃষ্টি। ঢাকা শহরের এই গরমের মধ্যে একটু বৃষ্টি যথেষ্ট খুশির খবর। কিন্তু আবার বেশি বৃষ্টি হলেও সমস্যা। পানির কারনে আবার চলাফেরা যাবেনা।

কিছুক্ষন পরই বাস চলে আসলো তবে, বৃষ্টি এখনো থামেনি। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। দৌড়ে বাসে উঠে পড়লাম। তবে সিটটা পরলো একদম পিছনের দিকে। পাশের সিটে একটা সুন্দরী বসেছে। বেশি তাড়াহুড়ো না করে ধিরে ধিরে ব্যাগটা রেখে নিজেও বসে পড়লাম। মেয়েটার বয়স বেশি হলেও তেইশ বছর হবে হইতো। চুলগুলো একটু বেশিই বড় লাগছে, দাঁড়ালে হইতো কোমর ছাড়িয়ে যাবে। চোখ দুটো একদম টানাটানা আর, আর কি বলবো? অতকিছু জেনে লাভ নেই। শুধু এটা যেনে রাখুন যে কোনো পরীও হইতো হার মানবে তার সৌন্দর্যে!

নিজেকে স্বাভাবিক রেখে খুব সাধারণ ভাবে বললাম -আপনি অনেক সুন্দর!

আমার কথায় মেয়েটি বিচলিত হলো না। শুধু আমার দিকে একবার তাকিয়ে নরম সুরে বলল -অনেকেই বলে, হয়তো আমি সত্যিই সুন্দরী! বলেই মেয়েটি আবার বাইরে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এর অর্থ সে কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নয় ।

কিন্তু সেটা কি করে হয়? এতো দুরের পথ এভাবে চুপচাপ করে থাকলে বিরক্তি লাগবে। ফোনেও চার্জ বেশি নেই। কোনো উপায় না পেয়ে ব্যাগটা খুজে দেখলাম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যাইয়ের চাঁদের পাহাড় বইটা ছাড়া আর কিছু খুজে পেলাম না। বইটা কয়েকবার শেষ করেছি, কিন্তু

 তারপরও পড়তে কোন বিরক্তি লাগে না। বইটা যে দিয়েছিলো সে কোথায় আছে জানিনা। তবে তার দেওয়া এই শেষ উপহারটা কখনো হাত ছাড়া করিনা। এর কারন শুধু বইয়ের গল্প নয় বইটি যে দিয়েছিলো সেও একটি কারন। বইটি যতবার দেখি ততবার তার কথা মনে পড়ে।

বইটা পড়তে শুরু করতে যাচ্ছিলাম তখনি মেয়েটা আবার আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে -অনেক তেষ্টা পেয়েছে, আপনার কাছে কী পানি হবে?

আমার ব্যাগে সব-সময় পানি থাকে। ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করে মেয়েটার হাতে দিলাম ।

ঢকঢক করে কিছুটা পানি খেয়ে, বোতলটা আবার আমার হাতে দিয়ে বলল -আমি রিমি, জাপানের নিরিমা শহর থেকে।

মেয়েটার কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। কারন তাকে দেখে কোনভাবে জাপানের মনে হয়না। তার উপর শুদ্ধ ভাষায় বাংলা বলছে!

একটু হেসে বললাম -মজা করছেন?

রিমির মুখে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। তবে কি সত্যি বলছে?

মুখে কিছু না বললেও হাত দিয়ে ইশারা করলাম, কিভাবে?

-আমার জন্ম বাংলাদেশেই, আর আমার বাবা-মায়েরও। তবে কাজের কারনে অনেক আগেই আমরা জাপানে চলে যাই। বাবা মা ঘরে শুধু বাংলাতেই কথা বলেন। এজন্য আমিও বাংলা শিখে যায়। আর বাইরের বন্ধুদের থেকে জাপানিজটাও শিখে নিই।

-আচ্ছা আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায় জানতে পারি?

আমার কথা শুনে মনে হলো রিমির মন খারাপ হয়ে গেলো। আমি আবারও বললাম,-সরি, যদি বলতে না চান তবে জোর করবো না। এটা আপনার নিজস্ব ব্যাপার।

রিমি আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, -এমন কোনো ব্যাপার না আসলে আমি নিজেই জানিনা। যখন আমি জাপানে যাই, তার কিছুদিন পর আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়। এতে আমার ব্রেইন ড্যামেজ হয়। যার কারনে আমার ছোট বেলা মানে বাংলাদেশের সকল সৃতি হারিয়ে ফেলি।

কথাগুলো বলে রিমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকে। জানিনা আমার দিকে ওর মনোযোগ আছে কিনা। তারপরও জিজ্ঞেস করলাম,

-আচ্ছা, তাহলে তো এখানে আসার বড় কোনো কারন হবে?

আমার কথার জবাব অনেকক্ষণ পর দিল, -আমি এখানে মানে বাংলাদেশে গত দুই মাস ধরে আছি। বাবা-মা দুজনেই দুইমাস আগে মারা গেছে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে।

এবার বুঝতে পারলাম রিমির এমন উদাস থাকার কারনটা। তেমন কিছু আর বললাম না। হয়তো এমন বোরিংভাবেই যেতে হবে। তবে কিছু করার নেই, মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো নয়। তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

বইটার দিকে মনোযোগ দিলাম, কিন্তু রিমি নিজেই আবার জিজ্ঞেস করলো, -আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

-ঠাকুরগাঁও, আমার নিজের বাড়ি।

-ওহ! কত আজব ব্যাপার তাইনা? আমিও ওখানেই যাচ্ছি!

-কিন্তু এতো জায়গা থাকতে ওখানেই কেন?

আমার কথা শুনে রিমি বললো, "আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। বাবা মা মারা যাওয়ার পর ঘরে থাকা কিছু পুরনো কাগজপত্র দেখি। সেখানে এই জায়গাটার কথা উল্লেখ ছিলো। তাই শুধু দেখতে যাচ্ছি এর বেশি কিছুই না। জানিনা কোথায় থাকবো, জানিনা কে আমার আপনজন। আদতে আপনজন কেউ আছে কিনা সেটাও জানিনা। কত আজব তাই না?"

-সেটা তো ঠিকই, তবে ভয়ের কোনো কারন নেই আপনি যেখানে যাচ্ছেন। সেখানকার মানুষজন অনেক ভালো মনের। আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।

-জেনে খুশি হলাম, আচ্ছা আপনার হাতে থাকা এটা কীসের বই?

-বইটার নাম চাঁদের পাহাড়। অনেক সুন্দর একটা বই, আমার একজন প্রিয় মানুষ দিয়েছিল।

-যদি আমিও বাংলা পড়তে পারতাম তাহলে একটু পড়ে দেখতাম।

-বলেন কি! আপনি বাংলা পড়তে পারেন না?

-না বললাম যে, আমি এতোদিন জাপানে ছিলাম।

-তাও তো ঠিক, কোন ব্যাপার না আস্তে ধীরে শিখে নিবেন।

আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে রিমি আবারও বললো, -জানেন আমি এখানে আসার পর, এমন খোলামেলা কারো সাথে কথা বলতে পারি নি।

-কারনটা জানতে পারি?

-অনুমান করার চেষ্টা করুন তো!

এতক্ষণ পরে রিমির মুখে এক টুকরো হাঁসি দেখা দিলো। আমার বিষয়টা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো। আমি বললাম, -ওরা নিশ্চয়ই আপনার সুন্দর চেহারার থেকে চোখ সরাতে পারে না?

-একদম ঠিক বলেছেন। এমন মনে হয় যেন ওরা আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে। বেশ অদ্ভুত লাগে ব্যপারটা আমার কাছে।

যখন ঠাকুরগাঁওতে পৌছলাম, ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতে শুরু করেছে। দুজনে একটা ছোটখাটো একটা খাবারের হোটেল থেকে কিছুটা খাবার খেয়ে নিলাম।

আপনি থেকে তুমি বলতে শুরু করেছে। কেনো জানি মেয়েটা আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। জানি না কি সেই অদ্ভুত কারন। জানার চেষ্টাও করবো না, তবে এখন অনেক চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা এখন থাকবে কোথায়? বাড়িতেও নিতে পারবো না, লোকজন কিছু একটা বলে ফেলতে পারে।

খাবার খেয়ে যখন ওয়ালেট বের করে টাকা দিতে যাবো, রিমি বাধা দিলো আর নিজেই বিলটা দিয়ে দিলো। হোটেল থেকে বের হওয়ার পর রিমি বললো, -মেয়েটা কে?

-কোন মেয়েটার কথা বলছো?

-তোমার ওয়ালেটে বন্দী মেয়েটা।

-এটা সে, যে আমাকে বইটা দিয়েছিলো।

-এতো ভাগ্যবতী মেয়ে কে, দেখার ইচ্ছা করছে।

-সেটা সম্ভব নয়, কারন এই ভাগ্যবতী কোথায় সেটা আমি জানিনা।

-হতে পারে সে আপনার খুব কাছেই আছে!

-আজ পনেরো বছরের বেশি হয়ে গেছে তাকে দেখিনি।

হাটতে হাটতে অনেকটা ফাঁকা জায়গাতে চলে এসেছি। হটাৎ রিমি দাঁড়িয়ে পড়লো আর বললো, -সে যদি ফিরে আসে তাহলে কি করবে?

-সামনে আসলেই ধরে মুখে একটা চড় বসিয়ে দেবো।

আমার কথার কোন প্রতিক্রিয়া না করে ওর কাঁধের ব্যাগটা খুলতে খুলতে বললো, -কাগজগুলো সাথে আমি আরো একটা জিনিস পেয়েছিলাম।

বলেই একটা সাদাকালো ছবি বের করে আমার হাতে দেয়। যেটা ছিলো আমার ওয়ালেটে থাকা ছবির কপি। আমি কি করবো কি বলবো কিছু বুঝতে পারছি না। রিমি আমার আরেকটু কাছে এসে বললো, এটা আমার ছবি। আর আমার মনে হয় তোমার চড় দেওয়ার সময় এসে গেছে।

নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। এতোদিন যার জন্যে অপেক্ষা করেছি। অবশেষে সে আমার সামনে। রিমি বললো, -আমার মনে নেই অতিতে কি হয়েছিলো। তবে আমার মনে হয় তুমি আমার অপেক্ষাতেই ছিলে।

বলেই রিমি আমাকে জড়িয়ে ধরে। কাধে পানির উপস্থিতি বুঝতে পারছি। রিমিও কি কাঁদছে? হ্যাঁ, সেটাই হবে হয়তো! 

 

 

রাস্তার পাশে চুড়ি কিনছিলাম। নানান রংয়ের চুড়ি দেখে ভাবছি, আজ কোনটা দিবো বউকে। দোকানের সব রংয়ের চুড়ি কিনে দিয়েছি আগে। একটু মাথায় হাত দিয়ে ভাবছি কোনটা কিনবো! তখনই একজনের ডাক পড়লো পিছনে। 

 

"এই যে রানা সাহেব না?"

 

ভাল করে তাকিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করলাম। মেয়েটা আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। আমার বুকের ভিতর থরথর করে কেঁপে উঠলো। 

আর্তির সাথে এত বছর পর দেখা হবে ভাবতে পারছি না। মাঝে অনেক সময় অপেক্ষা কেটে গিয়েছে। 

 

--আমি আর্তি চিনতে পারলে? 

--ঠিক চেনা নয়।

--আমি আর্তি, একসাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম অনার্সে। ভুলে গেলে? এইতো ৮-৯ বছরের আগের কথা। 

--হুম, মনে পড়ছে। তো কোটিপতি স্বামী, জীবন, সংসার কেমন আছে সব কিছু?

 

আর্তির মুখটা কালো হয়ে গেলো। মাথাটা নিচু করে বলে, 

--ভালো। এখানে কি করছেন? 

--চুড়ি নিচ্ছি বউয়ের জন্য। আলমারি ভর্তি স্বর্ণ আছে। তারপর প্রতি সপ্তাহে কাচের চুড়ি নিয়ে যাই। শুক্রবার সকালেই উঠে বউয়ের হাতে সে গুলো। ঘুরতে বের হই। সারাদিন সময় দেওয়া হয় বউকে। এটায় সে অনেক খুশী হয়। 

 

--ভালোই। কি করেন এখন?

 

--এইতো বিসিএস দিলাম। তারপর পাশ করে যোগ দিলাম শিক্ষাদানে। ভালোই আয় হয়। কলেজ পড়ানো, তারপর কোচিং সেন্টার। আপনার কী অবস্থা? 

 

--এইতো স্বামী বড় ব্যবসায়িক। সব সময়ই ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকে। আমি চলি আমার মতো।  

--সেই দিন ঠিকই বলেছিলেন। আপনার থেকে ভালো কাউকে পাবো। পেয়েছিও, ছেড়া শার্টেও আমার হাত ছাড়েনি।

 

কথা বলার মাঝেই চুড়ি কিনে নিলাম। ইফতির লাল চুড়ি খুব পছন্দ। তাই লাল নিলাম। আগেও লাল কিনে দিয়েছি। ড্রেসিং টেবিলের আর কোন জায়গায় নেই নতুন কিছু রাখার। সব ভর্তি কাচের চুড়ি, যেন একটা দোকান! 

 

আর্তি বলে, 

--তাহলে জীবন'টা গুছিয়ে নিয়েছেন। সন্তান হয়নি? 

--একটা মেয়ে আছে, এক বছরের। আপনার? 

--না, ডাক্তার বলছে কোনদিনও মা হতে পারবো না। তাইতো স্বামী দ্বিতীয় বিয়েও করছে। আমাকেও নিয়ে আছে, ভালোবাসে আমাকে।

 

আমি আর্তির থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছি। রাস্তার পাশ ধরে চলছি। চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। সন্ধ্যা নেমে আসছে, তাই সবার ছুটে চলা নিজ গৃহে। 

আর্তি মিথ্যা বললো যে, স্বামী ভালবাসে। তাঁর ডান গালের নিচে হাতের ছাপ দেখলাম, কেউ জোরে চড় মারছে। বুঝাই যাচ্ছে, স্বামী ছাড়া আর কে মারবে। টাকা পয়সা ঠিকই আছে, তাঁর ভালবাসা নাই। চোখে মুখে উদাসীনতা। 

 

এইতো ৮-৯ বছর আগে, তখন অনার্স ৪র্থ বর্ষের শেষ দিকে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরই আর্তিকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলি। কখনো প্রকাশ করিনি। ৪র্থ বর্ষে, একদিন ক্যাম্পাসে আর্তি বসে বসে অন্য ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আমি এগিয়ে যেতে, আর্তি বললো, --কিছু বলবে? 

--আপনাকে কিছু বলতে চাই। 

--বলেন? 

--আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই, মনে মনে ভালোবাসছি।  

 

এই কথা শুনে খিলখিল করে হাসলো আর্তি। তাঁর সাথে থাকা দুজন বান্ধবীও। 

আর্তি বলে, "মনে হয় একই শার্ট, প্যান্ট পরে প্রতিদিন আসা। দেখে মনে হয়ে কোন বস্তির থেকে উঠে আসা। আর ভালোবাসবে! আমার ভালোবাসার মানুষ স্বামী হবে সমাজের নামি-দামি কেউ"

 

আবার হাসতে শুরু করলো। এই কথা গুলো, আমার বুকে আঘাত করে তখন। কান্না চোখে সেই অপমান সহ্য করে, মেসে ফিরে আসলাম। বাসায় এসে অনেক কান্না করি। গ্রামে বাবা তখন কৃষি কাজ করতো। কোন রকম আমি টিউশনি করে নিজেই, নিজের খরচ জোগাড় করে পড়াশোনা করতাম। বাড়ি থেকে কোন টাকা দিতে পারতো না। ওদেরই চলতে কষ্ট হতো, ছোট ভাই বোনও ছিলো।

 

টাকা পয়সা না থাকায়, আর্তিকে সেই দিন ভালবাসতে পারিনি। পারিনি তাঁর আপন হতে। তারপর যতদিন ভার্সিটিতে ছিলাম, আর্তি যেখানে দেখতো অপমান করে কথা বলতো সবার সামনে। অনার্স ফাইনাল দিয়ে শেষ পরীক্ষার দিন আর্তিকে বলে ছিলাম, "টাকা পয়সায় ভালবাসা হয় না। একদিন টাকা পয়সা পাবে ভালোবাসার জন্য আহামরি করবে।"

 

আর্তি সেই বলে, "তোর মতো গরিব কাউকে পেয়ে যাবি। আমার থেকে অনেক ভালো, ভালবাসবে"

তারপরও আবার হাসি।

 

অনার্স দিয়েই ঢাকা থেকে চলে আসি চট্টগ্রাম। আর শুরু করি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা। আমার সাথে ইফতিও শিক্ষকতা করতো। একসাথে চাকুরী করা, তাকে আস্তে আস্তে ভালো লাগে। আমি মাস্টার্সে ভর্তি হই চট্টগ্রামেই। চাকুরী করে যা পেতাম তা দিয়ে কোন রকম নিজে চলে, বাড়িতে কিছু দিতাম। 

 

ইফতির সাথে ভালবাসায় জড়িয়ে শুরু হয়, নতুন জীবনের স্বপ্ন। ওর অবসর সময় কাটানোর জন্যই চাকুরী করতো। তাঁর বাবা তখন পুলিশের চাকুরী করে। আমার সাথে জীবন চলতে শুরু হয়। দুজনের জীবন ভালোই চলে। অনেক কষ্ট আসে জীবনে তারপরও সে আমার হাতটা ছাড়েনি বরং শক্ত করে হাত ধরে আমায় সাহস দিয়েছে। মাস্টার্স শেষ করেই ইফতিকে বিয়ে করে ফেলি। তখন ছিলো না কোন ভালো চাকুরী। তাঁর পরিবারের অমতে আমার সাথে বিয়ে হয়। 

 

আমরা দুজনের বেতন দিয়ে কোন রকম চলতাম। আমি বিসিএস দিবো বলে নানান বই পড়তে শুরু করি। প্রথম বার দিয়ে পাশ করতে পারিনি বিসিএস। ইফতি আমাকে ভরসা দেয়। আরো বেশি চেষ্টা করতে বলে। আমিও বউয়ের থেকে ভরসা পেয়ে শুরু করি আরো পরিশ্রম। 

২য় বার ঠিকই পাশ করে ফেলি। জীবনের মোড় পাল্টে যায় আমাদের। আমি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি। 

 

ইফতি আর আমার জীবনে কখনোই কষ্ট ছুঁয়ে দেখে নি। চাকুরী হওয়ার পর গ্রামে মা বাবাকে বাড়ি করে দেওয়া, ছোট ভাই বোনের পড়াশোনা। নিজেও বাড়ি কিনে চট্রগ্রাম এখন থাকি। 

 

এইসব ভাবছি আর হাঁটছি। অনেক গহনা কিনে দিয়েছি বউকে, সেগুলোয় সে নাকি সুখ পায় না। কাচের চুড়িতে নাকি অনেক ভালবাসা জড়িয়ে থাকে। অন্য মেয়েদের মতো নয় ইফতি, কখনো টাকার লোভ তাঁর ভিতর দেখিনি। ভালোবেসে কত না খেয়ে আমার সাথেও ছিলো। 

 

একটা মেয়েও হয়েছে। একদম পুতুলের মতো। ভালবাসায় ভরপুর আমার ঘরটা। আসলে জীবনে টাকা পয়সায় সুখ নয়, সুখ হয় ভালোবাসায়। 

 

ভাবতে ভাবতে চলে আসলাম বাসায়। দেখি ইফতি রান্না করছে। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে খেলা করছি। ইফতি এককাপ চা নিয়ে আসলো। আমি সোফায় বসে মেয়েকে নিয়ে, চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। ইফতি রান্না শেষ করে আসলো। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছি। ইফতিও পাশে বসে কাঁধে মাথাটা দিয়ে বললো, 'আজকে কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে। শরীর খারাপ নাকি? আমার কোন কিছুতে কষ্ট পেয়েছেন?'

 

"তুমি আমার সব, তোমার ভালোবাসা সুখ হয়, আঘাত নয়"

ইফতি চুপ করেই আছে। আমি আর্তির কথা মনে করে মিটমিট হাসছি। 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


Tanvir Arafat

93 Blog posts

Comments